সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
সারাজীবন অবিশ্বাস্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলেছেন তিনি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরেও যেভাবে বারংবার পাঞ্জা কষেছেন মৃত্যুর সঙ্গে— তাতে মনে আসে রবীন্দ্র-আপ্তবাক্য ‘...গল্পই লোকের বিশ্বাস কাড়িবার জন্য সাবধান হইয়া চলে, সত্যের সে দায় নাই বলিয়া সত্য অদ্ভুত হইতে ভয় করে না।’
বারীন্দ্রকুমার কখনও জেলের নির্জন কুঠরির মধ্যে থেকে, কখনও আন্দামানের নিষ্ঠুর কশাঘাতের জ্বালা সয়ে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন ক্ষুধা, প্রাণান্ত পরিশ্রমের দুর্বিষহ যন্ত্রণায়। অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত উল্লাসকর দত্ত পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বারীন ঘোষ পাগল হননি, মুক্তি পাবার পর ঠিক স্মরণ করতে পারেন সেই বিশেষ দিনটির অদ্ভুত দৃশ্যের স্মৃতি— যে সম্বন্ধে আত্মকথায় লেখেন— ‘হঠাৎ একটা দুয়ার ঠেলিয়া দেখি তিনি (লেলে) চক্ষু মুদিয়া মৃতের মতো পড়িয়া আছেন আর তাঁহার একজন মারাঠি শিষ্য তাঁহার পায়ের উপর পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে। তখন অন্তর্জগতের ব্যাপার কিই বা বুঝি, তবু একটা ভয়ে শ্রদ্ধায় সসম্ভ্রমে দুয়ার নিঃশব্দে বন্ধ করিয়া সরিয়া গেলাম। আজ ইহার অর্থ বুঝি, এই অপূর্ব সাধক তাঁহার আত্মসমর্পিত ভক্তি আকর্ষণ করিয়া আপন সাধন বল ওই তরুণ হৃদয়ে সঞ্চার করিতেছিলেন; আজ বুঝি তাঁহার নিজে গুরু হইবার লালসা বলিয়া যাহা মনে করিতাম, তাহা পিপাসুর অন্তর দুয়ার খুলিবারই কৌশল। অতবড় অকপট নিঃস্বার্থ সর্বত্যাগীর এই আচরণ তখন যেন কেবল খাপছাড়া মনে হইত, কিছুতেই একটা সামঞ্জস্য ধরা দিত না।’
এ বিষয়ে লক্ষণীয় অরবিন্দের ভাবনার ছায়া। বহুকাল পরে পণ্ডিচেরি থেকে বারীন্দ্রকুমারকে এক তারিখহীন চিঠিতে অরবিন্দ লিখেছিলেন— ‘আমার এ ধারণা হয় যে ভারতের প্রধান দুর্ব্বলতার কারণ পরাধীনতা নয়, দারিদ্র্য নয়, অধ্যাত্মবোধের বা ধর্ম্মের অভাব নয়। কিন্তু চিন্তাশক্তির হ্রাস, জ্ঞানের জন্মভূমিতে অজ্ঞানের বিস্তার। সর্ব্বত্রই দেখি inability or unwillingness to think, চিন্তা করবার অক্ষমতা বা চিন্তা— ফোবিয়া। ...মধ্যযুগে ছিল রাত্রিকাল, অজ্ঞানীর জয়ের দিন, আধুনিক জগতে জ্ঞানীর জয়ের যুগ, যে বেশী চিন্তা করে অন্বেষণ করে পরিশ্রম করে বিশ্বের সত্য তলিয়ে শিখতে পারে তার তত শক্তি বাড়ে। য়ুরোপ দেখ, দেখবে দুটি জিনিস, অনন্ত বিশাল চিন্তার সমুদ্র আর প্রকাণ্ড বেগবতী অথচ সুশৃঙ্খল শক্তির খেলা। য়ুরোপের সমস্ত শক্তি সেখানে, এই শক্তির বলে জগৎকে গ্রাস করতে পারছে আমাদের পুরাকালের তপস্বীর মত যাদের প্রভাবে বিশ্বের দেবতারাও ভীত সন্দিগ্ধ বশীভূত।’
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী নলিনীকান্ত গুপ্তের একটি লেখার কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেছিলেন,
