সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
ভূপেন্দ্রনাথ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন এক সদাশয় সহকারী জেলার তাঁকে গোপনে পরামর্শ দেন বিদেশে পালিয়ে যেতে। কারণ তা না হলে আলিপুর বোমার মামলায় তাঁর জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। জেল থেকে বেরিয়েই তিনি দেখা করতে যান বিপ্লবী নেতা হরিদাস হালদারের সঙ্গে। তিনিও ভূপেন্দ্রনাথকে বলেন— সেদিনই কলকাতা ছেড়ে কোনও বিদেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে। বহুকাল পর বিদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি বন্ধু ব্যারিস্টার সুরেন্দ্রনাথ হালদারের কাছে শোনেন, আলিপুর মামলায় তাঁকে জড়িত করবার জন্য স্থায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।
যুগান্তর-মামলায় বন্দিদশার পরে বাড়ি ফিরে এলে তাঁর মধ্যমাগ্রজ মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে বলেন— গোপনে আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে। মহেন্দ্রনাথ এ-ও জানান এই পরিকল্পনা ও পরামর্শ দিয়েছেন বিবেকানন্দের আমেরিকান শিষ্যা ভগিনী ক্রিস্টিন গ্রিনস্টিডেল।
এ সম্বন্ধে স্বয়ং ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘স্নেহশীলা মাতার অর্থানুকূল্যে আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই কলকাতা ত্যাগ করি এবং তিন-চার দিন পর সমুদ্রপথে ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমাই। ইতিমধ্যে পুলিশ বেলুড় মঠে খানাতল্লাসী করে কারণ তারা মনে করেছিল যে, আমি সম্ভবত ছদ্মবেশে সেখানে আত্মগোপন করে আছি। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে আমি যখন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ক্লাসের ছাত্র তখন স্বপ্ন দেখলাম যে, আমার মা মারা গেছেন। আমি তখন মিসেস এডিথ সৌননদার অতিথিরূপে বাস করছি। স্বামীজী ও আমি তাঁকে মা বলে ডাকতাম। পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে এই স্বপ্নের কথা বলায় সেই বৃদ্ধা মহিলা হেসেই তা উড়িয়ে দিলেন। এক মাস পর কলকাতা নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে লন্ডনে মিস ম্যাকলাউডের কাছে লেখা ভগ্নী নিবেদিতার এক চিঠিতে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেলাম। চিঠিটা লেখা হয়েছিল ২৫ জুলাই। লন্ডন থেকে মিস ম্যাকলাউড আমার কাছে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন। মৃত্যুর দিন সম্পূর্ণ মিলে যায়! স্বপ্নের দিনের তারিখটা এখন বিস্মৃত হয়েছি। দু-দু’বার আমার দেখা স্বপ্ন বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়। এর রহস্য মনস্তত্ত্ববিদরাই উদ্ঘাটন করতে পারবেন।’
ভূপেন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে জেলে যাওয়ার পূর্বে তাঁর কাছে নিবেদিতা বিশ্লেষণ করেছিলেন রুশ বৈপ্লবিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। সেই সময় পিটার ক্রোপোটকিন রচিত ‘Career of Revolutionist in Russian and French Prisons’ ও মাৎসিনির রচনাবলির পাঁচ খণ্ড গ্রন্থ নিবেদিতা উপহার দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথকে। নিবেদিতা ও মিসেস ওলিবুল ছিলেন ক্রোপোটকিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিসেস বুলের মারফতই ক্রোপোটকিন ১৯১০ সালে ভারতীয় বিপ্লবীদের কাছে পাঠান এক সতর্কবার্তা। সে-বাণীতে তিনি ভারতীয় বিপ্লবীদের জানিয়েছিলেন, ১৯০৫ সালে বিপ্লবের ব্যর্থতার পর রুশ বিপ্লবীদের দুর্দশা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে।
