বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
টুটুল যেন নিজেরই একটা দিদি। আব্বা তো নেই। তাই আম্মাকে নিয়েই সারাদিন কত কী চিন্তা করে ছেলেটা! ইশকুলের হেডস্যার শুভেন্দুবাবু সব জানেন। শাকিরদের পাড়ার দিকে এলেই আম্মা এক গেলাস শরবত নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। সত্যি বলতে, ইশকুলের প্রায় সব স্যারেরাই খুব ভালোবাসেন শাকিরকে। গোটা পাড়ার মধ্যে আম্মার যাঁরা উপকার করেন, তাঁদের মধ্যে মাঝি ঠাকুমা, চরিবুড়ি, সুরবালা নানি, সন্ধ্যা মাসি, মিনা পিসি সব্বাই জমি জিরেত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছোট হলেও শাকির সব দেখে।
সব দিন মুড়ি, রুটি আর ভিজে ভাত জোটে না তেমন। খাওয়া না হলেও কেউ কিছু বুঝতেই পারে না। ইশকুলের স্যারেদের মুখেই তো কত কী গল্প শুনেছে ছেলেটা।
খোলাপোতার দিদা মানে, মুরশিদুল স্যারের আম্মা গোয়াল ঘরে রোজ রাতে টাঙিয়ে রাখতেন মশারি। শুনতে এখনও যেন কেমন আশ্চর্য লাগে শাকিরের। নিজেদের পাড়ায় তো এখন আর তেমন দিদা কেউ নেই। বাড়ি-ঘর বলতে সবই কেমন ভাঙা-চোরা, ফুটো চাল! যেমন বর্ষাকালে বিছানা সব ভিজে যায়, তেমনই শীতে ছেঁড়া কাঁথার কী কষ্ট!
শুভেন্দুবাবু স্যারের জন্যে এক এক সময় চোখ ভর্তি হয়ে জল আসে শাকিরের। আম্মাকে কিছু বলতে পারে না। ভাঙা হ্যারিকেনের আলোতেই রোজের পড়া সব তৈরি হয়ে যায় এই খবরটাও দু’ দশখানা গাঁয়ের মানুষ সব জানতেন। আব্বা নেই তো কী হয়েছে। মাথার ওপর আম্মা তো আছে।শুতে শুতে একটু রাত হয়ে গেলেও ভাবনা নেই।
‘খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো— বুকের ভেতর কে’... আম্মাকে একটু জড়িয়ে ধরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে শাকির। সেটা অবশ্য ইশকুলের কেউ জানেই না। জানেন শুধু গিয়াসুদ্দিন স্যার। মাঝে মাঝে হাতে তৈরি একটা খাম ধরিয়ে দেন ছেলেটার হাতে। আর ছেলেটাও কী বোকা!ইশকুল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কোথাও খামটা খুলে দেখেও না। আম্মাই সেটা খোলেন। শাকির সেটা দেখতেই পায় না। শুধু দুপুরবেলার দিকে আম্মা যেন কেমন একটু হাসি-খুশি মুখ নিয়ে ফিরে আসেন ভাঙা মাটির ঘরটায়।
গামছায় বাঁধা বেশ অনেকটা চাল। সঙ্গে একটু নুন-তেল। আর ছেলেটার জন্যে একটা ডিম। তাতেই যেন গোটা ভাঙা ঘরটা খুশিতে কেমন থই থই করে। সেদিন মাঝ রাতেই কেমন যেন একটা ভাঙা চাঁদ জানলা গলে শাকিরের কাছে এসে শুয়ে পড়ে। আম্মা কিছু জানেই না। জানেন শুধু সোহারার স্যার। তিনিই একদিন ডেকে নিলেন একটা বকুল গাছের আড়ালে। তারপর এমন করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলেন, মনে হল যেন হারিয়ে যাওয়া ওর সেই ছোটবেলার আব্বা! শাকির আর কথা বলতে পারেনি সেদিন।
পায়ে হাত দিতেও যেন ভুলে গেছে বোকা ছেলেটা! কী আশ্চর্য! স্যার অবশ্য তেমন কোনও সুযোগও দেননি ছেলেটাকে। নিজেই একটা বকুল গাছের ছায়ায় পুরনো খবরের কাগজ পেতে বসে পড়েছেন টিফিন পিরিয়ডে। কাগজের ঠোঙায় কত কী খাবার! বেশি কিছু কথা বললেন না তেমন। শুধু বললেন, তোর যে আব্বু নেই আমি শুনেছি। ডোন্ট ওরিড। এই নে। এই খামটা আম্মাকে দিবি। ইশকুলে যেন কাউকে কিছু বলবি না। তবু কেমন যেন শাকিরের মুখটা একটু চুপসে গেল ভয়ে। কথা বলতে বড্ড লজ্জা। টাকার খামটা হাতে নেবে কি? হাতটা যেন কেমন কাঁপছে ছেলেটার। সেদিনের রাতটা যেন আলোয় আলোয় কেমন ফুল ফুটিয়ে ছিল আকাশ জুড়ে। চরিবুড়ি, সুরবালা, আর মাঝি মাসিদের ঘরের মাথায় একটা চাঁদ উঠেছিল গোল মতন। ঠিক যেন সোনার তাল! হাত বাড়ালেও ধরা যায় না! কী আশ্চর্য! মালতিপুর নামটা শুনলেই শাকির যেন কেমন ছোট্ট ছেলেটি হয়ে যায়। ইছামতী নদীটাও সব মনে রেখেছে এখনও। কলকাতার দিক থেকে কেউ একবার ওদিকে বেড়াতে গেলেই কবি করুণাবাবুর সঙ্গে টুটুল আর পান্নালাল মাঝির নামটাও মনে করিয়ে দেয় সবাইকে। শাকির যেন ইছামতীর আর একটা বন্ধু। যেমন ঢেউ, তেমন ছলাৎ ছলাৎ জলের পদ্য। মনে পড়লে এখনও মন কেমন করে।
এপার থেকে ওপারের গ্রামটাকে বেশ দেখা যায়। আম্মাকে নিয়ে একবার হলেও বড্ড যেতে ইচ্ছে করে ইছামতীর ধারে। যেমন ঢেউ। তেমন মজা। তবু...
হঠাৎ যেন কেমন দু’চোখ ভেসে যায় জলে জলে। আম্মাকে তো কিছুই বলা হয়নি তেমন। সব কিছুই লুকনো আছে বুকের মধ্যে। ঠিক যেন একটা-দুটো নয়। একশোটা কুঁড়ির আড়ালে ছোট্টবেলার এক চিলতে একটা পদ্য। আম্মার মতো দেখতে।