সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
পর্ব- ৯
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়: বার্নার্ড শ-র তারিফ করে শ্রীঅরবিন্দ একদা দিলীপকুমার রায়কে লিখেছিলেন— ‘আইরিশদের স্বধর্ম হল গম্ভীর কথা চটুলভাবে বলা।’
জীবনে কঠিন বেদনার ক্ষণে,— বিষম ব্যথা ও দুঃখের কথা হাসি-মশকরার সুরে বলতে পারতেন বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সহবিপ্লবী উপেন্দ্রনাথের এ স্বভাব-বৈশিষ্ট্য জানা ছিল বলেই শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, ‘You could not have a dull moment when barin or upen was there.’
হাস্যকিরণে উজ্জ্বল, করুণ রসে সজল ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় অগ্নিযুগের ভোরবেলায় ‘যুগান্তর’-এর আড্ডার এক বিচিত্র চিত্রের উপহার দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ।
‘লোকে কানাকানি করে যে, যুগান্তরের আড্ডাটা নাকি একটা বিপ্লবের কেন্দ্র। ... কলিকাতা যুগান্তর অফিসে আসিয়া দেখিলাম ৩/৪টি যুবক মিলিয়া একখানা ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া ভারত উদ্ধার করিতে লাগিয়া গিয়াছেন। যুদ্ধের আসবাবের অভাব দেখিয়া মনটা একটু দমিয়া গেল বটে, কিন্তু সে ক্ষণেকের জন্য। গুলি-গোলার অভাব তাঁহারা বাক্যের দ্বারাই পূরণ করিয়া দিলেন। দেখিলাম, লড়াই করিয়া ইংরেজকে দেশ হইতে হটাইয়া দেওয়া যে, একটা বেশি কিছু বড় কথা নয়, এ বিষয়ে তাঁহারা সকলেই একমত। কাল না হয় দু’দিন পরে যুগান্তর অফিসটা যে গভর্নমেন্ট হাউসে উঠিয়া যাইবে, সে বিষয়ে কাহারও সন্দেহমাত্র নাই। কথায়-বার্তায়, আভাসে-ইঙ্গিতে এই ধারণাটা আমার মনে আসিয়া পড়িল যে, এ সবের পশ্চাতে একটা দেশব্যাপী বড় রকমের কিছু প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে।
দুই-চারিদিন আনাগোনা করিতে করিতে ক্রমে যুগান্তরের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হইল। দেখিলাম— প্রায় সকলেই জাতকাট ভবঘুরে বটে। দেবব্রত (ভবিষ্যতে স্বামী প্রজ্ঞানন্দ নামে ইনি প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন) বিএ পাস করিয়া আইন পড়িতেছিলেন; হঠাৎ ভারত উদ্ধার হয় হয় দেখিয়া আইন ছাড়িয়া যুগান্তরের সম্পাদকতায় লাগিয়া গিয়াছেন।’
পরবর্তী সময়ে আলিপুর বোমার মামলায় কারারুদ্ধ দিনগুলোয় বিপ্লবী দেবব্রত বসুর গানের কথার অবতারণা করে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন—
‘সন্ধ্যার সময় গানের আড্ডা বসিত/হেমচন্দ্র, উল্লাসকর, দেবব্রত কয়জনেই বেশ গাহিতে পারিত; কিন্তু দেবব্রত গম্ভীর পুরুষ— বড় একটা গাহিত না। অনেক পীড়াপীড়িতে একদিন তাহার স্বরচিত একটা গান আমাদের শুনাইয়াছিল। ভারতব্যাপী একটা বিপ্লবকে লক্ষ্য করিয়াই তাহা রচিত। তাহার সুরের এমন একটা মোহিনী শক্তি যে, গান শুনিতে শুনিতে বিপ্লবের রক্তচিত্র আমাদের চোখের সম্মুখে যেন স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিত। গান বা পদ্য কস্মিনকালেও আমার বড় একটা মনে থাকে না কিন্তু দেবব্রতের সেই গানটার দুই-এক ছত্র আজও মনে গাঁথিয়া আছে—
উঠিয়া দাঁড়াল জননী!
