উকিল ও ডাক্তারদের কর্মব্যস্ততা বাড়বে। পত্নী/পতির স্বাস্থ্য আকস্মিক ভোগাতে পারে। মানসিক অস্থিরভাব। ... বিশদ
কিন্তু উপায় নেই। সে যেন কোথাও টিকে থাকতে পারছে না। এই কলকাতার একটা স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। চ্যারিটি স্কুল। তার পড়ায় মন বসেনি। এরপর তাকে একটা বোর্ডিং স্কুলে দেওয়া হল। সেটাও সেই বেনারস ছাড়িয়ে। অথচ সেখান থেকে একদিন পালিয়ে গেল জেমস। তবে বেশিদূর যেতে পারেনি। বাচ্চা ছেলে। কিছুই তো চেনে না। ১৭৭৮ সালে জেমস স্কিনারের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়।
নিজের নাম আর গাত্রবর্ণ নিয়ে তার অস্বস্তির শেষ নেই। একদিকে নাম জেমস স্কিনার। সবাই জানে সে সাহেব। আবার গাত্রবর্ণ এই ভারতীয়দের মতোই কালো। কারণটা অবশ্য জেমস বা তার ভাইবোনেরা জানে না তেমন নয়। কারণ হল তাদের মা। তাদের বাবা স্কটিশ সাহেব। আর মা ভারতীয়। এক রাজপুত নারী। নাম জেনি। কিন্তু তার সত্যিই কি জেনি নাম? আর বাবা? জেমস ঠিক নিশ্চিত না যে, ওই সাহেব সাহেব দেখতে লোকটাকে বাবা বলে ডাকা ঠিক হবে কি না।
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। জেমসের বাবা সেই হারকিউলিস স্কিনারের ভাগ্য বদলে গেল বেনারসের এক যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে। বেনারসের রাজা চৈত সিং মির্জাপুর না ভোজপুর কোথা থেকে কে জানে এক ১৪ বছরের মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিলেন। এসব রাজা-রাজড়ার দল কোথাও মৃগয়া কিংবা জমিদারির তদারকিতে গিয়ে পথে কিংবা ফসলের মাঠে অথবা গ্রাম্য মেলায় একটি অথবা একাধিক মেয়েকে দেখলে হঠাৎ করে কাউকে পছন্দ করে ফেলে। রাজবাড়িতে নিয়ে আসেন বন্দি করে। চৈত সিং ওই মেয়েকে নিয়ে এসে বেনারসে নিজের রাজবাড়িতেই বন্দি করে রেখেছিল। মেয়েটি কোনও নিম্নবর্গের নয়। ভোজপুরে জমিদার বাড়ির কন্যা। সেই সময় বেনারসেই ছিলেন হারকিউলিস।
ঘটনাচক্রে রাজা চৈত সিংয়ের এই নারীসঙ্গ অভ্যাসের কথা জানা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের। হারকিউলিস জানতে চাইছিলেন কিছু কিছু তথ্য। আরও বেশি জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে সব বন্দি মেয়েদের মুক্তি দেন চৈত সিং। কিন্তু এই পরোপকারের অর্থ নেই। কারণ হারকিউলিস বুঝতে পারলেন যে, তাও রাজবাড়ির বন্দিশালায় এরা ছিল, অন্তত খাওয়া পরা পাচ্ছিল। এবার কোথায় যাবে?
