উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য, ব্যবসায় গোলোযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
রানাঘাট মহকুমার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাজদিয়ার পাবাখালি থেকে মাথাভাঙা নদী দু’ভাগে ভাগ হয়ে একটি চূর্ণী ও অপরটি ইছামতি নামে বয়ে গিয়েছে। মাজদিয়া থেকে এসে চূর্ণী নদী রানাঘাটের কাছে ভাগীরথী নদীতে মিশেছে। চূর্ণীর এই প্রবাহ পথের দূরত্ব প্রায় ৫৩ কিলোমিটার। যদিও ১৭৭৪ সালের রেনেলের ম্যাপে চূর্ণী নদীর উল্লেখ নেই। তবে জনশ্রুতি, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বর্গী আক্রমণ ঠেকাতে শিবনিবাস থেকে কৃষ্ণগঞ্জ পর্যন্ত একটি খাল কেটেছিলেন। পরবর্তীতে এই খালটিই চূর্ণী নদীর রূপ নেয়। যদিও ১৯১৬ সালে কলকাতা বন্দরের নদী পর্যবেক্ষক এইচজি রিক্সের রিপোর্টে এই নদীকে প্রাকৃতিক নদী রূপে বর্ণনা করা হয়।
একটা সময় এই চূর্ণী নদীতে চলাচল করত লঞ্চ, বড় নৌকা। রেল কোম্পানি পানীয় জল হিসেবে এই নদীর জল ব্যবহার করত। নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বর্তমানে দূষণের কারণে সেসব আজ অতীত। নদীতে পলি জমে চূর্ণী হারিয়েছে তার নাব্যতা। চূর্নীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় নদীর চেহারা বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। কোথাও এই নদী চেহারা নিয়েছে মাঠে, কোথাও আবার ব্রিজ তৈরির কারণে মুছে যাচ্ছে চূর্ণী নদী।
যদিও প্রবাহপথ পরিবর্তন হলেও এই নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার জনপদগুলি আজও ইতিহাসের সাক্ষী নীরবে বহন করে চলেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নদীর কথা তুলে ধরেছেন তাঁর দেবতার গ্রাস কবিতায়, ‘হেমন্তের প্রভাত শিশিরে/ ছল ছল করে গ্রাম/চূর্ণী নদীর তীরে।’ বর্তমানে রানাঘাট থানার আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের আনুলিয়া গ্রাম মধ্যযুগেও অবস্থিত ছিল। চূর্ণী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই গ্রামেই মেলে পালযুগের বিষ্ণুমূর্তির নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সংগীত শিক্ষাগুরু বিষ্ণু চক্রবর্তীও কায়েতপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। রানাঘাটের কলাইঘাটাতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন। চূর্ণী নদীর তীরে রানাঘাট শহরের পশ্চিম প্রান্তে রানাঘাটের এসডিও বাংলো অবস্থিত। কবি নবীনচন্দ্র সেন রানাঘাটের এসডিও থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চূর্ণী নদী পথে শিলাইদহ থেকে ফেরার সময় এসেছিলেন এই বাংলোতে। সেই হিসেবে প্রতি বছর ৪ সেপ্টেম্বর দুই কবির মিলন স্মরণে আজও রানাঘাটে এসডিও বাংলোতে প্রশাসনিকভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে কবি মিলন উৎসব। পাশাপাশি চূর্ণী নদীর তীরে মামজোয়ান এলাকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় উদ্বোধনে এসেছিলেন এই নদী পথেই।
চূর্ণী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদীকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর ঐতিহ্য বহন করে আজও হয়ে আসছে শিবনিবাসের মেলা, বগুলা শ্মশান মেলা, বীরনগরে ওলাইচণ্ডীর মেলা, আড়ংঘাটার যুগলকিশোর মেলা, রানাঘাটের বড়বাজারে রথের মেলা, আঁইশতলায় বাসন্তী পুজোর মেলা। অথচ ইতিহাস বিজড়িত চূর্ণী নদী আজ অবলুপ্তির পথে। অসংখ্য পঞ্চায়েত ও পুরসভার নিকাশি জল এসে মিশছে নদীতে। নদী সংস্কারও হয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশের চিনি কোম্পানির বর্জ্যপদার্থ যুক্ত জল এসে মিশেছে এই নদীতে। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে দেখা দিয়েছে সমস্যা। তারফলে শুধু দূষণ নয়, জেলার অর্থনীতির ওপরও বড় ধাক্কা নেমে এসেছে। (চলবে)