যোগীরাজ শ্রীশ্যামাচরণ লাহিড়ী ভারতের অধ্যাত্ম জগতের ধ্রুবতারা। এই মহান্‌ যোগীর কথা বাদ দিয়ে আজকের যুগে যোগসাধনার কথা আলোচনা করা প্রায় অসম্ভব। ব্রহ্মজ্ঞানী এই মহাযোগী এমনই এক অধ্যাত্মচেতনার ধারক, বাহক ও সঞ্চারক যাতে প্রচারের কোন অবকাশ নেই; বাক্যচাতুর্য্য, পাণ্ডিত্য ও কচাকচির কোন স্থান নেই; অন্ধ বিশ্বাস, ভাবালুতা ও কল্পনার কোন সুযোগ নেই; যা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ ও নিজবোধগম্য। একই সাথে তিনি অধ্যাত্মসাধনার সহায়ক এমন এক স্বচ্ছ, সরল, সাবলীল ও আড়ম্বরহীন জীবনদর্শনের পথিকৃৎ সে পথে নিভৃতে, নীরবে, সকলের অলক্ষ্যে আজও লক্ষ লক্ষ গৃহী মানুষ তাঁর অনুগামী। তাঁর সমস্ত জীবন; কি সাধনা, কি সাংসারিক ও সামাজিক জীবনের দায়িত্ব পালন, কি অধ্যাত্ম চেতনার বিকাশ— সবদিক থেকেই পূর্ণ ও অনুকরণীয়। এমন দৃষ্টান্ত গত হাজার বছরের মধ্যে দেখা যায় না। অথচ ব্রহ্মজ্ঞানের চূড়ায় সমাসীন এমন এক অদ্বিতীয় মহাত্মার কথা বাইরের জগৎ তেমনভাবে জানে না কেন? তাঁর উক্তিতেই এর উত্তর খোঁজা যাক—‘মানবজীবনের পরমকাম্য গীতা, বেদ, বেদান্ত, তন্ত্র সহ সনাতনধর্মের সর্ব-শাস্ত্রের সারভূত এই যে আত্মসাধনা; সনাতন ধর্মের চির-শাশ্বত, উদার, নিষ্কলূষ, সংস্কারমুক্ত মুক্তিপথের দিশারী এই যে ব্রহ্মসাধনা; এতে প্রচারের কোন অবকাশ নেই। যার যখন প্রাণ কাঁদবে তখন আপনা হতেই পেয়ে যাবে। সূর্য্য উঠলে কি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাতে হয়?’ এই মহাযোগী এমনই প্রচার বিমুখ ছিলেন যে তাঁর একমাত্র যে ফটোটি বর্তমানে পাওয়া যায় তাও সহজে তুলতে দিতে চাননি। বলতেন, ‘ফটো তুলতে আত্মসাধনা বাদ দিয়ে ফটোটিকেই পূজো করতে শুরু করবে। এতে মোক্ষ লাভ হবে না।’ 
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে (ইং ১৮২৮, ৩০শে সেপ্টেম্বর) আবির্ভূত এই মহাত্মা মানুষের কল্যাণে পরমপ্রেমে এই জগৎকে কি মহামূল্যবান সম্পদ অকৃপণভাবে উজাড় করে দিয়ে গেছেন তা গীতা, বেদ, বেদান্ত, তন্ত্রসহ সনাতন ধর্মের সর্বশাস্ত্রের অনুমোদিত যোগপথের অনুগামী অধ্যাত্মপিয়াসী সাধকরাই অনুভব করতে পারেন। সাধনার মাধ্যমে অন্তর্জগতে যা অনুভব করতে হয় তা সাধনহীন মানুষ জানবে কি করে? তিনি আর্য্য ভারতের উচ্চকোটীর যোগীপুরুষদের মতো নিজের জীবনে পূর্ণ চতুরাশ্রম পালন করেছেন; সারাজীবন দায়িত্বের সাথে চাকরী করা থেকে শুরু করে ছেলেপুলে মানুষ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি নিষ্ঠার সাথে করেছেন এবং এরই মাঝে শৃঙ্খলার সাথে এমন এক সাধন করলেন যা তাঁকে সাধনার চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করলো। তাঁর নিজের হাতে বাংলা হরফ অথচ হিন্দী ভাষায় লেখা, গোপনে রেখে যাওয়া এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ২৬ খানা ডায়রীই তাঁর সাধনার ক্রমোন্নতি, বিভিন্ন পর্য্যায়ে নানা প্রকার দর্শন শ্রবণ এবং চূড়ান্তে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা প্রকাশ করে। গোপন দিনলিপিতে কোথাও লিখেছেন, ‘যো আত্মসূর্য্য ওহি ব্রহ্ম ওহি হম শ্যামাচরণ।’ কিছুদিন পর এক জায়গায় লিখলেন, ‘হমহি মহাপুরুষ পুরুষোত্তম।’ আরও এগিয়ে গিয়ে লিখলেন, ‘হমহি আদি পুরুষ ভগবান।’ তাঁর লেখা ডায়রীর বিষয়সকল কোন কল্পনাবিলাস নয়; এসব অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানের কথা। সাধনার মাধ্যমে নিজ অন্তরে বোধগম্য; আলোচনার বিষয় নয়। তিনি আমাদের শোনালেন ধর্ম কি। যা সবকিছু ধারণ করে আছে অর্থাৎ যে অনির্দ্দেশ্য, অব্যক্ত, অক্ষর, কালাতীত ও সর্বভূতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সত্ত্বা বর্ত্তমান তাই ধর্ম।

ডঃ অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগ প্রবন্ধে ভারতমাতা’ থেকে