উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
নবাবের বাগান বাড়িতে তৈরি হয়েছিল কৃত্রিম পাহাড়। সেখানে রেখেছিলেন কয়েক হাজার দুর্লভ সাপ। তৈরি করেছিলেন চিড়িয়াখানা। শোনা যায় বাগান নির্মাণে নবাবকে সাহায্য করেছিলেন রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক। ওয়াজেদ আলির বাগানের জন্যই এই এলাকার ‘গার্ডেনরিচ’ নামকরণ হয়েছে। আজ যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দপ্তর, সেটি ছিল এককালে নবাবের নাচমহল।
লখনউ-এর গান বাজনা বাইজি নাচের জন্য, সেসময় বিখ্যাত হয়েছিল শুঁড়োর মতিলাল মল্লিকের বাগানবাড়িটিও। ১৮২৩ সালে দোলযাত্রায় মুজরো আসর জমাতে সেখানে এসেছিলেন বিখ্যাত নর্তকী বেগমজান আর হিঙ্গুলবাই। লন্ডনের এশিয়াটিক জার্নালে সেই খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।
সে একটা দিন ছিল যখন কলকাতায় নব্য ধনী আর জমিদার শ্রেণি শুধুমাত্র বিশাল অট্টালিকায় নিজের বৈভব ও রুচিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাগানবাড়ি বিলাস। কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় নিরিবিলি জায়গায় তৈরি হতো বাগানবাড়ি। নানা রকম দুষ্প্রাপ্য ফল-ফলাদি, দেশি-বিদেশি ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হত সেই বাগানবাড়ি। সপ্তাহান্তে বাবুরা সেখানে মজলিশ বসাতেন। বসত গান বাজনার আসর। ছিল এলাহি খানাপিনার ব্যবস্থা।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘বেলগাছিয়া ভিলা’ তখন মতিঝিল প্রাসাদ। এই প্রাসাদের সীমানা ঘেরা পরিখায় ফুটে থাকত পদ্মফুল। মাঝে ছিল একটি নকল দ্বীপ। কাঠের সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করতেন অতিথিরা। কে ছিল না সেই অতিথি তালিকায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, কাউন্সিল সদস্য, সিভিলিয়ান, ব্যারিস্টারদের পাশাপাশি দেশীয় জমিদার থেকে নব্য বাঙালিবাবুরা পর্যন্ত অ্যাপায়িত হতো এই বাগানবাড়িতে। দ্বারকানাথের প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন ‘বেলগাছিয়া ভিলা’ নির্মাণে।
রাজা রাজেন্দ্রনাথ মল্লিকের মার্বেল প্যালেসের বাগান বাড়িটি ছিল এক আস্ত চিড়িয়াখানা। এমু, চীনের মান্দারিন হাঁস, বার্ড অব প্যারাডাইস এসব নানান পাখির সঙ্গে উট, কাশ্মীরের ছাগলের মতো দুষ্প্রাপ্য জন্তু-জানোয়ার আবাস ছিল এই বাগানবাড়ি। পরবর্তীকালে আলিপুরের চিড়িয়াখানা তৈরি হলে এই বাগানবাড়ির আশ্রয়ে থাকা বহু পশুপাখি তিনি দান করেছিলেন।
ওয়ারেন হেস্টিংসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন স্যার এলাইজা ইম্পে। সুপ্রিম কোর্টের এই বিচারপতি মিডলটন রোডে যে বাগানবাড়িতে থাকতেন, সেখানে তখন চরে বেড়াত হরিণের দল। তাই নাম হয়ে গিয়েছিল ডিয়ার পার্ক। যা এখন পার্ক স্ট্রিট।
পেরিন সাহেবের বাগান আজকের বাগবাজার। অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেন। তাঁরও ছিল বাগানের নেশা। তিনি স্ট্যান্ড রোডের গা ঘেঁষে তৈরি করেছিলেন, কলকাতার গর্ব ইডেন গার্ডেন।
গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কোন্নগরে অবনীন্দ্রনাথেরও একটি বাগানবাড়ি ছিল। আর এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথেরও আসা যাওয়া ছিল। কোন্নগরে এই বাড়িতে ছোটবেলার কিছুটা অবনীন্দ্রনাথের কেটেছে। তখন সাঁতারকাটা নৌকো চড়া আর শিকার করে স্বপ্নের মতো দিন কাটানোর কথা, তাঁর স্মৃতিকথা। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’তে উল্লেখ করেছেন। এখানেই দেখেছেন বহুরূপী, জীবনে প্রথম এঁকেছেন কুঁড়েঘর। ছেলেকে সাহসী করে তুলবেন বলে বাবা গুণেন্দ্রনাথ তাঁর কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি ছুঁড়তেন। বাবার মৃত্যুর পর এই বাগানবাড়ির পোষা কুকুর, ঘোড়া, হরিণ, বাঁদর সব ফেলে রেখে অবনঠাকুররা কলকাতায় ফিরে যান। প্রায় ১০ বিঘে জমির উপর তৈরি হয়েছিল এই বাগানবাড়িটি।
৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি আবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আতুড়ঘর। এটি ছিল বারীন্দ্রনাথ ঘোষের পৈতৃক সম্পত্তি। চারদিকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাগানটির মাঝে ছিল ছোট্ট একটি পাকাবাড়ি। এই বাগানবাড়িতেই বাস করতেন অরবিন্দ ঘোষ তাঁর দুই ভাই মনোমোহন ও বিনয়কে নিয়ে। একসময় এই ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের আখড়া। দুই ভাইয়ের সঙ্গে উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, হেমচন্দ্র ঘোষ, অবিনাশ ভট্টাচার্যের মতো বাঘা বিপ্লবীরা। এখানে এসে শলাপরামর্শ করতেন। ১৯০৮ সালে ২ মে ব্রিটিশ পুলিস এই বাগানবাড়ি থেকে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। বাগানের মাটি খুঁড়ে কয়েকটি ট্রাঙ্কে বেশ কিছু তাজা বোমা, ডিনামাইট, একটি রিভলবার কিছু বৈপ্লবিক পুস্তিকা উদ্ধার করে। মুরারিপুকুরের বোমা মামলায় অরবিন্দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণের অসুস্থতা যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে তখন দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্যামপুকুরে ৭০ দিন থাকার পরও ওষুধে খুব একটা কাজ হচ্ছে না দেখে, মহেন্দ্রলাল সরকারের পরামর্শে ভক্তরা তাঁকে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে নিয়ে আসে। রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাললাল ঘোষের এই নিরিবিলি ১১ বিঘের উপর চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এই বাগানবাড়িটি ঠাকুরেরও খুব পছন্দ হয়ে যায়। ১৮৮৬ সালে ১ জানুয়ারি কাশীপুরের এই বাগানবাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন। আজও এখানে এই উৎসব পালন করে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ।
বাগানবাড়ি আর তার শৌখিনতা একাকালে ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক। বিলাস থেকে বিপ্লবের প্রতীক সেই সাজানো বাগানবাড়িগুলি আজ প্রায় বিস্মৃত।