মন্দিরের পাশেই বাড়ি
গ্রামের কালী মন্দিরের পাশেই আমাদের বাড়ি। আমার কাকু কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। কিন্তু কালী পুজোয় সপরিবারে গ্রামে আসেন। তাই দীপাবলি মানেই আমাদের পরিবারের ‘গেট টুগেদার’। খুড়তুতো ভাইবোনকে নিয়ে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমরা ভাইবোনেরা আলো দিয়ে বাড়ি সাজানোর কাজে বড়দের সাহায্য করি। চকমকে আলো দিয়ে গোটা বাড়ি সাজানো হয়। উঠোনে মা-কাকিমা মিলে আলপনা দেন। বাড়ির সদর দরজায় প্রদীপ জ্বালানো হয়। এছাড়াও কিছু রীতিনীতি পালন করা হয়। যেমন— গোয়াল ঘরে গোরুকে বরণ করে শিংয়ে তেল মাখানো হয়। চাষের কাজে ব্যবহৃত লাঙ্গল ও জোয়ালে সিঁদুরের টিপ দেওয়া হয়। ভূতচতুর্দশীর দিন গ্রামের একপ্রান্তে পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে সকলে মিলে ইঞ্জোল-পিঞ্জোল পালন করি। দীপাবলি উপলক্ষ্যে কাকিমা বাড়িতে পিঠে আর লাড্ডু তৈরি করেন। এটাও আমাদের মতো কচিকাঁচাদের কাছে কালী পুজোর একটা আকর্ষণ।
—শচীন মাহাতো, অষ্টম শ্রেণি
আলো দিয়ে বাড়ি সাজাই
কালী পুজোর দিন দুয়েক আগে থেকেই আমাদের আনন্দ শুরু হয়ে যায়। চলে ভাইফোঁটা পর্যন্ত। পুজোর আগে থেকেই গ্রামবাসীরা নিজেদের ঘর গোছানোর কাজ শুরু করে দেন। গোয়াল পরিষ্কারের কাজও চলে এই সময়। গ্রামে যাঁদের মাটির বাড়ি, তাঁরা নতুন করে মাটি দেন। তার উপর রং করে বিভিন্ন আলপনা দেন। আমাদের বাড়ির আলপনা, মোমবাতি আর প্রদীপের আলোয় সাজানো হয়। মাকে বাড়ি সাজানোর কাজে সাহায্য করি। বাবা ইলেকট্রিক আলোতে বাড়ি সাজান। কালী পুজোর পরের দিন গ্রামে ‘গোরু খুঁটা’ হয়। মাঠের মাঝখানে একটি খুঁটো ভালো করে পোঁতা হয়। তাতে গোরু বেঁধে খেলা দেখানো হয়। সকলে চারদিক দিয়ে গোল হয়ে ঘিরে ধরে এই খেলা দেখেন। এছাড়াও কালী পুজোর মেলাতে মোরগ লড়াই হয়ে থাকে।
—শুভজিৎ গরাই, দশম শ্রেণি
মেলা মানেই মেলবন্ধন
আমাদের গ্রামের কালী পুজো মানেই মেলা। আর মেলা মানেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন। আমাদের ঘোঙ্গা গ্রামে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বসবাস। নিজের নিজের বিশ্বাসের উপর আস্থা রেখে আমরা একে অপরের উৎসবে শামিল হই। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে কালী পুজো হয়। প্রতি বছরই ওদের বাড়িতে যাই। গত বছর বিকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম বন্ধু বাড়ি। বসে বসে পুজোর প্রস্তুতি দেখছিলাম। সেই সময় কাকিমা আমাকে আলপনা দেওয়ার কাজে সাহায্য করার জন্য বলেছিলেন। বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছিল। আর কালী পুজোতে অবশ্যই মেলাতে যাই। বিভিন্ন দোকান থেকে কেনাকাটা করি। টুকটাক খাওয়াদাওয়াও করি। ফুলঝুরি পোড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।
—তামান্না খাতুন, নবম শ্রেণি
আতসবাজির রোশনাই
দুর্গা পুজো আমাদের গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে হয়। তবে, আমাদের গ্রামে ধুমধাম করে কালী পুজোর আয়োজন করা হয়। তাই আমরা যেখানে, সেখানকার প্রধান উৎসব দীপাবলি। কালী পুজো মানেই আতসবাজির রোশনাই। তবে, কিছু গ্রাম্য আচার-আচরণ মেনে এখানে দীপাবলির আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ বছর বাবার সঙ্গে পুরুলিয়া শহরে গিয়ে আতসবাজি কিনে এনেছি। প্রতি বছরই বায়না করি, কিন্তু কোনও না কোনও অজুহাতে বাবা এড়িয়ে যান। এবার আর তা পারেননি। এই প্রথম আমি আতসবাজির মেলা দেখলাম। আমার খুব মজা লেগেছে। তুবড়ি, চরকি, তারাবাজি, ফুলঝুরি মনের সুখে কিনে নিয়ে এসেছি। কালী পুজোর সন্ধেবেলা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি পোড়াব। প্রচণ্ড মজা হবে। তবে, বাবা বারবার সাবধান করে বলেছেন, ‘বায়না করেছ, বাজি কিনে দিয়েছি। কিন্তু আগুন ভয়ঙ্কর জিনিস। আর তুমি এখনও যথেষ্ট ছোট। তাই বড়রা কেউ না থাকলে বাজি পোড়াবে না।’ আমিও বাবা-মাকে কথা দিয়েছি, সাবধানে আতসবাজি পোড়াব।
