সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
পর্ব- ৬
খুলনায় ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষের সরকারি বাড়িটি ছিল খড়ের-ছাওয়া ছবির মতো সুন্দর। সামনে বিরাট বাগান। বাড়িতে উঠতেই একটুখানি বারান্দা, তার একপাশে তাঁর চেম্বার। ভিতরে বড় হল ঘর, তাতে ডিনার টেবিল। হলের দু’পাশে দু’খানি করে ঘর, ভিতরের দিকে একফালি বারান্দা।
বাড়িখানি প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডের মাঝে। দূরে বাবুর্চিখানা— পরপর ঘোড়ার আস্তাবল, মুরগি-হাঁসের ঘর, গোশালা। কম্পাউন্ডে ঢুকতে বাঁশের জাফরি ঘেরা লতায় ঢাকা একটি বসবার কুঞ্জ।
ডাঃ কৃষ্ণধন যখন বালক পুত্রকে পাশে বসিয়ে টমটম হাঁকিয়ে কাজে বের হতেন— বারীন অবাক চোখে দেখতেন, দু’ধারে মানুষ শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ছে, সমস্ত পথ তিনি যেতেন মাথার টুপি তুলতে তুলতে সেই মুহুর্মুহু নমস্কার, সেলাম ও প্রণামের প্রত্যাভিবাদন দিতে দিতে।
খুলনায় দুঃখী-দরিদ্র মানুষের কাছে ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন ধন্বন্তরী চিকিৎসক। অসহায় রোগীর সেবা, দু’হাতে দান-খয়রাত আর মদ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। যেমন অর্থোপার্জন করতেন বিপুল, তেমন ব্যথাতুর অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করতেন বিস্তর। বিপণ্ণ মানুষ তাঁর কাছে পেত বাঁচার আশা।
বারীন ঘোষের কথায়, ‘প্রার্থী কখনও কিছু চেয়ে তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফেরেননি, অতবড় হ্যাট কোট পরা মদ্যপ ডাক্তার সাহেব রাত বারোটায় এক হাঁটু জল-কাদা ভেঙে গরিব চাষী রোগীকে দেখতে গেছেন বিনা পয়সায়। এত চরিত্রদোষ থাকতেও এই চিনির মত মিষ্টি মানুষটির শত্রু বলে ভূভারতে কেউ ছিল না। নিজের দুঃখের জীবন নিয়ে তিনি ছিনিমিনি খেলতেন বটে কিন্তু পরের জীবনের জন্য তাঁর ছিল মায়ের অধিক দরদ ও সমবেদনা। দোষে গুণে সুন্দর ও নিতান্তই human চরিত্রগুলির মাধুর্য দেখতে না পেয়ে মানুষ করে মরালিটির ভড়ং একেই বলে Prudery!’
ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ খুলনার সিভিল সার্জেন থাকার সময় মাসের মধ্যে দু-একবার আসতেন কলকাতায়। গোমেস লেনের বাড়িতে দু’-চার দিন কাটিয়ে আবার ফিরে যেতেন কর্মস্থল খুলনায়। বারীন্দ্রকুমার ‘আত্মকথা’য় জানিয়েছেন, ‘কলকাতায় থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে আমরা যেতুম গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে খোলা ফিটনে বসে, এই সময়টির জন্য সাহেব আমার Tip-top বাবার পাশে মা বসতেন বুক-খোলা গাউন পরে নানা ফুলে ফলে ভরা লেডিজ হ্যাট মাথায় দিয়ে রুমাল হাতে। সে বেশেও রূপসী মা আমার গড়ের মাঠ ও ইডেন গার্ডেন আলো করে চলতেন তাঁর সম্রাজ্ঞীর বাড়া লাবণ্যে ও শ্রীগরিমায়। এই মা যে কে, কোথা থেকে এসে কবে আমার বাবার শূন্য জীবন সুখের প্লাবনে ভরে দিয়ে তাঁর ভাঙা সংসার আবার গড়ে তুলেছিলেন তা অনেকদিন আমি জানতুম না। মায়ের কুলজী সন্তানের কাছে কি অমন করে খোঁজবার জিনিস? তা খোঁজে কেবল মরালিটির হিস্টিরিয়া-গ্রস্ত এই সমাজ, আর তার ফিটফাট ধোপদস্ত স্তম্ভগুলি। মা কি জিনিস তা আমি আমার শৈশব ভরে কখনও জানিনি। এই অজানা রাঙা-মা আমার সে আস্বাদ আমায় প্রথম দেন।’