বিবেকানন্দের ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ ক্রমশ নিবেদিতার স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন। শুরুতে ভূপেন্দ্রনাথের চরিত্রে ছিল এক ধরনের উগ্রতা, কর্কশতা— ভুবনবিখ্যাত বিবেকানন্দের গৌরবের আলোকে আলোকিত হতে আত্মমর্যাদায় বাধত। ভূপেন্দ্রনাথের এই ধরনের আত্মাভিমানে বিরক্ত হতেন নিবেদিতা। কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ভূপেন্দ্রনাথের দেশভাবনায় বীরত্বব্যঞ্জক এক নবরূপের পরিচয়ে গৌরব বোধ করেন নিবেদিতা।
১৯০৭ সালের ২০ জুলাই নিবেদিতা এক চিঠিতে মিসেস বুলকে লেখেন— ‘স্বামীজীর সর্বকনিষ্ঠ ভাই, যাকে তুমি স্মরণ করতে পারবে, সে এখন রাজদ্রোহাত্মক লেখা প্রকাশের জন্য বিচারাধীন। সে একটু আগেই আমাদের বলছিল, কীভাবে জাতীয়তার ভাব সারা দেশের চেহারা বদলে দিয়েছে। কতসব খারাপ ছোকরা, আগে যারা রাস্তার লোফার ছাড়া আর কিছু ছিল না— তারা এখন চমৎকার ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার। ... ৬ মাস থেকে ৩ বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত ভূপেনের জেল হতে পারে। কী চমৎকার সাহসী সে, কারাবাস নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করছে। তবে এ কথাও বলছে, ও-ব্যাপারটা ভদ্রলোকের পক্ষে মনোরম নয়; আর জানেনই তো আমি অহংকারী দত্তবংশের ছেলে। ঠিক একেবারে স্বামীজীর মতো!’
রাজদ্বারে বিচারের সময় কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে থাকলেও নিবেদিতা কীভাবে তাঁর সহায় হয়েছিলেন সে-সম্বন্ধে ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজদ্রোহের অভিযোগে আমার বিচারের কালে ভগিনী নিবেদিতা আমার মামলায় বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। আদালতের দাবি অনুযায়ী তিনি আমার জন্য কুড়ি হাজার টাকা জামিনের প্রতিভূ হিসাবে দাঁড়াতে সম্মত হয়েছিলেন। অবশ্য তাঁকে দাঁড়াতে হয়নি, অন্যেরাই জামিনের প্রতিভূ দাঁড়িয়েছিলেন। আমার মাসতুতো ভাই চারুচন্দ্র মিত্র ও ডাঃ প্রাণকৃষ্ণ আচার্য প্রত্যেকে পাঁচ হাজার টাকা করে জামিনের প্রতিভূ হয়েছিলেন। আদালত শেষে দশ হাজার টাকা চেয়েছিল। তবুও তৎকালীন বৃটিশস্বার্থের মুখপত্র ইংলিশম্যান ভগিনী নিবেদিতাকে জাতির প্রতি বিশ্বাসহন্ত্রী রূপে নিন্দা করেছিলেন।’
ভারতে নিবেদিতার কাজকর্ম ও বক্তৃতায় ক্রমশ ঘণীভূত হয় ব্রিটিশ-ভারতের পুলিসের সন্দেহ। একবার বাংলা সরকারের কুখ্যাত অফিসার কার্লাইল কায়দা করে সুবিখ্যাত ভূপেন্দ্রনাথ বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন— নিবেদিতা আয়ারল্যান্ডের ফেনিয়ান দলভুক্ত ছিলেন কি না।
একবার নিবেদিতার ‘গতিশীল ধর্ম’ বক্তৃতা শুনে বিপিনচন্দ্র পাল বলে ওঠেন— ‘এটা গতিশীল ধর্ম নয়, ডিনামইট।’
ভারত সম্পর্কে তাঁর চিন্তাদর্শ যে স্বামী বিবেকানন্দেরই অনুরূপ তা বোঝাতে গিয়ে নিবেদিতা একদিন ভূপেন্দ্রনাথকে বলেন— ‘ভূপেন, তুমি কি মনে করো যে, ভারত ভ্রমণকারী প্রতিটি আমেরিকান বা ইউরোপীয় পর্যটক ভারতীয় জীবন ব্যাখ্যা করবার জন্য আমার মতো আর একজন বিবেকানন্দকে পাবেন।’ কারামুক্তির পর দেশত্যাগের পূর্বে গোপনে ভূপেন্দ্রনাথ বিদায় নিতে যান নিবেদিতার কাছে। অনুরোধ জানান, তাঁর অনুপস্থিতিতে মায়ের দেখাশোনা করতে। নিবেদিতা আশ্বস্ত করেন তাঁকে।
এরপরে ভুবনেশ্বরী দেবীর কাছে গেলেই নিবেদিতা বলতেন— ‘ভূপেন আপনাকে দেখবার জন্য বলে গেছে।’
ভূপেন্দ্রনাথের মামলা সূত্রে ইংরেজ সরকারের সরাসরি রোষদৃষ্টির লক্ষ্য হন নিবেদিতা।
মণি বাগচী ‘নিবেদিতা’ শীর্ষক গ্রন্থে জানিয়েছেন— ‘পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি এইবার গিয়া পড়িল নিবেদিতার উপর। গ্রেপ্তার অথবা নির্বাসন— যে-কোন মুহূর্তে সম্ভব। গভর্নমেন্টের নিকট নিবেদিতার কার্যকলাপ কিছুই অবিদিত ছিল না।
সেই সময় অরবিন্দ একদিন কথা প্রসঙ্গে নিবেদিতাকে বলেন, গ্রেপ্তার আপনাকেও তো করতে পারে?
