উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য, ব্যবসায় গোলোযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
আমার স্কুলের স্পোর্টস
স্পোর্টস শব্দটি শুনলেই সবার আগে যা মনে পড়ে তা হল কমলালেবুর রঙের মিঠেরোদ্দুরের শীতসকালে হইহই এক খেলার মাঠ যেখানে আমরা ভুবনমালা-কুন্দমালা-কাদম্বিনী-চন্দ্রমুখীরা রঙে রঙে ছড়িয়ে পড়ি।সেদিনটায় না থাকে বইখাতার স্তূপ পর্বত না থাকে পরীক্ষার গ্রস্ত উপত্যকা!
সকালের প্রার্থনাসভায় সত্যিকারের আনন্দ নিয়ে আমরা শপথ নিই খেলাধুলোর সমস্ত নিয়ম মান্য করেই আজকের প্রতিযোগিতায় ভাগ নেব। বছরের এই দিনটিতে যেন দিদিমণিরাও ক্লাসরুমের গাম্ভীর্যের মুখোশটা সরিয়ে রেখে আমাদের খেলার সাথী হয়ে ওঠেন। শিশুশ্রেণী-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সবার জন্য দৌড়-বস্তাদৌড়-লাফদড়ি-শটপাট-হাইজাম্প-লংজাম্প-রিলে রেস-যেমন খুশি সাজোর তালিকার পর সবচেয়ে মজা হয় নবম-একাদশের দড়িটানাটানি আর দিদিমণিদের খেলার ইভেন্ট দুটোতে! খেলার জগতের বিখ্যাত মানুষদের এইদিন স্কুলের মাঠে পাই বিশেষ অতিথি হিসেবে। মন না চাইলেও সব খুশির দিনের মতোই ফুরিয়ে আসে বেলা, বেথুনস্কুলের প্রাক্তনীছাত্রী হয়েও যোগ দিতে পারব এইদিন একটি বিশেষ ইভেন্টে জানা থাকলেও স্কুলের এই প্রিয় পোশাকের দিকে আর ওই কাপ-মেডেলের দিকে তাকিয়ে মনকেমনের দোটানা নিয়ে বাড়ির পথ ধরি। বুকের মধ্যে গুনগুন করি,‘বেথুন স্কুল -সে যে গো মোর’—শহর কলকাতায় ক্লাসরুমের পাশেই এমন সবুজমাঠের খেলাভরা আর কটি স্কুল আছে বলো তো!
সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি
প্রতি বছরের মতো এবছরও আমার বিদ্যালয়ে অর্থাৎ বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ১০ জানুয়ারি। নতুন বছরের শুরু থেকেই ছাত্রদের মধ্যে এই মহামিলনের দিনটিকে ঘিরে উদ্দীপনা শুরু হয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও ক্রীড়ার এই মহোৎসবে যোগদানকারী ছাত্রদের আরও উৎসাহী করার উদ্দেশ্যে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিলেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক ধরণীধর রায়চৌধুরী। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন ছাত্র তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন অতিরিক্ত মুখ্য সচিব প্রসাদরঞ্জন রায়। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় কুচকাওয়াজ, ক্রীড়া পতাকা উত্তোলন ও শপথবাক্য পাঠ করার মাধ্যমে। অভিভাবকগণ যাঁরা এই মহামিলনে অংশ নেন তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য দুটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দের জন্যও দুটি আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল। সব ছাত্রদের জন্য আয়োজিত হয়েছিল ‘যেমন খুশি সাজো’। অবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, পুরস্কার বিতরণ এবং পতাকা অবনমনের মাধ্যমে আমাদের এই মহাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটে। বিদ্যালয়ের এই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য আমি সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি। প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্বের দিনগুলি ও চূড়ান্ত পর্যায়ের দিনের উদ্দীপনা ও আনন্দের স্মৃতি আজীবন আমাদের মনে থেকে যাবে।
জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়
বিদ্যালয়জীবনের পড়াশুনা ও পরীক্ষার একঘেয়েমির মাঝে শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে উপস্থিত হয় বার্ষিক ক্রীড়া-প্রতিযোগিতা। বিগত কয়েক বছর ধরে কোনও ক্রীড়া শিক্ষিকা না থাকা সত্ত্বেও সব শিক্ষিকা প্রচেষ্টা ও আমাদের ছাত্রীদের অদম্য উৎসাহে প্রতিবছর সফলতার সঙ্গে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দলগত কুচকাওয়াজ ও শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে শুভ সূচনা ঘটে। শীতের দুপুরের অলসতা কাটিয়ে ওই একটা দিন ছাত্রীরা উৎসুক হয়ে উঠি—চারটি দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে। বছরের এই সময়টা বন্ধুত্ব ভুলে আমরা সবাই নিজেদের দলের প্রতি অনেকটা বেশি দায়িত্ববান, শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি। মূল পর্বের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকেই এই রেষারেষি শুরু হয়। কয়েকটা দিনের জন্য পড়াশুনায় খানিকটা ফাঁকি দিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে দলগত প্রতিযোগিতাতে সেরা দেওয়ার ‘স্ট্রাটেজি’ তৈরিতে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে কুচকাওয়াজের অনুশীলন। কারণ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সেরা দল প্রাপ্ত নম্বর থেকে বোঝা গেলেও কুচকাওয়াজে বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা হয় সবশেষে। নিজের দলকে শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করানোটাই হয়ে ওঠে ধ্যানজ্ঞান। এসবের মাঝে, একেবারেই ছোট ছোট বোনের ব্যাঙ দৌড়, লজেন্স দৌড় আমাদের আনন্দ দেয়। একইসঙ্গে উপভোগ করি আমাদের ভারসাম্য দৌড়, প্রতিবন্ধক দৌড়। আবার, যখন একক বিভাগে নিজের দলের না হয়ে নিজের শ্রেণীর কোনও বন্ধু জয়লাভ করে, দলকে না জেতাতে পারার দুঃখের মধ্যেও সহপাঠী হিসেবে বুক গর্বে ভরে ওঠে। কিন্তু, এই দলাদলিও শেষ হয়ে যায় বিভাগীয় রিলেতে। মাধ্যমিক বিভাগের চার দলের সেরা চার দৌড়বাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামে উচ্চমাধ্যমিক বিভাগকে হারানোর জন্য। আর