অমন হৃদয়বান সুবিদ্য চিকিৎসক স্বামীকে মদ ছাড়াবার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন কয়েক বছর। কলকাতা থেকে না বলে কয়ে হঠাৎ খুলনায় উপস্থিত হতেন স্বামীর ‘নৈতিক অনাচার’ বন্ধ করতে।
বারীন ঘোষ ‘আত্মকথা’য় নিঃসংকোচে ও অনায়াসে যেভাবে লিখেছেন পিতা কৃষ্ণধন ঘোষের বিস্ময়কর জীবনের ঘটনা, আত্মকথনে তেমন বলিষ্ঠতা ও সত্যনিষ্ঠতা দেখাতে পেরেছেন খুব কম বাঙালি লেখক। বলা যেতে পারে, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান-গাওয়া এ মহাবিপ্লবী এক্ষেত্রেও এক বিরল দৃষ্টান্ত।
পিতার উপর রাঙা মায়ের প্রভাব প্রসঙ্গে বারীন ঘোষ লিখছেন— ‘এই দৃপ্তা গরিয়সী মেয়েটির পদ্ম চোখের ভ্রূকুটি আর অশ্রুকে বাবা যে কি মর্ম্মান্তিক ভয়টা করতেন তা ছিল একটা দেখবার জিনিস। খুলনায় মা থাকলে বাবার হুইস্কির বোতল থাকতো মায়ের কাছে, অনেক কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষাস্বরূপ দিনে এক আধ পেগ পেতেন।’
খুলনায় এক মর্মান্তিক পরিস্থিতির পরিণতিতে আকস্মিক মৃত্যু কৃষ্ণধন ঘোষের। ১৮৯২ সালের শেষপ্রান্তে। চোদ্দো বছর পরে পুত্রের বিলেত থেকে ভারতে ফেরার জন্য গভীর প্রতীক্ষায় পিতা।
অরবিন্দের যে-জাহাজে ফেরার কথা ছিল সেই জাহাজে না ফিরে রওনা হলেন কার্থেজ নামক মেল স্টিমারে। ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ Bombay Grimdlay & Co. কে টেলিগ্রাম করে অধীর আগ্রহে জানতে চান, সেই জাহাজ কবে ফিরবে বম্বে?
তাঁর ব্যাঙ্কারের কাছ থেকে পেলেন এক মারাত্মক ভ্রান্ত সংবাদ, অরবিন্দের জাহাজটি পর্তুগালের উপকূলে লিসবনের কাছে ডুবে গেছে।
খুলনায় বিকেলে টমটম চড়ে ডাঃ কৃষ্ণধন যাচ্ছিলেন বন্ধু-বাড়িতে নিমন্ত্রণে, এমন সময় পেলেন গুপ্তঘাতকের ছদ্মবেশধারী সেই টেলিগ্রাম। পুত্র অরবিন্দের হঠাৎ জাহাজ-ডুবিতে মৃত্যুর অমন দুঃসংবাদের আঘাত সইতে পারলেন না। মুহূর্তের মধ্যে গুরুতর অবস্থা। এক পা গাড়ির পা-দানিতে দিয়ে আর এক পা বাড়াতেই পড়ে গেলেন। ধরাধরি করে নিয়ে এসে শুইয়ে দেওয়া হয় শয্যায়। সেই শয্যায়ই তাঁর শেষ শয্যা। তিন-চার দিন পরে মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান। শোনা যায়, ‘অরো’ ‘অরো’ অস্ফুট স্বরে এই নামোচ্চারণ করতে করতেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
একটি ভ্রান্ত সংবাদের অভিঘাতে অকস্মাৎ অসময়ে ঘনিয়ে আসে মৃত্যু। ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ প্রয়াণের পূর্বে প্রায়ই বলতেন ‘বিধাতাকে যদি পেতুম, জিজ্ঞেস করতুম, এত দুঃখ আমার কপালে লিখেছিলে কেন?’
গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী লিখছেন— ‘একটি বিরাট শোভাযাত্রা স্তূপাকার পুষ্পমাল্যে শোভিত ডাঃ কে ডি ঘোষের শব লইয়া শ্মশান অভিমুখে যাত্রা করিল। ... তাঁর চিতার পার্শ্বে খুলনার সমস্ত লোক এসেছিল শেষ সাক্ষাতের জন্য। তাদের অনুরোধে শবের মুখ খুলে দেওয়া হয়।’
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ জানা যায় বারীন্দ্রকুমারের আত্মকথায়— ‘বাবার উইল মনোমোহন ঘোষের বাড়িতে পড়া হোলো, তাতে তিনি আমার গর্ভধারিণী মা স্বর্ণলতার ব্যবস্থা করে সমস্ত টাকা ও বিষয়-আশয় এবং ছেলেমেয়ের ভার রাঙা মায়ের হাতে দিয়ে যান। এই নিয়ে আমার নীতিবাগীশ আত্মীয়দের সঙ্গে মায়ের বাঁধলো লড়াই। একদিকে অসহায় অর্ধশিক্ষিত আইনের প্যাঁচে ক’অক্ষর গোমাংস হিন্দু বিধবা আর একদিকে সমাজের ও পরিবারের গুরুগম্ভীর বিদ্বান নীতিচঞ্চু অভিভাবকের দল।’
বারীন ঘোষ আরও লিখেছেন— ‘বাবা মারা যাবার পর যখন কৌঁসুলী মনোমহন ঘোষের বাড়িতে উইল পড়া হয়ে রাঙা মা হলেন বিষয়-আশয়ের সর্ব্বময়ী কর্ত্রী, তখন এই ব্যাপারটাকে রদ করবার জন্যে আমার ব্রাহ্ম আত্মীয়দের মধ্যে পড়ে গেল একটা আপ্রাণ চেষ্টা। ... আমার একজন আত্মীয় (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের একজন চূড়া) এসে মায়ের সঙ্গে কথায়বার্ত্তায় উইলখানি একবার দেখিতে চাহিলেন। সরল মেয়ে মা আমার উইলখানা তাঁর হাতে এনে দেবামাত্র তিনি পকেটস্থ করে বললেন তুমি ছেলেমেয়ে পাবে না, আর টাকাকড়ির দাবী যদি কর এই উইল জাল বলে কোর্টে প্রমাণ করা হবে। এই বলে ধর্ম্মপ্রাণ মানুষটি দিব্য গজেন্দ্রগমনে প্রস্থান করিলেন। ... বাবার এই দ্বিতীয় বিবাহ বিবাহই নয়, আইনের চোখে অ্যাক্ট তিন অনুযায়ী প্রথম বিবাহের পর এ বিবাহ বেআইনি অপরাধ।
...অনেক বাক-বিতণ্ডা ঘোরাঘুরির পর রফা হল রাঙা মা খোরপোষ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা মাত্র পাবেন, ছেলেমেয়ে থাকবে মাতুলালয়ে দেওঘরে, তিন-চার মাস অন্তর তিনি তাদের দেখতে পাবেন। ... একদিন আমাকে ও দিদিকে নিয়ে গাড়ী করে মা চললেন সেই আত্মীয়টির বাড়ীতে, জীবন্ত দু’টি তাঁর প্রাণপুত্তলীকে বিসর্জ্জন দিতে... সেখানে বাড়ীর দরজায় পৌঁছে মা আর নামলেন না, দিদিকে প্রথমে নামিয়ে নেওয়া হ’লো। আমি কিছুতেই রাঙা মাকে ছাড়বো না, তাঁকে আঁকড়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলুম। সেই আত্মীয়টি তখন টেনে হিঁচড়ে আমায় সেই অপবিত্র কোল থেকে তাঁর পবিত্র সংসারে ছিনিয়ে নিলেন। মা মুখ চেপে চোখ বুজে অর্ধ অজ্ঞান অবস্থায় গাড়ীতে পড়ে রইলেন, তাঁকে নিয়ে গাড়ী শূন্য-পুরী গোম্স লেনে ফিরে গেল।’
অরবিন্দের পিতার মৃত্যুর সময় কাশীতে ছিলেন পিতামহী কৈলাসকামিনী ঘোষ। মা চেয়েছিলেন, তাই মাতৃভক্ত কৃষ্ণধন একদা হাজার টাকা ব্যয় করে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরগাত্রে এঁটে দিয়েছিলেন একটি সোনার পাত। প্রতিমাসে কাশীতে মাকে চিঠির সঙ্গে পাঠাতেন পঞ্চাশ টাকা। বছরে দু-বার গিয়ে দেখে আসতেন কাশীবাসী বিধবা মাকে।