‘আমি চতুর্থ বার্ষিকে উঠেছি, তখন হল এই পথ-নির্বাচন— পাকাপাকি বাগানে প্রবেশ করব, প্রফুল্ল বারীনদাকে জানাল, আমার পরিচয় ইত্যাদি সবই সে ইতিপূর্বে তাঁকে বলে রেখেছে। একদিন ডাক হল আমার, বারীনদা দেখবেন আমাকে— চাকরির জন্য interview যেমন। আমি উপস্থিত হলাম, প্রফুল্ল আমাকে নিয়ে গেল গোয়াবাগানে গোপীমোহন দত্ত লেনের বাসায়। আলিপুর মোকদ্দমায় এই স্থানটি বোমারুদের আড্ডা বলে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বাড়ির পাশেই ছিল পাড়ার ছেলেদের শরীরচর্চার জন্য আখড়া। বারীনদার সঙ্গে এই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। খুব আদর করে আমাকে বসালেন তাঁর কাছে— কি কথাবার্তা হল এখন আর মনে নেই, তবে বিশেষ কিছু মনে রাখবার মত নয়। কিন্তু একটি জিনিস মনে আছে— তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গীতা পড়েছি কি না। আমি বললাম, কিছু কিছু পড়েছি। তিনি একখানি গীতা আমার হাতে দিয়ে বললেন, পড় দেখি। আমি শুরু করলাম— ধর্মক্ষেত্রে...— একেবারে নির্ভেজাল গৌড়ীয় ধরনে। আমাকে থামিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ও চলবে না, বাংলা ধরনে সংস্কৃত পাঠ অচল এখানে— শোন, পড় এইভাবে। তিনি পড়ে শোনালেন হিন্দী রীতিতে— হিন্দী অর্থাৎ ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে যে উচ্চারণ চলিত। সেই শিখলাম সর্বপ্রথম সংস্কৃত পঠনে সংস্কৃত উচ্চারণ। শ্রীঅরবিন্দের মুখে পরে এই উচ্চারণ কত শুনেছি— শুনেছি তাঁর বেদ পাঠ, উপনিষদ পাঠ, গীতা পাঠ। আজ আমিও বাংলা ধরনে সংস্কৃত পড়ি না— বাংলা প্রবন্ধের মধ্যেও।’
অরবিন্দ বরোদার বিরাট সম্মানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু নামমাত্র বেতনে কলকাতায় নব-প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল কলেজ’-এর অধ্যক্ষ হয়ে আসেন ১৯০৬-এর ১৫ আগস্ট।
অরবিন্দের বন্ধু রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক জাতীয় শিক্ষা পরিষদে দান করেন এক লক্ষ টাকা। তাঁর একটি শর্ত ছিল অরবিন্দকে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করতে হবে।
গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী জানিয়েছেন— ‘১৯০৬ জুন-জুলাই ছোটলাট ফুলার বধের পরামর্শদাতারূপে বিপ্লবী অরবিন্দই, ১৯০৬/১৫ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা-পরিষদের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইলেন— ইহা অবিসংবাদিতরূপে প্রমাণ করা হইয়াছে।
মিঃ সি আর দাশ আলিপুর বোমার মামলায় বলিয়াছেন যে, সতীশচন্দ্র মুখার্জ্জীর জবানবন্দী হইতে প্রমাণ হইয়াছে যে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা হইবার কিছু আগে হইতেই অরবিন্দ জাতীয় শিক্ষা প্রচলনের যে আন্দোলন, তাহাতে যোগ দিয়াছিলেন।’
জাতীয় শিক্ষা পরিষদে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আগ্রহের কারণ,— বরোদায় বহুদিন শিক্ষকতা করে অরবিন্দের মনে হয়, ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষা আমাদের মানুষ করে না, সৃষ্টি করে ইঙ্গ-ভারতীয় বর্ণসংকর। জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি যে জাতীয় শিক্ষা— এ সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এর জন্ম থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার গোড়ার কথায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—