নিবেদিতা হাসেন, বললেন, গায়ের চামড়ার রংটাই যে এর অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইরিশ বিপ্লবের কোলে মানুষ হয়েছি— কারাগার বা নির্বাসনের আমার ভয় আছে মনে করেন? এই যে কলেজ স্ট্রিটে আপনার এই বাসায় কত লোক আসতে ভয় পায়, আর আমি কেমন স্বচ্ছন্দে দু’বেলা আসছি যাচ্ছি— পুলিশ কি দেখতে পায় না মনে করেন? উত্তরে অরবিন্দ বললেন, নিশ্চয়ই দেখতে পায় আর সেই সঙ্গে তারা এটাও দেখতে পায়— আপনি একজন মেমসাহেব, অ্যানার্কিস্ট নন।’
১৯০৯ সালে নিউইয়র্কে ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে ফের দেখা নিবেদিতার। সেই সময় এক আলোচনায় নিবেদিতা চিন্তিতস্বরে ভূপেন্দ্রনাথকে বলেন ‘ফাঁসির দড়ি পশ্চাদ্ধাবন করলেও অরবিন্দ সে ভয়ে ভীত নয়।’
অরবিন্দকে কেন তিনি ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করতে পরামর্শ দেন,— সে কথাও খুলে বলেন ভূপেন্দ্রনাথকে।
নিবেদিতার শুভানুধ্যায়ী, ভারত-দরদি বন্ধুপ্রতিম সাংবাদিক এস কে র্যাটক্লিফ স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক ছিলেন কয়েক বছর। র্যাটক্লিফের এক কন্যার গড-মাদারও হয়েছিলেন নিবেদিতা। তাঁর সম্বন্ধে র্যাটক্লিফ বলতেন, ‘যে সব নরনারীকে জানবার সুযোগ পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে সিস্টার নিবেদিতার মতো এত প্রাণবন্ত আর কাউকে দেখিনি।’
সুদীর্ঘ দু’বছর পাশ্চাত্যে অবস্থানের পর নিবেদিতা কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে। ২১ জুলাই আত্মগোপন অবস্থায় ১৭নং বোসপাড়া লেনের বাড়ি থেকে নিবেদিতা এক চিঠিতে অরবিন্দ সম্বন্ধে র্যাটক্লিফকে জানান— ‘আমাকে যদি চিঠি লেখো কখনও আমার নামোল্লেখ করো না। কারণ আমি এখন আছি ছদ্মপরিচয়ে এবং যতদিন সম্ভব অনেকের কাছে তেমনিভাবেই থাকব। বন্দেমাতরম-এর জায়গায় কর্মযোগিন একটা নতুন কাগজ বেরিয়েছে। অরবিন্দ অনেক বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন— আমার মনে হয়, সেটা বুদ্ধির কাজ হচ্ছে না। তবে তিনি নিজেকে ঈশ্বরচালিত মনে করেছেন সুতরাং গ্রেপ্তার হবেন না! অনেক সময় আমরা অনেকেই অবশ্য অদ্ভুত-অদ্ভুত কাজ করি— কেন করি— তা শুধু আমরাই জানি। আমরা কিছুরই পরোয়া করি না। কিন্তু ঈশ্বর অবশ্যই কাউকে ক্ষয়ক্ষতি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেননি।’
নিবেদিতা ১৯১১ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে আবার আমেরিকায় গেলে, দেখা হয় ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে। ব্রুকলিনে একদিন তিনি তাঁর প্রিয় থিয়োরি ব্যাখ্যা করে শোনাতে গিয়ে বলছিলেন, অ্যাসিরিয়ার রাজা আসুর-বান-ই- পাল হলেন পুরাণ-কথিত বাণাসুর।
নিবেদিতার এমনতর অনুমান হজম করতে পারেননি ভূপেন্দ্রনাথ। এতে ক্রুদ্ধভাবে নিবেদিতা বলে ওঠেন ‘ভূপেন, যখন আমি ফাঁসি যাব, তারপরেই তুমি আমার কথা মানবে।’
ভূপেন্দ্রনাথও তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন— ‘আপনাকে কখনও ফাঁসিতে ঝুলতে হবে না।’
নিবেদিতা বললেন ‘কেন?’