কোটি কোটি সুত হুঙ্কারি দাঁড়াল!
… … …
রক্তে আঁধারিল রক্তিম সবিতা
রক্তিম চন্দ্রমা তারা,
রক্তবর্ণ ডালি রক্তিম অঞ্জলি
বীর রক্তময়ী ধরা কিবা শোভিল!
বন্দিদশায় দেশের স্বাধীনতার জন্য
উৎসর্গীকৃত দামাল সন্তান দেবব্রতের কণ্ঠে এ গান শুনে সহবিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ তাঁর মনের অবস্থা সম্বন্ধে জানিয়েছেন— ‘গানটা শুনিতে শুনিতে মানস-চক্ষে বেশ স্পষ্টই দেখিতাম যে, হিমাচলব্যাপী ভাবোন্মত্ত জনসঙ্ঘ বরাভয়করের স্পর্শে সিংহগর্জনে জাগিয়া উঠিয়াছে; মায়ের রক্ত-চরণ বেড়িয়া বেড়িয়া গগনস্পর্শী রক্তশীর্ষ উত্তাল তরঙ্গ ছুটিয়াছে; দ্যুলোক ভূলোক সমস্তই উন্মত্ত রণবাদ্যে কাঁপিয়া উঠিয়াছে। মনে হইত যেন আমরা সর্ববন্ধনমুক্ত— দীনতা, ভয়, মৃত্যু আমাদের কখনও স্পর্শও করিতে পারিবে না।’
পরবর্তীকালে উপেন্দ্রনাথের এই বর্ণনা সম্বন্ধে সৈয়দ মুজতবা আলি ‘ময়ূরকণ্ঠী’তে লেখেন ‘পড়ে মনে হয় যেন বিবেকানন্দের কালীরূপ বর্ণনা শুনছি—
নিঃশেষে নিবিছে তারার দল
মেঘ আসি আবরিছে মেঘ
স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার
গরজিছে ঘূর্ণ বায়ুবেগ
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত পরাণ
বহির্গত বন্দীশালা হতে
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি
ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে’
(সত্যেন দত্তের অনুবাদ)
বিপ্লবী দেবব্রতের পিতা আশুতোষ বসু, মাতা এলোকেশী দেবী বাস করতেন কলকাতার ৪ নং স্টার লেনে। তাঁদের দুই পুত্রের বড় দেবব্রত, চার কন্যার সর্বকনিষ্ঠা সুধীরা।
ছোট্ট সুধীরাকে সবাই আদর করে ডাকত ‘খুদি’। পাশের বাড়ির মৃণালিনী তাঁর বন্ধু। সুধীরা তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘মেনু’। এই মেনু বা মৃণালিনীই পরবর্তীকালে শ্রীঅরবিন্দের পত্নী।
আশুতোষ বসু ছিলেন হুগলির হরিপালের জেজুর গ্রামের জমিদার। কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। সুধীরার দেড়-দুই বছর বয়সে পিতা মারা যান রেঙ্গুনে।
পিতৃহারা সুধীরার জীবনে বড়দাদা দেবব্রত ছিলেন পিতৃ-প্রতিম। তিনি ছোট বোনটিকে গড়ে তুলছিলেন নিজের মনের মতো করে।
স্বদেশব্রতী ও আদর্শনিষ্ঠ দাদার কাছে যাতায়াত ছিল অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির। সেই-সব যশস্বীজনদের দেশপ্রেম, দেশের কারণে সর্বস্ব ত্যাগের দৃঢ় সংকল্প সুধীরার কিশোরী মনে গভীর ছায়া ফেলে। বাড়িতে আসতেন অরবিন্দ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিপ্লবী, দেশ স্বাধীন করার বজ্রকঠিন সংকল্প আর অগ্নিগর্ভ আলোচনা ও তর্কবিতর্ক উদ্দীপিত করত তাঁকে।
