উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
দুর্নীতির বহু অভিযোগ আপনার মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সুপারিশটা করেছিল অর্থ সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। ২০০৯ সালে। তাদের মনে হয়েছিল, হিসেব বহির্ভূত সম্পত্তি নিয়ে... কালো টাকা নিয়ে কিছু করা উচিত। দেশের মধ্যে এবং বাইরে, কীভাবে নয়ছয় হচ্ছে টাকা... খুঁজে বের করতে হবে সেই সূত্র। পরের বছর অনুমোদন এসেছিল। দিয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ঠিক হয়েছিল, তিনটি সংস্থা সমীক্ষা চালাবে—ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চ এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক ম্যানেজমেন্ট। তারা খুঁজবে... পৌঁছবে কালো টাকার শিকড় পর্যন্ত। সরকারিভাবে এই তিন সংস্থার রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনটি সংস্থার ‘প্রাপ্তি’তে খুব একটা সামঞ্জস্য ছিল না। তবে তিন রিপোর্টের ‘গড়’ করলে একটা বিষয় ছিল সংশয়াতীত... ১০ শতাংশ কালো টাকা যদি দেশের বাইরে গিয়ে থাকে, ৯০ শতাংশ আছে ভারতেই। ততদিনে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে গিয়েছেন। ঠিক তার দু’বছরের মাথায়... ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে সেই ভাষণ। রাতারাতি বাতিল হয়ে গেল ৫০০ ও হাজার টাকার নোট। মনে করা হয়, সেই রিপোর্টে নোট বাতিলের কোনও না কোনও সুপারিশ অবশ্যই ছিল। যা এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। নরেন্দ্র মোদি মনে করেছিলেন, নোট বাতিল করে দিলে সব কালো টাকা শেষ হয়ে যাবে। কারণ ওই দু’টি নোটেই ভারতীয় অর্থনীতির ৮৬ শতাংশ ঘোরাফেরা করছিল। অর্থাৎ মোদিজির ধারণা ছিল, ৫০০ ও হাজার টাকার সব নোট কখনওই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরবে না। এবং তার পরিমাণটা হবে ৩ থেকে ৪ লক্ষ কোটি টাকা। তা কিন্তু হয়নি। আরবিআই রিপোর্ট বলছে, ৯৯.৩ শতাংশ অর্থই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ফিরে এসেছিল। তাহলে কি ভারতীয় অর্থনীতিতে কোনও কালো টাকাই ছিল না? তা তো নয়! একটা অংশ ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছিল, কেউ মিউচুয়াল ফান্ডে, কেউ আবার সরাসরি সরকারের কাছে হিসেব বহির্ভূত সম্পত্তি দেখিয়ে আয়কর দিয়েছিল। হিসেব কষলে এই অংশটা কিন্তু খুবই নগণ্য। সত্যি যাঁরা কালো টাকার আড়তদার ছিলেন, তাঁরা নরেন্দ্র মোদির নাটকীয় ঘোষণার মতো নাটকীয়ভাবেই ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বদলে ফেলেছিলেন ২ হাজার টাকায়। রাতারাতি। মানেটা পরিষ্কার, কালো টাকা কালোই থাকল, সরকার বুঝতেও পারল না। এই আচমকা ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ হয়ে যাওয়াদের তালিকায় উঁকিঝুঁকি মেরেছিল কিছু রাজনৈতিক দলের নাম... অভিযোগ কিন্তু ছিল বিজেপির বিরুদ্ধেও। যেদিন নোট বাতিলের ঘোষণা হয়, ঠিক তার আগের দিন কী সব যেন লেনদেন করেছিল গেরুয়া শিবির... এমন কথা বিরোধীরা প্রচুর বলেছিল। মানুষ বিশ্বাস করেনি। দেশবাসী ভেবেছিল, নরেন্দ্র মোদি দেশসেবক... আদ্যোপান্ত সাধারণ মানুষ। তিনি ‘নায়ক’ ছবির অনিল কাপুর না হতে পারেন, কিন্তু দুর্নীতিবাজ নন। বিজেপি এমন করতেই পারে না! মাঠে মারা গিয়েছিল বিরোধীদের অভিযোগ।
মারা গিয়েছে তারপর অনেকে... লাখো কর্মসংস্থান, ছোট ছোট বহু কোম্পানি, না খেতে পাওয়া বহু পেট। মানুষ যে তাও বিশ্বাস করেনি! মোদিজি যা করেছেন ভালোর জন্যই। না-ই বা ফিরে এল কালো টাকা, প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে না-ই বা ঢুকল ১৫ লক্ষ টাকা। চেষ্টা উনি করেছেন। সেই চেষ্টা চলছে আজও। সাফাই দেওয়ার। বিদেশি ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের কালো টাকা বেড়েছে? এ যে ভয়াবহ অপপ্রচার! মোদিজির অর্থমন্ত্রক পারলে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে অভিযোগকারীদের মারতে আসছে। বলছে, কালো টাকা বাড়েনি... বেড়েছে শেয়ার, বন্ডে বিনিয়োগ। সেই সব মিলিয়ে বলা হচ্ছে, সুইস ব্যাঙ্কে এখন ভারতীয়দের কত