ভূপেন্দ্রনাথ শান্তস্বরে বলেন ‘আপনার চামড়ার রংই আপনাকে বাঁচাবে।’
নিবেদিতা যেন মুষড়ে-পড়া বিমর্ষতায় ঈষৎ মাথা নেড়ে বললেন ‘সে কথা সত্য।’ এ সম্বন্ধে আর কোনও কথা এগয়নি।
সে-বছরই সিস্টার ক্রিস্টিন নিউইয়র্ক থেকে জাহাজে রওনা হলেন ভারত-উদ্দেশে। তাঁকে জাহাজঘাটায় বিদায় জানিয়ে ফিরছিলেন নিবেদিতা ও ভূপেন্দ্রনাথ। হঠাৎ একটি ট্যাক্সিকে প্রবলবেগে তাঁদের দিকে আসতে দেখে এক ভারতীয় সঙ্গী ভয়ার্তকণ্ঠে ভূপেন্দ্রনাথকে বলেন,— দ্রুত ফুটপাতে উঠে পড়ো। ভূপেন্দ্রনাথ শান্ত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করে বললেন, আরে ভয় নেই, এটা আমেরিকা, এখানে জীবন ভারতের মতো সস্তা নয়।
সে কথা শুনে নিবেদিতা হাসতে হাসতে বলেন, এ কথা ঠিক। তারপর নিবেদিতা বাগবাজারের রাস্তায় খ্যাপা ষাঁড় তেড়ে এলে কীভাবে এক বাঙালি সাহিত্যিক সকলকে ছেড়ে পলায়ন করেছিলেন, সে কথা বর্ণনা করার পরে বলেন, আনন্দের কথা— ভূপেন্দ্রনাথ ওই আচরণ করেননি।
শাসক ইংরেজ জাতির প্রতি নিবেদিতার বিরাগ প্রকাশ পেত নানাভাবে। কোনও ইংরেজের প্রভুত্বসূচক দম্ভপূর্ণ ব্যবহার বরদাস্ত করতেন না কখনও। শ্বেতাঙ্গী বলে কেউ আত্মীয়তা করতে এলে বিরক্ত হতেন।
একদিন ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এ দেশের এক প্রবীণ ব্যক্তির মূল্যবান ঐতিহাসিক গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। শুনে নিবেদিতা বেদনাহত স্বরে বলে ওঠেন— ‘ঐ ব্যক্তির কথা আর বলবেন না, উনি ইংরেজের স্তাবক।’
স্বল্পায়ু নিবেদিতা বলতেন, ‘যুবক ভারত স্বাধীনতার মাঠে দৌড়ের জন্য তৈরি হচ্ছে মাত্র। এখনও দৌড় শুরু করেনি।’ এমনি সময় তাঁকে দেখেছিলেন বিনয় সরকার, লিখেছেন— ‘আইরিশ বেটি, ইংরেজী বলে ভালো। তাছাড়া স্বাদেশিকতার ঝাঁঝ তো আছেই... মনে হয়েছিল, বিদেশিনী হয়েও নিবেদিতা ষোলআনা ভারতীয় স্বার্থের প্রতিনিধি। ...প্রেসিডেন্সি কলেজে গোটা কয়েক সাদা অধ্যাপক ছাড়া আর কোনও সাদা লোকের সংস্পর্শে তখনও আসিনি। নিবেদিতা প্রথম সাদা লোক যার কথায় ভারতীয় স্বাধীনতার অকপট বাণী শুনতে পেলাম। অধিকন্তু বুখনিগুলো বেশ জোরালো ও ঝাঁঝালো। মনে হয়েছিল, তাঁকে ভগ্নী বলা যেতে পারে। ...তিনি যুবক ভারতকে স্বদেশনিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। স্বদেশসেবকের কাজে যে লোকটা কাঠখড় জোগাতে পারে না যুবক বাংলা তাকে বড় একটা পুছে না।’
পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে নিবেদিতার সঠিক ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক যেন থামবার নয়। কিছু বিষয় এখনও অধরা, অমীমাংসিতও অনেক প্রশ্ন। ‘শ্রীঅরবিন্দ ও বাংলায় স্বদেশীযুগ’ গ্রন্থে গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী লিখেছেন ‘নিবেদিতার দৃষ্টিভঙ্গী শুধু বৈপ্লবিক নহে, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসিবার পূর্বেই অতি মারাত্মক রকমের বিপ্লববাদী, বিপ্লবকর্মী ছিলেন। আমরা শুনিয়াছি তিনি Nihilist of the worst type ছিলেন। যা ছিলেন আবার স্বামিজীর দেহত্যাগের পর তাহাই হইলেন। ভগিনী নিবেদিতার পক্ষে বিপ্লবী হওয়া নূতন কিছুই নয়। ... আরো শুনিয়াছি, এই সময় ব্যারিস্টার সুরেন্দ্রনাথ হালদারের চেষ্টায় পি মিত্র ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহিত তাঁহার নিভৃতে কথোপকথন হইয়াছিল। অরবিন্দের সহিত বরোদায় প্রথম সাক্ষাতের পর তিনি ১৯০৩ জানুয়ারী মাসে কলিকাতায় ফিরিয়া অরবিন্দ-প্রবর্তিত গুপ্ত সমিতির প্রথমপর্বে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন।’
আবার এ সম্বন্ধে খানিকটা ভিন্ন মত শোনা যায় প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণার বক্তব্যে— ‘শ্রীঅরবিন্দের সহিত নিবেদিতার যোগাযোগ লইয়া অনেক কাহিনীর সূত্রপাত হইয়াছে; এবং প্রধানতঃ উহারই উপর ভিত্তি করিয়া প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইয়াছে যে নিবেদিতাই বৈপ্লবিক আন্দোলনের নেত্রী। শ্রীঅরবিন্দের সহিত নিবেদিতার কতখানি যোগ ছিল, তাঁহার কার্যে নিবেদিতার সহযোগিতা কতদূর বিস্তৃত ছিল, এ সকল তথ্য অনুমান ব্যতীত অন্য উপায়ে প্রমাণের কোন উপায় নাই। ফলতঃ উভয় পক্ষকেই শ্রীঅরবিন্দ প্রদত্ত ক্ষুদ্র বিবরণ, নিবেদিতার নিজের লেখা, অন্যান্য পুস্তক হইতে সংগৃহীত পারিপার্শ্বিক ঘটনা এবং নিবেদিতার পরিচিত সমসাময়িক ব্যক্তিগণের নিকট অনুসন্ধানপূর্বক যাহা জানা গিয়াছে, তাহার উপর নির্ভর করিয়াই নিবেদিতার বৈপ্লবিক কার্যধারা সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে।’
প্রয়াণের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে আমেরিকায় একদিন নিবেদিতা মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শুভানুধ্যায়িনী মিস ফিলিপস্-এর বাসভবনে। সেখানে আমন্ত্রিত ভূপেন্দ্রনাথও। ভোজনান্তে কথাবার্তার সময়ে নিবেদিতা বলেন, ‘ভূপেন, আমি তোমাকে উৎসর্গীকৃত বলে মনে করি। তুমি বিয়ে করো না।’
পেট্রিয়ট প্রফেট গ্রন্থে ভূপেন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘‘ফাঁসির দড়ি অরবিন্দের পশ্চাদ্ধাবন করছে’ এবং ‘ভূপেন, তুমি উসর্গীকৃত’— তাঁর এই কথাগুলি গূঢ় তাৎপর্য কেবল বিপ্লবীরাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। এ হল একজন বিপ্লবীর উদ্দেশ্যে আর এক বিপ্লবীর উক্তি। এর তাৎপর্য আমরা উভয়েই জানতাম।’ (চলবে)