কিন্তু সে-এক এমন সময়— অধিকাংশ নারীজীবন রুদ্ধ ছিল অবরোধ, অবগুণ্ঠন, বাল্যবিবাহ, অশিক্ষা কুসংস্কারের অন্ধকারে।
১৮৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাড়িতে কলকাতাবাসীর পক্ষ থেকে স্বামী বিবেকানন্দকে সংবর্ধনা জানানো হয় সাড়ম্বরে। সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনা সভায় কাত্যায়নী নামে ন’বছরের একটি বালিকা ছাড়া রাজবাড়ির আর কোনও মেয়েই অনুমতি পায়নি স্বামীজির দর্শনের বা তাঁর বক্তব্য শোনার।
এমন সামাজিক পরিবেশেও দেবব্রত চাইতেন ছোট বোনটিকে নির্ভীক, স্বাধীন ও স্বাবলম্বী করে তুলতে। মহাকালী পাঠশালা ও ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে পড়েছিলেন সুধীরা। ১৯০৩ সালে পনেরো বছর বয়সে হারালেন মাকেও।
পরের বছর দেশবাসীর মনে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা উদ্দীপ্ত করতে পুরী, কটক প্রভৃতি জায়গায় বক্তৃতা-সফরে বেরিয়ে পড়েন দেবব্রত। সবে মাকে হারিয়েছেন, বুঝতে পারেন ছোট বোনের মনের অবস্থা। সঙ্গে নিলেন তাঁকে। শেখাতে শুরু করলেন বাইরের জগতে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে। একা পাঠালেন রেলের টিকিট কাটতে, অন্যান্য কাজ সামলাতে। ক্রমে স্বদেশি কাজে সদা-প্রস্তুত হয়ে উঠলেন সুধীরা।
বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় জানা যায়, ভগিনী সুধীরা বিপ্লবীদের বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন এবং নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করতেন। কারণ স্বদেশি বিপ্লবের সময় ঘরের মেয়েরা চরকা কাটা, লুকিয়ে অস্ত্রপাচার, বিপ্লবীদের আত্মগোপনে সহায়তা ইত্যাদি স্বদেশি কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল। সুধীরাও শামিল হয়েছিলেন এই কাজে। ফলে একদিকে যেমন স্বাধীনচেতা মনোভাব বিকশিত হয়েছিল, অন্যদিকে তেমন দেশ ও দশের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম তাঁকে দুর্লভ চরিত্রের অধিকারী করে তুলেছিল।
শ্রীমা সারদা দেবী একবার সুধীরার কথায় বলেছিলেন— ‘যখন খরচ চলে না, বড়লোকের মেয়েদের গানবাজনা শিখিয়ে মাসে ৪০/৫০ টাকা আনে, স্কুলের মেয়েদের সব শিখিয়েছে— সেলাই করা, জামা তৈরি করা। সে বছর তিনশো টাকা লাভ হয়েছিল। ঐ টাকায় ওরা সব হেথা-সেথা যায় পুজোর সময়। সুধীরা দেবব্রতের ভগ্নী। ভাই নিজে স্টেশনে আড়ালে থেকে ভগ্নীকে টিকিট কাটতে, একলা গাড়ীতে উঠতে এসব শেখাতো।’
দাদা দেবব্রত দূরে গিয়েও সব সময় চিঠিপত্রে বোনকে উন্নত জীবনবোধ ও আদর্শে কীভাবে প্রেরণা জোগাতেন তার দৃষ্টান্ত রয়েছে প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণার অসাধারণ গ্রন্থ ‘অনন্য সুধীরা’য়।
