কর্ম, বিদ্যা ক্ষেত্রে উন্নতির যোগ। আয় ব্যয় ক্ষেত্রে সমতার অভাব। স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও আঘাতযোগ থাকায় ... বিশদ
অন্ধকার রাত কিংবা খাঁ খাঁ দুপুর। সর্বত্র পথ নেই। তেপান্তরের মতো মাঠ পেরতে হয়। চারদিকে আরাবল্লী পর্বতশ্রেণির টিলার সারি। বিত্তবান হলে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াতের সামর্থ্য আছে। নয়তো হাঁটাই ভরসা। হঠাৎ হঠাৎ গাছের সারি। ভ্রম হয় যেন জঙ্গল শুরু হল। আসলে জঙ্গল নয়। বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে যদি দুপুর হয়। রাখা আছে জলের জালা। এই ধু ধু প্রান্তরে এভাবে জালা ভর্তি জল কেন? কে রাখল? এ নিশ্চয়ই কোনও দয়ালু গ্রাম। সুতরাং থামা যেতেই পারে এসব বৃক্ষচ্ছায়ায়।
সবেমাত্র কয়েক আঁজলা জল খাওয়া হয়েছে, আচমকা যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। জল নামছে না। মুখ আর গলার সংযোগস্থলের অভ্যন্তরে জল আটকে। কারণ গলায় পিছন থেকে কিছু চেপে বসছে। শক্ত হচ্ছে ফাঁস। খাদ্যনালীতে জল ভর্তি অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একসময় নিস্তেজ হয়ে মৃত্যু। হামলা করেছে ঠগিবাহিনী। উদ্দেশ্য পথিকের ধনলুণ্ঠন। এই ছিল চতুর্দশ শতক পর্যন্ত দিল্লির
বহু অংশ। ঠগিদের কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না বলে জানা যায়। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, এই ঠগিদের মধ্যে ছিল হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষই। আর সুন্দরবনের বনবিবি, দক্ষিণরায়ের মতোই একই দেবদেবীর আরাধনা করে ডাকাতিতে নামত ঠগিরা। দিল্লি নামক নগরের দক্ষিণে অবস্থিত একটি মন্দির ছিল সেই আরাধনাস্থল। কালকা মন্দির। যে আরাধ্যা দেবীকে বলা হয় কালকাজি। একদিকে বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্ক। অন্যদিকে অভিজাত ইস্ট অব কৈলাস। তারই মধ্যবর্তী অংশে বিখ্যাত কালকাজি মন্দির। মন্দিরের নামেই সংলগ্ন জনপদের নাম কালকাজি।
ঠগিবাহিনী এই কালকাজি মন্দিরে পুজো দিয়ে, আরাধনা করে এবং নব্য সদস্যদের এখানেই শরীরের এক বিন্দু রক্ত উপহার দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করানোর পর নামত পরবর্তী অভিযানে। প্রত্যেকের কাছে থাকত সেই আতঙ্কের লাল রুমাল। যা পেঁচিয়ে আক্রান্তকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতো। সেই লাল রুমাল কালকা মাতার পায়ে স্পর্শ করানো হতো। ঠগিদের আক্রমণ ও হত্যা পদ্ধতি ছিল দেশজুড়ে নানাবিধ। বহু বছর পর ঊনবিংশ শতকে এসে উইলিয়ম হেনরি স্লিম্যান নামে এক ব্রিটিশ সেনা অফিসার ঠগিদের কীভাবে শায়েস্তা করেছিলেন, সে এক অন্য রুদ্ধশ্বাস গল্প। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে আতঙ্ক নগরীতে রাজত্ব করে ঠগিরা। দিল্লির ঠগিদের একবার বাগে এনেছিলেন শের শাহ সুরি। প্রায় ১ হাজার ২০০ ঠগিকে সেনাবাহিনীতে কাজ দিয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্বিষহ এক যাত্রাপথ থেকে সুরাহা দিয়েছিলেন শের শাহ। ঠগিদের সেই আচার উপচার কিন্তু রয়ে গেল। অর্থাৎ কালকাজি মন্দিরে পুজো দিতে হবে রক্তবর্ণ উপকরণে। তাই লালের আরাধনায় চারপাশ রক্তিম হয়ে যায় বছরের দুই মরশুম। চৈত্রমেলা এবং শ্রাবণীমেলা। নবরাত্রি তো আছেই। আরাবল্লী পাহাড় শ্রেণির অন্তর্গত থাকা সূর্যকূট পর্বতের উপরে স্থাপিত কালকা দেবী। তাই তাঁর অন্য নাম সূর্যকূটা!
