আগের কাজ আগে কর, পরের কাজ পরে ধরিও। যে কাজই ধরিতে চাহ না কেন, কাজটা যে তুমিই করিতেছ, এই বুদ্ধিতে পূর্ব্বেই স্তিতধী হইয়া লইও। কাজটা তোমারই বলিয়া তোমাকেই উহার জন্য জীবন দিতে হইবে। চঞ্চল মনটাকে একটা কিছু অবলম্বন দেওয়া চাই, অতএব বেগার খাটিতে বসিয়াছ,—এইরূপ প্রাণঘাতী বিশ্বাস রাখিলে আত্মোৎসর্গ করিতে পারিবে না। প্রাণবিনাশের কারণ থাকিতে যদি বিগতভী হইতে পারে, তবেই প্রকৃত প্রাণবান্‌ হইলে। নতুবা ডাকের সাজে সাজাইলেই দুর্গাপূজা হয় না। কুকুরের পাল দিয়া কাজ হইবে না, কাজ মানুষেই করিবে। তুমি যে মানুষ, এই কথাটায় সুদৃঢ় নিষ্ঠা রাখিও; তাহা হইলে তোমার মনুষ্যত্বই তোমার কানে ধরিয়া কাজ আদায় করিয়া লইবে। কাজের প্রতি মমত্ববুদ্ধি জন্মিলে বাজে কাজ প্রাণভয়ে পলাইবে এবং কাজের কাজ আরম্ভ হইবে।—কাজগুলি যে তোমার, এ কথা স্বীকার কর। যে ডাক শুনিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছ, উহা যদি মানুষের হইত, কখনই তুমি তাহা হইলে নিজের স্বার্থকে বলি দিয়া পরার্থকে প্রসন্ন করিতে চাহিতে না। যাহা তোমার প্রিয়তম, তাহাকেও যখন হেলায় পরিহার করিবার প্রেরণা পাইতেছ এবং সে প্রেরণাকে যখন ক্ষণিকের মোহ বা নিমেষের উত্তেজনা নয় বলিয়া অন্তরে নিরন্তর উপলব্ধি করিতেছ, তখন উহা নিশ্চয় জীবন-দেবতার কাছ হইতে বরাবর ছুটিয়া আসিয়াছে, কাহারও মধ্যবর্ত্তিতার প্রসক্তি রাখে নাই। সত্য বটে, সে বজ্রবাণী মানুষেরই মুখ দিয়া উচ্চারিত হইয়াছিল, কিন্তু মানুষ যখন সত্যদর্শী হন, তখন তিনি আর সাধারণ মানুষেরই মত সরল ভাষায় কথা কহেন না, তখন তাঁহার শব্দবিন্যাসে ভাগবতী বিদ্যুৎ ঝলসিতে থাকে। সকলে তাঁহার ঘোর গর্জ্জন শুনিয়া প্রথমতঃ ভীত-গ্রস্ত হইয়া পড়ে, কিন্তু ক্রমে অনুরক্ত ও ভাবাবিষ্ট হয়। এই ভাবাবেশ যখন গভীরতা পায়, তখনই উহা প্রেরণায় পরিণত হয়। প্রেরণা চাই, নহিলে কাজ হয় না। প্রেরণা কর্ম্মের ধর্ম্ম। ইহা হইতে বিযুক্ত করিয়া কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে চাহিলে তাহা অপূর্ণ ও অসুন্দর রহিয়া যায়। প্রাণের যাহা কাম্য, তাহা কখনও অপূর্ণতা-বিসর্পী অথবা অসুন্দরমুখী হইতে পারে না। যদি তাহাই হইত, তবে আর বিশ্বজগতের নৈসর্গিক অনৈসর্গিক সকল দৃশ্যপটলে লীলায়িত ভঙ্গিমার বিচিত্র ক্রীড়া দেখিতে পাইতাম না। একাকী রহিয়া কেহই যেন আর তুষ্ট নয়, সকলেই যেন নিজেকে অতিক্রম করিয়া অপরকে বুকে তুলিয়া লইতে চায়, নিজের যাবতীয় অপরিণত গরিমা ও মহিমা অংশতঃ শ্রেষ্ঠ অপর কাহারও সম্মেলনে পরিপূরণ করিতে চায়। তুমি চাহিতেছ—তোমার অসংখ্য নগ্নদেহপদ ভ্রাতাভগ্নীর মধ্যে নিজেকে ছড়াইয়া দিয়া তাহাদের সুলভ সারল্যে নিজের শাঠ্যদিগ্ধ মনকে ভিজাইয়া ডুবাইয়া স্নিগ্ধ, স্নেহ-রস-লিপ্ত, কোমল ও নমনীয় করিয়া তুলিতে চাহিতেছে।
স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘কর্ম্ম-ভেরী’ থেকে