মায়াবতী থেকে দেবব্রত বোনকে লিখছেন— ‘যে সমস্ত ভাব মনে এলে ভগবানকে ভালোবাসতে পারা যায়, তারমধ্যে একটি হচ্ছে অসীম ধৈর্যভাব— অসীম কি না যে ধৈর্য কিছুতে ভাঙে না। ... এই ধৈর্যের ভাবটি অত্যন্ত দরকার। এতে হৃদয়কে বিশাল করে দেয়। সেরকম বিশালতা বা ধৈর্য না থাকলে ভগবানের মতো মহৎ বস্তুর সঙ্গে ভালোবাসা-বাসি কি করে হবে? হৃদয়টাকে রাস্তার জল দেওয়ার মতো না করে গভীর সমুদ্রের মতো করার চেষ্টা করতে হবে। ওই ফোয়ারাগুলোর অবস্থা দেখছ তো? ফরফর করে তোড়ে জল বার করে খানিকক্ষণ রাস্তাঘাট ভিজিয়ে দিয়ে গেল, তারপরই একদম বন্ধ— জল যদি বেরোয় তো ফোঁটা ফোঁটা। হৃদয় যেন এরকমটা না হয়। ...খুব ধৈর্য চাই, নিজের ওপর বিশ্বাস চাই, আর ওই ধৈর্য ও বিশ্বাসের চাড় দিয়ে হৃদয়টাকে সর্বদা খুব বিশাল করে নিয়ে ভালোবাসা পোষণ করা চাই। আর পোষণ করাটা কী রকম, না, সদাসর্বদা মনে মনে জোর সংকল্প করা যে, আমি ভালোবাসব; ভালোবাসা পাই আর না পাই, আমি দিব, ওঠাবসার মধ্যে ভালোবাসব; ভালো তো বেসে যাই, একটা কিছু হোক না হোক। হবে আর কী ছাই! একটা কিছু হওয়ার দিকে নজর রেখো না, তাহলে আসল জিনিস ভালোবাসা জমাট বাঁধবে না... ভালোবাসতে পারাই হচ্ছে, একমাত্র হওয়া আর যেসব শোনো— সিদ্ধাই, সমাধি বা তত্ত্বজ্ঞান প্রভৃতি প্রভৃতি— ওগুলো ভালোবাসার আসর সাজানো।’
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বসু প্রমুখ বিপ্লবীদের প্রথম দিকের ডেরা— মানিকতলা বাগানের আশ্রম শুরুর কিছুদিন পরেই উপেন্দ্রনাথ ও দেবব্রত বেরিয়ে পড়েন ভারত পরিক্রমায়। প্রয়াগ থেকে বিন্ধ্যাচলে এসে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ তাঁর সুবিখ্যাত ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য়।
‘প্রয়াগ হইতে বিন্ধ্যাচলে আসিয়া এক ধর্মশালায় কিছুদিন পড়িয়া রহিলাম। মাঠের মাঝখানে একখানি ছোট কুঁড়েঘর বাঁধিয়া একজন জটাজুটধারী সাধু সেখানে থাকেন।... বাবাজী আহারাদির কোনও চেষ্টা করেন না; তবে তাঁহার কাছে ভক্তেরা যা প্রণামী দিয়া যায়, তাঁহার একজন গোয়ালা ভক্ত তাহা কুড়াইয়া লইয়া গিয়া তাহার পরিবর্তে সাধুকে দুধসাগু তৈয়ার করিয়া দেয়। ঐ দুধসাগু খাইয়াই তিনি জীবনধারণ করেন। ... ধর্মশালায় ফিরিয়া আসিয়া দেখি, এক গেরুয়া-পরিহিতা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী আমাদের কম্বল দখল করিয়া বসিয়া আছেন। দেবব্রত ব্রহ্মচারী মানুষ, স্ত্রীলোকের সহিত একাসনে বসে না; সে তো ভৈরবীকে দেখিয়া প্রমাদ গণিল। এই সন্ধ্যার সময় তাহার পর্বত-প্রমাণ বিপুল দেহভার লইয়া বেচারা কম্বল ছাড়িয়া যায়ই বা কোথায়? ভৈরবীর আপাদমস্তক দেখিয়া দেবব্রত জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কে?
