যা ভাবা গিয়েছিল, তাই হয়েছে। ছ’য়ে ছক্কা। বাংলায় ঝড়ের রং ফের ‘সবুজ’। লোকসভা ভোটের পর রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচনের মতো এবারেও নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখল তৃণমূল এবং তা অনেকটা ভোট বাড়িয়ে। এই নির্বাচনের ফল দেখিয়ে দিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এবং গোটা রাজ্যে সাড়া ফেলে দেওয়া আর জি কর কাণ্ড সিতাই, তালডাংরা, মেদিনীপুর, হাড়োয়া, নৈহাটি ও মাদারিহাটের ভোটারদের মনে কোনও ছায়াই ফেলতে পারেনি। এ রাজ্যে যেহেতু ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচন ছিল, তাই এর ফলাফলে শাসক তৃণমূল বা প্রধান বিরোধী দল বিজেপিতে ভারসাম্যের পরিবর্তন হওয়ার সেভাবে কোনও কথা ছিল না। শুধু দেখার ছিল, বামেরা কোনও দাগ কাটতে পারে কি না। মানতেই হবে, আলিমুদ্দিনের কর্তারা এবারেও বঙ্গবাসীকে ‘হতাশ’ করেননি। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকে বামেদের সেই যে শূন্য-যাত্রা শুরু হয়েছে, এই উপ নির্বাচনেও সেই ধারা অব্যাহত থাকল। অবস্থা এতটাই করুণ যে, ৩৪ বছরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকেরা তাদের প্রার্থীদের ‘জামানত’ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারছে না। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট। বহু অপকর্মের হোতা বামেদের এখনও বিশ্বাস করেন না রাজ্যের মানুষ। এই উপ নির্বাচনে সিপিএম সহ বামফ্রন্টের মূল চার শরিক দল ৪টি আসনে লড়েছিল। বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্যের কথা বলে বাকি দুটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল নকশাল এবং আইএসএফকে। তাতে অবশ্য কোনও লাভ হয়নি। গত বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে লড়াই করেছিল বামেরা। এবার দু’পক্ষ আলাদা প্রার্থী দিয়ে আখেরে বিজেপিকে সুবিধা করে দিয়েছে। এবার বাম কংগ্রেস দু’পক্ষই সব আসনে জামানত খুইয়েছে।
এই উপ নির্বাচন ফের বুঝিয়ে দিল রাজ্যের সংখ্যালঘুরা এখনও তাদের ত্রাতা ও রক্ষাকর্তা হিসেবে নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পাশাপাশি ৮ থেকে ৮০, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে ৭২টি প্রকল্পের আর্থিক সুবিধা সরকারের হাত ধরে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, মমতার বিরুদ্ধে কাদা ছিটিয়ে তার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখানেই মার খেয়েছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বিভাজনের রাজনীতি। মানুষ বিভাজনের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করায় তাদের হাতছাড়া হয়েছে মাদারিহাট আসনটি। আর বামেরা, বিশেষত সিপিএম বুঝেই উঠতে পারছে না বিরোধী হিসেবে তাদের কী করা উচিত। একথা ঠিক, মিটিং-মিছিলে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সিপিএমের উপস্থিতি যথেষ্ট সাড়া জাগানো। কিন্তু মুখে দু’পক্ষকেই সমান অপরাধী বললেও এই দল এখনও বিজেপির চেয়ে তৃণমূলকে বড় শত্রু বলে মনে করে। এমনকী মানুষের স্বার্থবাহী সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলি নিয়েও তারা ঘৃণ্য প্রচার চালাতে দ্বিধা করে না। এই দ্বিচারিতা, মূল শত্রু চিনতে ও ঠিক করতে ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে সিপিএমকে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বাস্তবের জমিতে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। এর ষোলো আনা ফায়দা তুলছে বিজেপি। বামের ভোটে পুষ্ট হচ্ছে ‘রাম’। প্রতিটি ভোটের ফলাফলের পর দেখা যাচ্ছে, সিপিএম এক পা এগনোর কথা বলে দু’ পা পিছিয়ে গিয়েছে।
খবরে প্রকাশ, এবার নাকি ’২৬-এর বিধানসভা ভোটে ‘দাগ’ কাটতে ঝাঁপাতে চলেছে সিপিএম। এ জন্য ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা। তার মানে দাঁড়ায়, সেলিম-সুজন-সূর্য মিশ্রদের পরামর্শ আর কাজে আসছে না। তাই পেশাদার পরামর্শদাতা ‘হায়ার’ করার সিদ্ধান্ত। প্রায় ষাট বছরের পুরনো দলে মতাদর্শগত আনুগত্য, পেশাদার বিপ্লবী তৈরি, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাবনা কালাধারে চলে গিয়েছে। হোলটাইমারদের দল এখন কর্মখালির বিজ্ঞাপন দিয়ে বেতনভুক্ত কর্মী নিয়োগ করে ভোটে ‘দাগ’ কাটার স্লোগান ও প্রচারের রণকৌশল ঠিক করতে চাইছে। নজিরবিহীন পরিবর্তন সন্দেহ নেই। ইতিহাস বলছে, একসময়ে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া, ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া, ‘শ্রেণিশত্রু’ কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করা, বিজেপির চেয়ে তৃণমূলকে বড় শত্রু ভাবার মতো একের পর এক ভুল করে সিপিএম আজ গোটা দেশে কার্যত ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন বঙ্গ সিপিএমের পেশাদার নিয়োগ করে পরিস্থিতি মোকাবিলার নীতি এ রাজ্যে তাদের পায়ের তলায় জমি পেতে সাহায্য করবে কি না, তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে দলের বঙ্গ বিগ্রেডের এই পদক্ষেপকে প্রকাশ কারাত লবি কী চোখে দেখে, এখন সেটাই দেখার।