দল নয় তখন সবাই মিলে ‘চিয়ার আপ’ করে সব দলের জন্য। প্রতিযোগিতার নিয়ম মেনে কেউ জেতে কেউ বা হারে। অবশেষে কুচকাওয়াজের দ্বারা জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। নতুন করে শুরু হয় আগামী বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্বপ্ন দেখা। প্রতিবছরই এই কয়েকটা দিন আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী, শৃঙ্খলাপরায়ণ ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে যায়।
খেলা মানুষকে পরিশ্রমী ও সংযমী করে তোলে
আমি একজন আদিবাসী ছাত্র হিসেবে আমাদের বিদ্যালয়ের আবাসিক আশ্রমে থেকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। খেলাধুলোয় অংশ নিয়ে যে আত্মবিশ্বাস জন্মায়, তা দিয়ে আমি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সব প্রতিযোগিতা যেমন বিতর্ক, নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করি। এতে আমার পড়াশোনার মানও অনেক উন্নত হয়েছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পড়াশোনা ও খেলাধুলা সমান্তরাল ভাবে আমার রক্তে প্রবাহিত হতে থাকে। স্বাভাবিকভাবে বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমার অংশগ্রহণ, সাফল্যলাভ ও পুরস্কার প্রাপ্তি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৪০০ মিটার দৌড়, হাইজাম্প, লংজাম্প ইত্যাদি ইভেন্টগুলিতে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাকে খেলার প্রতি অনেকখানি আকর্ষিত করেছে। গতবছর ২৫ জানুয়ারি বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় পতাকা উত্তোলন করে শুভ সূচনা করেছিলেন প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার কবীর বোস ও আমাদের আশ্রম সম্পাদক স্বামী জয়ানন্দ মহারাজজি। খেলার নিয়মানুযায়ী উচ্চতা অনুসারে জুনিয়র, ইন্টারমিডিয়েট ও সিনিয়র তিনটি বিভাগ থাকে। প্রতি বিভাগে ৬টি ইভেন্টের মধ্যে একজন প্রতিযোগী সর্বোচ্চ ৩টিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। খেলা শেষে প্রধান অতিথি বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ও বিজিত প্রতিযোগীদের আগামী দিনে কঠিন লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করেন। আমি লংজাম্পে ব্যর্থ হলেও বাকি ২টি ইভেন্টে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটারে দৌড়ে প্রথমস্থান অধিকার করেছিলাম। খেলার প্রয়োজনীয়তা, শৃঙ্খলা, দক্ষতা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কতখানি জরুরি তা প্রধান অতিথির ভাষণ থেকে জানতে পেরেছিলাম। এত বছর ধরে খেলায় অংশগ্রহণ করে আমার মনে হয়েছে যে দক্ষতা ও লড়াই সাফল্যলাভের মূল চাবিকাঠি। নিয়মিত শরীর চর্চাই সুস্থ মন ও জীবনী শক্তির প্রধান রসদ। খেলা মানুষকে পরিশ্রমী ও সংযমী করে তোলে। অবশেষে বলতে পারি বিদ্যালয়ের ক্রীড়া আমাদের পরবর্তী জীবনে চলার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাজল রেসে প্রথম হয়েছিলাম
এমনিতে আমাদের স্কুলের নিজস্ব মাঠ নেই, খেলা বলতে টিফিনের সময় স্কুলের ক্লাস রুমের সামনে বারান্দায় অথবা সামনে ছোট্ট প্রাঙ্গণে। আর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ভরসা প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠ। ছেলেবেলায় প্রায় ছ’বছর বয়সে হিন্দু স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার এক বিশেষ ঘটনা আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘পাজ্ল রেস’ ইভেন্টের নিয়মানুযায়ী দৌড় শুরু করে কিছু দূরে বক্সে এলোমেলো পাজ্ল রেসকে সাজিয়ে, দৌড়ে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাতে হবে। আমার এই প্রিয় ইভেন্ট যথারীতি শুরু হল। তাড়াতাড়ি দৌড়ে পাজ্ল রেস-এর সামনে পৌঁছে একেবারে বসে পড়ে ধীর-স্থিরভাবে সাজানো শুরু করলাম, সবাই চিৎকার করছে ‘তাড়াতাড়ি সাজিয়ে দৌড়ো, দৌড়ো ...!’ তখন হুঁশ ফিরে পেয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম, দেখি আমার আগেই অনেকে পৌঁছে গেছে। বিষণ্ণ মনে মায়ের হাত ধরে মাঠ থেকে বেরচ্ছি ,তখন মাইকে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষিত হচ্ছে, ‘পাজ্ল রেস-এ প্রথম বিপ্রজিৎ পোদ্দার, দ্বিতীয়...’। মুহূর্তের জন্য মনে হল কী শুনছি, কোনও কথাই যেন কানে যাচ্ছে না, হতবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ! সেই বয়সে প্রথম ধীর-স্থিরতা ও বিচক্ষণতার পুরস্কার পেলাম,আজও জীবনে তা মেনে চলার চেষ্টা করি।