খুব বেশি হলে ৫০ বছর আগের ঘটনা। বাংলা থেকে আসা বৈজল সন্ন্যাসীর পা কেটে বাদ দিতে হবে। পায়ের সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আর অন্য চিকিৎসার উপায় নেই। শেষ ভরসা বৈদ্যনাথধাম। অতএব বৈজল গেলেন দেওঘর। বাবা বৈদ্যনাথের কাছে ধর্না দিলেন। দিলেন হত্যে। দণ্ডী কাটলেন। আর বাবা বিশ্বনাথের মূর্তি তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে বললেন, এই কাজ আমার সাধ্য নয়। পারবেন আদিশক্তি পার্বতী। যেতে হবে সেখানেই। কালকা মন্দিরে।
কালকা মন্দির? সে কোথায়? সেকথা স্বপ্নাদেশে জানা গেল না। বৈজল সন্ন্যাসী গৃহস্থ মানুষ। তিনি সাধু নন। কিন্তু দেওঘর থেকে কালীঘাট এলেন। জানতে চাইলেন কোথায় কালকা মন্দির? কেউ বলতে পারছে না। তারাপীঠে পেলেন তন্ত্রসাধকের দেখা। তিনি বললেন, দিল্লি যেতে হবে। বৈজল দিল্লি এসে কালকা মন্দিরে তিনদিন ধরে ছ’বার দিলেন পুজো। আর সেই পচে যাওয়া, গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়া পা নাকি সেরেও গেল! ফিরলেন না তিনি আর কলকাতা। থেকে গেলেন। সন্ন্যাস নিয়ে কালকাজির সেবা ও মহিমা প্রচার করলেন। নতুন নাম হল লালবাবা! আজও কালকাজি মন্দিরে লালবাবার মহিমা প্রাপ্তি এক বিশেষ চর্চা। কত পুরনো কালকা মন্দির? পুরোহিত অথবা বিশ্বাসীরা বলবেন অন্তত ৩ হাজার বছরের প্রাচীন। এই তো কাছেই কুরুক্ষেত্র। ওই তো অনতিদূরে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী। মহাভারতের যুদ্ধকালে কালকা দেবীর কাছে এসেছিলেন অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ। বহু দেবদেবীর আশীর্বাদের পাশাপাশি তৃতীয় পাণ্ডব পেয়েছিলেন কালকা দেবীর বরাভয়।
আর ইতিহাস বলছে, মূল মন্দির আওরঙ্গজেব ধ্বংস করেছিলেন। ৮০ বছরের মধ্যে আবার ষোড়শ শতকে মারাঠা বাহিনী এসে পুনরায় কালকা মন্দির পুনর্নির্মাণ করে গিয়েছে। আজ সেই মন্দিরেই অধিষ্ঠিতা দেবী কালকা। দেবী পার্বতীর অন্যতম রূপ। অসুরদলনী। বছরের যেকোনও সময় কেন এই মন্দিরের অভ্যন্তর এত উষ্ণ? রহস্য। মহম্মদ ঘোরীর আক্রমণের সময় চৌহান রাজ্যের যখন পতন ঘটছে, তখন জহরব্রত করে আত্মহত্যা করেন চৌহান পত্নীরা! সেই পবিত্র আত্মবলিদানের আগুনের আঁচ কি এখনও নিভতে দেননি কালকা দেবী?