—ললিতা বিশ্বাস, পঞ্চম শ্রেণি
আলোর উৎসব
অমাবস্যার নিকষ
অন্ধকারে মা কালীর আরাধনা করা হয়। গ্রাম-বাংলায় কালী পুজোর আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। আমাদের গ্রামও এর ব্যতিক্রয় নয়। অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে আমাদের পাড়ায় মা কালীর আরাধনা করা হয়। কালী পুজো যেহেতু রাতের পুজো, তাই এই পুজোর আলোকসজ্জার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। প্রদীপ ও মোমবাতির আলোর পাশাপাশি বৈদ্যুতিক আলোয় চারদিক ঝলমল করে করে। সেই আলোয় দূরীভূত হয় প্রকৃতির অন্ধকার। মা কালীর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন মানুষের মনের অন্ধকারও দূর করেন। দীপাবলি আর বাজি কার্যত সমার্থক। তবে, শব্দবাজি নৈব নৈব চ। শব্দবাজি ফাটালে পরিবেশ দূষণ হয়। তাই শব্দ দূষণ ঠেকাতে আতসবাজি পুড়িয়েই আনন্দ করা উচিত। আমিও তাই করব।
—রানি পান্ডে, নবম শ্রেণি
খুদিবাঁধ উচ্চ বিদ্যালয়, পুরুলিয়া
পুরুলিয়া জেলার ঘোঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত খুদিবাঁধ এলাকা। খুদিবাঁধ উচ্চ বিদ্যালয় একটি কো-এডুকেশন স্কুল। বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় এক হাজার চারশো।
স্বাধীনতার পরেও ঘোঙ্গা গ্রামে সেভাবে শিক্ষা বিস্তারের কাজ হয়নি। ফলে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছিল এই গ্রামের যুব সম্প্রদায়। তাই স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষজন গ্রামে একটি স্কুল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। গ্রামের একাংশ তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নাটুয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন স্বর্গীয়া বিমলা মাহাতানি। তিনিই স্কুল স্থাপনের জন্য জমি দান করেন। এছাড়া গ্রামবাসীরাও অর্থ সাহায্য করেন। এমনকী, গ্রামের পুকুর থেকে মাছ বিক্রির পর যে লভ্যাংশ থাকত, তার থেকেও কিছুটা এই স্কুলের জন্য ব্যয় করা হয়। বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফল খুদিবাঁধ উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬০ সালের ২৩ এপ্রিল এই স্কুলের পথচলা শুরু হয়। প্রথমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পঠনপাঠন শুরু হয়। তারপর মেলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদন। ১৯৭১ সালে এই স্কুলকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর বছর দশেক আগে মেলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পঠনপাঠনের অনুমোদন।
বর্তমানে এই স্কুলে রয়েছে আইসিটি ল্যাবরেটরি, ভূগোল ল্যাব, গ্রন্থাগার। এছাড়াও প্রজেক্টরের মাধ্যমে পড়ুয়াদের ডিজিটাল ক্লাসও করানো হয়। বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে পরিচালন সমিতির সদস্য, এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও অভিভাবকরা সর্বদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ভবিষ্যতেও এই স্কুল সুনামের সঙ্গে এগিয়ে যাবে এই আশা রাখি।
—সোমনাথ কর, প্রধান শিক্ষক