ভৈরবী— আমি সাধুসঙ্গ করতে চাই।
দেবব্রত— সাধুসঙ্গ করতে চান তো আমাদের কাছে কেন? দেখছেন না আমরা বাবুলোক, আমাদের পরনে ধুতি চোখে সোনার চশমা?
ভৈরবী— তা হোক, আমি জানি— আপনারা ছদ্মবেশী সাধু।
আমরা অনেক করিয়া বুঝাইলাম যে, আমরা ছদ্মবেশীও নই, সাধুও নই, কিন্তু ভৈরবী ঠাকরুন সেখান হইতে নড়িবার কোনই লক্ষণ দেখাইলেন না। শেষে অনেক তর্কবিতর্কের পর দেবব্রতই রণে ভঙ্গ দিয়া সে-রাত্রি এক গাছতলায় পড়িয়া কাটাইয়া দিল।
কিন্তু ভৈরবী হইলে কি হয়, বাঙালির মেয়ে তো বটে! সকালবেলা ঘুরিয়া আসিয়া দেখি, কোথা হইতে চাল-ডাল জোগাড় করিয়া ভৈরবী রান্না চড়াইয়া দিয়াছেন। বেলা দশটা না বাজিতে বাজিতে আমাদের জন্য খিচুড়ি প্রস্তুত। কামিনী-কাঞ্চনে ব্রহ্মচর্যের ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে কিন্তু কামিনীর রান্না খিচুড়ি সম্বন্ধে শাস্ত্রের কোন নিষেধ নাই; সুতরাং আমরা নির্বিবাদে সেই গরম গরম খিচুড়ি গলাধঃকরণ করিয়া ফেলিলাম। আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হইলে তবে ভৈরবী আহার করিতে বসিলেন। দেখিলাম, বাঙালীর মেয়ের স্নেহক্ষুধাতুর প্রাণটুকু গৈরিকের ভিতর দিয়াও ফুটিয়া বাহির হইতেছে।’
দেবব্রত বসু, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিপ্লবীর তীর্থস্থানে সাধু দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়ার কারণ বহুকাল পরে অনুসন্ধান করেছেন আর এক মহান বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো। আন্দামানে নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে এসে গভীর দোলাচলে পড়েছিলেন হেমচন্দ্র। রাজ-রোষে দুর্বিপাকগ্রস্ত হয়ে চেষ্টা চালান ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহের। সংস্পর্শে আসেন এম এন রায়ের। ১৩২৯ থেকে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের মাঝে মাসিক বসুমতীতে লেখেন ‘বাংলার বিপ্লব কাহিনী’ শীর্ষক কিছু লেখা। ১৯২৮ সালে সেই সব লেখা গ্রন্থিত হয় ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’ শিরোনামে।
ইংরেজ-আমলে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি অনেকের নাম স্পষ্ট উল্লেখ না করে লিখেছেন যেমন ‘ক’ বাবু— (অরবিন্দ ঘোষ), ‘খ’ বাবু (যতীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) ইত্যাদি। দেবব্রত বসুর অনুষঙ্গে হেমচন্দ্র কানুনগো লিখছেন—