লক্ষ কোটি টাকা রয়েছে? শ্রীমান সরকার বাহাদুরের উদ্দেশে বলি, সাধারণ মানুষ জানে না। সাধারণ মানুষ জানে না, সুইস ব্যাঙ্কের বন্ড খায় না মাথায় দেয়? জেনিভার এইচএসবিসির শাখায় কীভাবে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়? আধার কার্ড চলে কি? ওরা বারবার কেওয়াইসি চায়?... এসব মানুষ বোঝে না? আপনার নোট বাতিলে যদি সত্যিই কোনও উপকার হয়ে থাকে, তা হল আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি। ইনকাম ট্যাক্সের হিসেব মতো, নোট বাতিলের পর দেশে প্রায় ১ কোটি করদাতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাঁদের ৯৯ শতাংশই ব্যক্তিগত আয়করদাতা। তাঁদের টাকায় দেশ চলে না। দেশ চলে কর্পোরেট ট্যাক্সে। ফলে ওই বৃদ্ধি আদতে খুব যে উপকার করেছে, তা নয়। তাহলে আজ শেয়ার বাজার দাঁড়িয়ে আছে কেন? আমাদের দেশের অর্থনীতির যা ভাঁড়ে মা ভবানী দশা, তাতে তো শেয়ার বাজার ধসে যাওয়ার কথা। একটা সরকারি কারণ হল, বিনিয়োগ। কিন্তু এর নেপথ্যেও যে একটা অঙ্ক আছে... যে পরিমাণ কালো টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেটাই আবার ভারতে বিনিয়োগ হচ্ছে। কীভাবে?
ধরা যাক, ভারতের অর্থনীতি ১০০ টাকার। মানে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানে বাজারে তারা ১০০ টাকা ছেড়েছে। তার মধ্যে ৫০ টাকা হিসেব বহির্ভূতভাবে রামবাবু সুইস ব্যাঙ্কে রাখল। তা সুইস ফ্রাঁ হিসেবে হতে পারে, কিংবা বন্ড। সেই টাকাটাই জনবাবু সুইস ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ হিসেবে নিয়ে ভারতে লগ্নি করল। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেখল, ভারতের অর্থনীতি হয়ে গিয়েছে ১০০+৫০=১৫০ টাকার। আদপে কিন্তু তা নয়! সেই ৫০ টাকাই ঘুরেফিরে লগ্নি হিসেবে দেশে এসেছে। অর্থাৎ, বাকি ৫০ টাকা আরবিআইয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এটাই অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ প্রবণতা। সরকার দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ধরতে পারছে না। এক ‘ভূতুড়ে’ অবস্থা। ঠিক যে কারণে দেশে ক্রিপটোকারেন্সি বৈধ করার কথা ভাবতে হচ্ছে আরবিআইকে। ঝুঁকি হলেও তার বেশিটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভাবনা ভালো, কিন্তু প্রয়াস? প্রশ্ন থাকছেই। কোভিডকালে যদি সত্যিই সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের কালো টাকা বেড়ে থাকে, তার থেকে উদ্বেগের আর কিছুই হতে পারে না। অভিযোগ উঠছে, গত বছর দফায় দফায় ভারত সরকার যে ‘ঋণসর্বস্ব’ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তার বেশিরভাগটাই কালো টাকা হিসেবে পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের জোটেনি প্রায় কিছুই। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে টাকার জোগান বাড়েনি... পরিকাঠামো উন্নয়নও তেমন হয়নি। প্রচুর শিল্প হয়েছে বা এমএসএমই সেক্টর চাঙ্গা হয়ে উঠেছে, তেমনটাও নয়। তাহলে এই অভিযোগ কি সত্যি? আজ না হয় কাল মোদি সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। সাফাই নয়, জবাব। না দিতে পারলে মানুষ ভোটে বাকিটা বুঝে নেবে। ১৫ লক্ষ টাকার গল্প সাত বছরে মোদিজির মুখে আর শোনা যায়নি। আর যাবে বলে মনেও হয় না। কারণ তিনি জানেন, মানুষ এবার আর এসব ধাপ্পা বিশ্বাস করবে না।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ স্তিমিত হচ্ছে... তৃতীয় ঢেউ আসছে। তার কোনও প্রস্তুতি নেই। না সরকারিভাবে, আর না মানুষের। এই এক বছরে গরিব ভিখিরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত গরিব। আর ধনীরা... অতি ধনী। আর একটা বছর এমন চললে শিক্ষা ব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না, একবেলার ভাত জোগাড় করা মুশকিল হবে, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে আমরা ভয় পাব। দেশের আনাচে কানাচে উত্তরপ্রদেশের মতো নদীচরে আটকে থাকবে মৃতদেহ। আর প্রধানমন্ত্রী তখনও সাফাই দেবেন... বলবেন ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির কথা।