‘ওকাকুরা ও ভগিনী নিবেদিতা— এই দুই বিদেশীর উদ্দীপক আলাপ-আলোচনায় আমাদের প্রাণে সাহস এনে দিল। স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ স্বদেশীয় কয়েকজন মনীষীর অক্লান্ত চেষ্টায় আমরা উদ্বুদ্ধ হলুম খাঁটি দেশাত্মবোধে। যে উত্তেজনার আগুন আমাদের বুকের মধ্যে দীর্ঘকাল চাপা ছিল, ১৯০৫ সালে সেটা যেন দপ করে জ্বলে উঠল এবং ক্রমশ দেশপ্রেমের সে আগুন ছড়িয়ে গেল বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
...আমার মনে আছে কোনও কোনও দিন বাবা ও গগনদাদার সঙ্গে গুপ্ত বৈঠকের উদ্দেশ্যে, সময়ে-অসময়ে আসা-যাওয়া করতেন বিপিনচন্দ্র পাল, সখারাম গণেশ দেউস্কর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হেমচন্দ্র মল্লিক, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে।...
এই প্রসঙ্গে গিরিডির একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। শীতকালের সকালবেলা একদিন আমরা শালবনের মধ্যে দিয়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছি, ...অক্ষয় চৌধুরীর জামাতা যতীন বসু ছিলেন আমাদের সঙ্গে— তাঁর দিকে তাকিয়ে বাবা বলতে লাগলেন, দেশের তরুণদের যে-শিক্ষার প্রয়োজন সে-শিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে না। বাড়িতে ফিরে আসার পরেও খাবার টেবিলে বসে ওই একই বিষয়ে কথা বলতে লাগল। বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন যে, দেশের শিক্ষাসমস্যার একমাত্র প্রতিকার হল স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। এই চিন্তা তাঁকে পেয়ে বসল, তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। সন্ধ্যা হতে তিনি আর থাকতে পারলেন না— সেইদিনই গিরিডি ছেড়ে চলে গেলেন কলকাতা, উদ্দেশ্য— জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে এই সময়ে দেশে যে আন্দোলন চলছিল তার নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করা। তাঁরা সাগ্রহে বাবার সঙ্গে একমত হলেন এবং হপ্তাকয়েক বাদে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এর জন্ম হল। কাউন্সিল যে শিক্ষায়তনের সূচনা করবেন তার নিয়মতন্ত্র কেমন হবে, পাঠক্রম কী হবে— ইত্যাদির খসড়া বাবা নিজেই তৈরি করে দেবেন বললেন। এইভাবে গোড়াপত্তন হল আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের।’
এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্নেই মোহভঙ্গ হয় রবীন্দ্রনাথের। এর কারণ বিশ্লেষণে রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন— ‘কাউন্সিলের দু-চারটে অধিবেশনে যোগদান করে বাবা কিন্তু বুঝলেন, উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ চাইছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। তফাতের মধ্যে এই, এঁরা হয়তো টেকনোলজির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে ইচ্ছুক। কিন্তু ব্রিটিশ প্রভুরা যে বিদেশী রীতিপদ্ধতি আমদানি করেছেন, সে সব ভেঙেচুরে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী অথচ আধুনিক কালের উপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন— তেমন সৎসাহস এঁদের নেই। যখন বুঝলেন তাঁর পরিকল্পিত স্বদেশী শিক্ষার ব্যবস্থা এঁদের দ্বারা সম্ভবপর হবে না, বাবা কাউন্সিলের সংস্রব একপ্রকার বর্জন করলেন।’ (পিতৃস্মৃতি)