‘বাংলাদেশে গুপ্তসমিতি গঠন শুরু করার আগে, শুনেছি ক-বাবু না-কি মারাঠা গুপ্তসমিতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি যে গুপ্তসমিতি গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিলেন, তার পত্তন থেকে দু’বছর যাবৎ তিনি নিজে কোনও ধর্মানুষ্ঠান করতেন না, আর দীক্ষাকালীন গীতা স্পর্শ করা ছাড়া সমিতির কাজে বা ভাবে ধর্মের কোনও সম্বন্ধ ছিল না। যদি ক-বাবু নেহাত থিওরিটিক্যাল না হতেন, অথবা তাঁর থিওরি কাজে পরিণত করবার জন্য একজন যোগ্য কর্মী জুটত, তাহলে এই ধর্ম-সম্বন্ধবিহীন গুপ্তসমিতির কাজে ঠিকমতো প্রসার আরও হয়তো বাড়ত। কিন্তু তা না হয়ে যখন বারীনের গ্রে স্ট্রিটের আড্ডা ভেঙে গেল, তখন ক-বাবু হতাশ হয়ে পড়লেন।
অন্য নেতাদের মধ্যে দেবব্রতবাবু বিশেষ করে আগে হতে ধর্মচর্চা করছিলেন। ভারত যে ধর্মের দেশ, ধর্মের ভেতর দিয়ে ব্যাতীত কোনও নতুন ভাব এ দেশ গ্রহণ করতে পারে না, এই ধারণা আমাদের দেশে খুব সাধারণ হলেও ক-বাবুকে কিন্তু অনেকদিন থেকে তা ধরাতে চেষ্টা করেছিলেন দেবব্রতবাবু। সিদ্ধ যোগী, সাধু-সন্ন্যাসীর অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে দেবব্রতবাবুর বিশ্বাস ছিল অগাধ। তার থেকেও বেশী ছিল তাঁর অন্যকে বিশ্বাস করাবার শক্তি।’
আসলে দেবব্রত বসুর ব্যক্তি-জীবনের ঘটনাপ্রবাহ ক্রমশ তাঁকে করে তোলে অধ্যাত্ম-অন্বেষী। মায়ের মৃত্যুর পর সদা প্রাণোচ্ছল ছোট বোনটি দিনে দিনে কেমন উদাসী হয়ে উঠে। শুধু মৃত্যুচিন্তা— একসময় কীভাবে যেন তা আস্তে আস্তে মোড় নেয় স্বদেশপ্রেমে।
সমাজের রক্তচক্ষু আর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে মাত্র ষোলো বছর বয়সে সুধীরা জগন্নাথ-দর্শন উদ্দেশে দুর্গম পথে পায়ে হেঁটে রওনা করেন পুরী তীর্থযাত্রায়। সঙ্গিনী তাঁর প্রিয় মাসতুতো বোন। হাতে ত্রিশূল, কমণ্ডলু। পরনে গেরুয়া বস্ত্র, ত্যাগীর বেশে পথে নামেন উদাসীন সুধীরা। দুঃসাহসী যাত্রী। পথে এক দুর্বৃত্ত তাঁদের অনুসরণ করতে শুরু করলে ত্রিশূল হাতে রুখে দাঁড়ান প্রবল পরাক্রমে।
দাদা দেবব্রত অনুধাবন করেন, আর পাঁচজনের মতো ঘর-সংসার নিয়ে কাটানোর জীবন সুধীরার নয়। অন্তরে তাঁর অনন্তের সুর। ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার পরিবর্তে অবাধ মুক্ত জীবন তাঁর প্রিয়। অশেষপ্রাণা লিখছেন— ‘স্নেহময় দাদাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর এই তেজস্বিনী বোনটি সংসারের বন্ধনের জন্য নয়। বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত দেবব্রতর যেমন অরবিন্দের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তেমনই ভগিনী নিবেদিতার সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাই স্বামীজির আদর্শে প্রাণিত ব্যতিক্রমী দাদা তাঁর স্নেহের ছোট বোনের জীবনের সুর বেঁধে দিতে চাইলেন উচ্চ আদর্শে। ভারতবর্ষের নারী জাতির শিক্ষার উন্নতিকল্পে অঞ্জলি দিলেন ব্যতিক্রমী বোনটিকে। নিয়ে এলেন ভারতীয় নারীশিক্ষাপ্রসার ব্রতে নিবেদিতপ্রাণ ভগিনী নিবেদিতার স্বপ্নের বিদ্যালয়ের পাদপীঠে— বাগবাজারে।’