মেয়েটির নাক চোখ দেখে স্পষ্ট যে, সে খুব দৃঢ়চেতা। গায়ের রং কালো। ভোজপুর নামক একটি গঞ্জ এলাকা থেকে তাকে তুলে আনা হয়েছিল। কিন্তু সে আর ফিরতে চায় না। রাজপুত রমণীকে একবার ডাকাত অথবা লেঠেল কিংবা জমিদারের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী অপহরণ করে আনলে তার সামাজিক মৃত্যুই হয়। সে আর কখনও সমাজে ফিরতেই পারে না। যা হওয়ার তাই হল। হারকিউলিসই তাকে রেখে দিয়েছেন নিজের কাছে। ক্রমেই ওই রাজপুত মেয়ের গর্ভেই সাতটি সন্তান হল হারকিউলিসের। বিবাহ না হলেও আদতে মেয়েটিকে নিজের স্ত্রী হিসেবেই সম্মান দিতেন হারকিউলিস। তিনি নিজে স্কটিশ। সাত ছেলেমেয়েকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান।
জেমসের যখন ১২ বছর বয়স, ১৭৯০ সালে, দুই মেয়েকেও স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হারকিউলিস। জেনি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ রাজপুত বাড়িতে কোনও মেয়েকে ঘরের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানোর কথা ভাবাই যায় না। সেই মেয়ে আর রাজপুত থাকবে না। তার জাতধর্ম নষ্ট হবে। বিরক্ত হলেন হারকিউলিস। তিনি বলেছিলেন, তুই কি চাস তোর মতোই এভাবে কোনও এক জমিদার এসে আমাদের মেয়েকেও অপহরণ করে নিয়ে যাক? ওরা আর রাজপুত নেই। ওরা এখন স্কটিশ। ওরা স্কুলে যাবে। হারকিউলিস ভাবতেই পারেননি যে, এরপর কী হতে পারে? জেনি যতই হারকিউলিসকে স্বামী হিসেবে মেনে নিক, মনে মনে তিনি এখনও রাজপুত। কিন্তু তাঁর কথা যখন স্বামী শুনলেনই না, অর্থাৎ মেয়েদের স্কুলে পাঠালেনই, জেনি চরম পথ বেছে নিলেন। আত্মহত্যা করলেন।
জেমসের জীবন কোন খাতে বইবে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনায় তার স্থান হবে না? না হবে না। কারণ সে তো পুরোপুরি ইংরাজ নয়। কিন্তু কলকাতার এই প্রিন্টারের কাছে আর কাজ করতে ভালো লাগে না। অতএব জেমসকে পিতা পাঠালেন মারাঠা আর্মি কমান্ডার দ্য বয়েনের কাছে। ফ্রেঞ্চ কমান্ডার দ্য বয়েন অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে যান যে, এই ছেলেটির মধ্যে অসামান্য দক্ষতা আছে। তাই ক্রমেই মারাঠা আর্মির এক বিশ্বস্ত সেনাপতি হয়ে উঠল জেমস।
মারাঠাদের প্রভু সিন্ধিয়া রাজপরিবারের প্রতি সেবামূলক মনোভাব নিয়ে বেশ ভালোই দিনযাপন হচ্ছে। সমস্যা হল, মারাঠাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনার যুদ্ধ শুরু হলে। মারাঠাদের বাহিনীতে কোনও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে রাখা হবে না স্থির হল। কেন? কারণ তাদের তো বাবা ইংরেজ অথবা স্কটিশ। অতএব তারা যে মারাঠাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কে বলল?
অতঃপর? জেমস এতদিন পর নিজের দক্ষতার জোরেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে চাকরি পেল। আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ১৮০৩ সালে জেমস স্কিনার একটি আশ্চর্য কাজ করলেন। তিনি নিজের একক একটি বাহিনী গড়ে তুললেন। তার নাম হল স্কিনার্স হর্স। খুব প্রয়োজনের সময় ব্রিটিশ আর্মির হয়ে এই বাহিনী লড়াই করবে। স্পেশাল ফোর্স। সবথেকে বিস্ময়কর হল, স্কিনার্স হর্স বাহিনী আজও স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীতে আছে।
রাজস্থানের টঙ্কের যুদ্ধে গুলি লেগেছে জেমস স্কিনারের। সব সঙ্গীরা মৃত। নিশ্চয়ই জেমসও মৃত? এরকমই ভেবে শত্রুপক্ষ রাজপুতানার বাহিনী চলে গিয়েছে রণাঙ্গন ছেড়ে। কিন্তু একদিন...দু’দিন...তিনদিন...। জেমসের মাথার উপর শকুন উড়ছে। তিনি বুঝতে পারছেন। যে কোনও সময় তারা নেমে আসবে। অস্ফুটে নিজেই নিজেকে বললেন, যদি বেঁচে যাই, আমি এক মহান পবিত্র গির্জা নির্মাণ করব। যেখানে শান্তি বিরাজ করবে।
গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু জল কি পাওয়া যাবে না? রাজস্থানের এই রাজ্যে কে দেবে জল? কিন্তু ঠোঁট ভিজছে। কেউ যেন জল দিচ্ছে। কে এল? একটি মেয়ে না? কে মেয়েটি? স্বপ্ন নয়তো? জেমস স্কিনার ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। এক আদিবাসী মেয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
এহেন জেমস স্কিনার তারপর ফিরলেন বটে আবার সেনাবাহিনীর কাজে। কিন্তু তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা। ১৮৩৬ সালে নিজের আয় থেকে ৯৫ হাজার টাকা অর্থ প্রদান করলেন। একটি জমি পাওয়া গিয়েছে। সেখানেই গড়ে উঠবে গির্জা। এই জমিটি কার ছিল? সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহের। অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল দারা শিকোহের জমি একসময় হাতবদল হতে হতে এল জেমস স্কিনারের কাছে। আর সেখানেই গড়ে উঠেছে দিল্লির প্রাচীনতম চার্চ। কাশ্মীরি গেটের কাছে ওই যে ইতিহাসের আশ্চর্য কাহিনি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেন্ট জেমস চার্চ!