অরবিন্দও বেশিদিন কাজ করতে পারেননি জাতীয় কলেজে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতান্তর ঘটে ছাত্রভর্তির ব্যাপারে। সে এক ছাত্র-নিপীড়নের যুগ। অনেক সময় ‘বন্দে-মাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেও ছাত্রদের বের করে দেওয়া হতো স্কুল বা কলেজ হতে। অরবিন্দ চাইতেন— এইসব বহিষ্কৃত ছাত্রদের অবাধে জাতীয় কলেজে ভর্তি করতে, সাদরে স্থান দিতে।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল, শুধু সরকারি শিক্ষায়তনগুলির অপূর্ণতা জাতীয় শিক্ষা দ্বারা পূর্ণ করা। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের ছিল ঘোরতর আপত্তি।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অরবিন্দের ঘনায়মান মতান্তর ক্রমশ হয়ে ওঠে তীব্র। এক বছরের মধ্যে পরিষদের সঙ্গে সবরকম সংস্রব পরিত্যাগ করে ইস্তফা দেন অধ্যক্ষ পদে।
১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট জাতীয় কলেজের ছাত্ররা তাঁদের প্রথম অধ্যক্ষ অরবিন্দকে জানান বিদায়-সম্ভাষণ। বিদায়বেলায় ছাত্রদের উদ্দেশে অরবিন্দ বলেন— ‘আজ তোমরা আমার প্রতি যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়াছ, আমি মনে করি, তাহা আমার জন্য নয়, এমনকী (তোমাদের) অধ্যক্ষের জন্য নয়; তাহা তোমাদের দেশের প্রতি— আমার ভিতর দেশমাতৃকার যে বিকাশ, তাহার প্রতি অর্পণ করিয়াছ। কারণ আমি অল্প যাহা কিছু করিয়াছি, সেই দেশমাতার জন্য করিয়াছি এবং আমি যে সামান্য দুঃখ ভোগ করিতে যাইতেছি তাহা সেই দেশমাতারই জন্য।’ (অনুবাদ, প্রমোদকুমার সেন)
কোন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অরবিন্দ জাতীয় কলেজের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন সে সম্বন্ধে বলেন— ‘আশা করিয়াছিলাম, এই প্রতিষ্ঠানে আমরা জাতির একটা শক্তিকেন্দ্র, নবীন ভারতের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হইতে দেখিব, যাহাতে ভারত দুঃখের নিশার অবসানে নূতন জীবন গড়িতে পারে— সেই জয়মহিমামণ্ডিত দিনের জন্য, যখন ভারত জগৎ-হিতার্থ কার্য করিবে।’
সেই সময়ের কথায় বিখ্যাত সুরসাধিকা, চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগনি সাহানা দেবী ‘স্মৃতির খেয়া’য় জানিয়েছেন, ‘শ্রীঅরবিন্দ যেদিন বরোদার অতবড় সম্মানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু নামমাত্র বেতনে কলকাতার নব-প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয় ন্যাশনাল কলেজ-এর প্রিন্সিপাল হয়ে এলেন, সেদিন তাঁর এতবড় ত্যাগের মহত্ত্বে বিস্ময়ে স্তম্ভিত সমস্ত দেশবাসী সম্ভ্রমে শ্রদ্ধায় তাঁর কাছে শির নত করল। এই বিরাট, মহান ত্যাগের ভিতর দিয়ে হল তাঁর সঙ্গে তাঁর দেশবাসীর পরিচয়। শ্রীঅরবিন্দের নাম সেই থেকে আমাদের মনে গাঁথা হয়ে রইল। তিনি যে