একদিন দুই বন্ধুতে মিলে গল্প হচ্ছে। উভয়ের কথোপকথনের মধ্যে এক সময় নেকড়ে শিয়ালককে বলল-“শেয়াল ভাই, তোর যা বুদ্ধি-তা একেবারের মানুষের মত।” কথা শুনে শিয়ালের আহ্লাদিত হবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য, প্রসন্ন না হয়ে শিয়াল বরং তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল-“দেখ্ নেকড়ে ভাই, আর যাই করিস, আমাকে ঐ মানুষগুলোর সাথে তুলনা করে অপমান করিস না।” নেকড়ে বলল-“সে কি রে, মানুষ সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। আর তুই পশু। সেই মানুষের সাথে তুলনা করে তোর মর্যাদা কত বাড়িয়ে দেওয়া হল-অথচ তুই বলছিস কি না যে তোর তাতে অপমান হয়েছে? এর নিশ্চয় কোন গুঢ় কারণ আছে। সেই কারণ বা রহস্যটি একবার আমাকে বুঝিয়ে বলে্তা দেখি।” এবার দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে শেয়াল বলল-“তবে শোন্। দেখ, আমি শেয়াল-পশু। পশু হিসাবে জন্মেছি, আর পশু হিসাবেই মারা যাব। তুই নেকড়ে-পশু। তুইও পশু হিসাবে জন্মেছিস আর পশু হিসাবেই মারা যাবি। এতে আশ্চর্য হবারই কী, আর আক্ষেপেরই বা কী? কিন্তু দেখ, মানুষেরা ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কত যত্নে ও কৃপায় ঈশ্বর মানুষগুলোকে মানুষ হিসাবে জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কি দূরদৃষ্ট-এরা ঈশ্বরের কৃপায় মানুষ হিসাবে জন্মেও মানুষ হিসাবে বাঁচে না। মানুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করার পর এরা সারা জীবন পশুর জীবন যাপন করে, আর মারা যাবার সময়ও মানুষ হিসাবে মারা যায় না- পশু হিসাবেই মারা যায়। তাহলে দেখ, এ-হেন মানুষের সাথে তুলনা করে তুই আমার অপমান করলি কি-না?” (কাহিনি-পুলিন্দা গ্রামের যুব উৎসবে শ্রী মৃদুল ভট্টাচার্য মহাশয়ের ভাষণের মাধ্যমে শোনা) সত্যিই মানুষের আচার আচরণ এক এক সময় এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যে তা পশুদেরও লজ্জা দেয়। আর সেজন্যই বুঝি স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিখ্যাত স্বদেশমন্ত্রে জগন্মাতার কাছে প্রার্থনা করছেন-“হে গৌরীনাথ, হে জগদন্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।” তিনি অপর একটি জায়গায় ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়েও বলছেন-“ধর্ম এমন একটি ভাব যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।” আমাদের উদ্দেশ্য হল আমাদের মধ্যে যে পশুভাব আছে তা দূর করে প্রথমে মনুষ্যত্ব অর্জন করা এবং পরে মনুষ্যত্বকেও অতিক্রম করে দেবত্বে উন্নীত হওয়া।
এবারে দেখা যাক শ্রীরামকৃষ্ণদেব ‘মানুষ’ কথাটির ব্যাখ্যায় কী বলেছেন। তাঁর কথায় “মানুষ আর মানহুঁশ। যার চৈতন্য হয়েছে, সেই মানহুঁশ। চৈতন্য না হলে বৃথা মানুষ জন্ম!” হুঁশ অর্থাৎ যাঁর মধ্যে বিচার বোধ আছে। বিচারবোধ কি? না, সদসদ্ বিচার। ভাল-মন্দ বিচার। কোন কাজ করতে গিয়ে ভেবে দেখা আমি যা করছি তা ভাল, না মন্দ। এ কাজ আমার সর্বিক কল্যাণ এনে দেবে তো? আবার আমার কল্যাণ হয়ত নিশ্চিত করা গেল কিন্তু আমার নিজের কল্যাণ করতে গিয়ে একাজ আবার অন্যের কল্যাণে বাধা সৃষ্টি করবে না তো? এককথায় যে কাজ করলে নিজের ও অপরের সকলের সার্বিক কল্যাণ হয় তাই হচ্ছে কাম্য। স্বামী বিবেকানন্দ যাকে বলেছেন “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।” এই দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের মুক্তি ও জগতের হিত সাধন। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত মানুষ হবার অন্যতম শর্ত হল হুঁশযুক্ত বা বিচারশীল জীবনযাপন করা। আমরা এখানে তাই এই বিচার বিষয়টি নিয়ে প্রথমে কিছুটা আলোচনা করতে চাই।
স্বামী জ্ঞানলোকানন্দের ‘মননালোক’(২য় খণ্ড) থেকে