সম্পূর্ণ অন্য জগতের, অন্য পর্যায়ের, অন্য জাতের মানুষ, তা ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে এসেছি ও সেই চোখেই তাঁকে দেখতে শিখেছি। রাজা সুবোধ মল্লিকের অনুরোধে, পরে তিনি বন্দেমাতরম দৈনিক কাগজের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। বিপিন পালও তাঁর সঙ্গে একত্রে এই কাগজ পরিচালনা করেন। এই বন্দেমাতরম কাগজে যখন শ্রীঅরবিন্দের লেখার পর লেখা বের হতে লাগল তখন তাঁর সম্বন্ধে সকলের বিস্ময় বেড়েই চলল।’
সাহানা দেবী, সুভাষ বসু ও দিলীপ রায় সমবয়সি, তিনজনেরই জন্ম ১৮৯৭ সালে। সাহানা ছিলেন সুভাষচন্দ্রের শুভার্থী— যদিও ডাকতেন ‘সুভাষবাবু’ বলে।
১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেস অধিবেশনের সময় দিলীপ রায়ের কণ্ঠে কয়েকখানি গান শোনার খুব ইচ্ছে হয় সাহানার। তিনি জানতেন, সুভাষচন্দ্রের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু দিলীপ রায়। তখন তিনি সুভাষচন্দ্রকে ধরেছিলেন— তাঁর বন্ধুর গান শোনার আবদার জানিয়ে।
সেই সময় সুভাষচন্দ্রের মাধ্যমেই দিলীপ রায়ের সঙ্গে সাহানার পরিচয়। বহুকাল পরে অন্নদাশঙ্কর রায়কে কথাপ্রসঙ্গে দিলীপ রায় বলেছিলেন— ‘সাহানাকে যে আমি ভালোবাসি।’ অন্নদাশঙ্কর লিখেছেন— ‘...আমার মনে হয়, ওঁদের দু’জনের মধ্যে একটা গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেটা অশরীরী প্রেম। যাকে বলে Platonic Love। দিলীপদাকে আমি যতদূর জানি, বিবাহবন্ধন তাঁর জন্য নয়। তিনি চির পলাতক।’
সাহানা জীবনের শেষ ষাটটি বছর কাটিয়েছেন পণ্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমে। সুরসাধিকার তপশ্চারিণী জীবন।
দিলীপ রায় যেমন সুরসাধক তেমনই অধ্যাত্ম-অন্বেষী। তাঁর দীক্ষাদাতা গুরু শ্রীঅরবিন্দ।
এই সুবিখ্যাত ত্রয়ীর অপরজন সুভাষ। রাজনীতির রণাঙ্গনের চির-দুর্গম পথের পথিক। ছাত্র জীবনে তাঁর অধ্যাত্মচেতনায় অরবিন্দ কতখানি ছায়া ফেলেছেন— তা সুস্পষ্টরূপে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায়—
‘তাঁর (অরবিন্দের) গভীরতর দর্শন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শঙ্করের মায়াবাদ কাঁটার মত আমার মধ্যে বিঁধেছিল। আমি আমার জীবনকে তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বা সহজে তা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারিনি। এর পরিবর্তে প্রয়োজন হয়েছিল আমার আর একটি দর্শনের। এক ও বহু এবং ঈশ্বর ও সৃষ্টির মধ্যে সমন্বয়— রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ যা প্রচার করেছেন, বাস্তবিকই আমার মনে রেখাপাত করেছিল, কিন্তু তখনও পর্যন্ত তা মায়ার বন্ধন থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারেনি। এই মুক্তির পথে অরবিন্দ আমার আর এক সহায়রূপে দেখা দিলেন। দর্শনের দিক দিয়ে তিনি আত্মা ও জড়, ঈশ্বর ও সৃষ্টির মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করেছিলেন এবং সত্যকে লাভ করবার উপায়গুলোর মধ্যে যোগসাধনা করে তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েছিলেন— যার নাম দিয়েছিলেন তিনি যোগের সমন্বয়।’ (চলবে)