তাঁর মৃত্যু-সংবাদ প্রায় বছরখানেক গোপন রাখা হয়েছিল মাতা কৈলাসকামিনীর কাছে। মাসের পর মাস যেতে যেতে পুত্রের পত্র আর না পেয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বার বার বলতে থাকেন— ‘তোমরা তার হাতের লেখা এনে দেখাও।’
অবশেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে জানাতে হয় পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ।
এদিকে অরবিন্দ বিলেত থেকে ফিরে এলে বরোদার গায়কোয়াড় তাঁকে নিযুক্ত করেন সিভিল সার্ভিসে। কাজ শুরু করেন প্রথমে সেট্লমেন্ট এবং পরে রাজস্ব বিভাগে। তাঁকে গায়কোয়াড়ের প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজও কিছু কিছু করতে হতো। কিছুকাল পরে নীরস ও কঠোর সিভিল সার্ভিস অসহ্য বোধ হলে গ্রহণ করেন শিক্ষা বিভাগের কার্যভার। নিযুক্ত হলেন বরোদা কলেজের অধ্যাপক।
বরোদা কলেজে অরবিন্দের স্নেহধন্য ছাত্র আর এন পাটকর জানিয়েছেন— ‘ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে তাঁর ছাত্র হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অভাবনীয় ছিল তাঁর শেখাবার পদ্ধতি। প্রথমে তিনি পাঠ্য বিষয়বস্তুটির সঙ্গে ছাত্রদের পরিচয় সাধনের উদ্দেশ্যে অনেকগুলি লেকচার দিতেন। তারপর টেক্সটটি পড়া শুরু করতেন এবং কঠিন শব্দ বা বাক্য থাকলে তার অর্থ বুঝিয়ে দিতেন। তারপর বিষয়বস্তুটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কয়েকটা জেনারেল লেকচার দিতেন।
কিন্তু তাঁর ক্লাস-লেকচারগুলোর চেয়েও উপভোগ্য ছিল মঞ্চের উপর তাঁর ভাষণ। কলেজের বিতর্ক-সমিতির সভায় প্রায়ই তাঁকে সভাপতিত্ব করতে হতো। তিনি যখন বলতে শুরু করতেন, কলেজের বিশাল কেন্দ্রীয় হলটিতে তিলধারণের ঠাঁই থাকত না। তিনি বাগ্মী ছিলেন না, কিন্তু অত্যন্ত উঁচুদরের বক্তা ছিলেন— তাঁর প্রতিটি শব্দই শ্রোতারা শুনতেন একাগ্র নিবিষ্টচিত্তে। সামান্যতম অঙ্গভঙ্গিও করতেন না তিনি, ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর তাঁর ওষ্ঠ থেকে বাণীর প্রবাহ নেমে আসত সহজ সুন্দরভাবে, সাবলীল সুরের মতো— যা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত।’
আর এন পাটকর খেয়াল করেন, অরবিন্দ কখনও নরম বিছানায় শুতেন না, শুতেন নারকেলের ছোবড়ার ওপর মালাবার ঘাসের মাদুর বিছিয়ে।
একদিন পাটকর তাঁকে শুধোন, অমন শক্ত বিছানায় শোন কেন?
উত্তরে অরবিন্দ স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে বললেন— ‘জানো না, আমি ব্রহ্মচারী? আমাদের শাস্ত্রে ব্রহ্মচারীর নরম বিছানা ব্যবহারে নিষেধ আছে।’
পড়তে-পড়তে তিনি এত গভীর তন্ময় হয়ে যেতেন যে, আশপাশের আর সবকিছু ভুলে যেতেন। এক সন্ধেবেলা পরিচারক এসে তাঁর টেবিলে খাবারের থালা সাজিয়ে রেখে বলে যায় ‘স্যার, খানা রাখ্খা হ্যায়।’
উত্তরে অরবিন্দ বললেন— ‘আচ্ছা।’ মুখ তুলে একবার তাকালেনও না। আধঘণ্টা পরে এঁটো বাসন নিতে এসে পরিচারক দেখে, টেবিলের থালা যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে! সে আর মনিবকে বিরক্ত না করে চুপিচুপি খবর দেয় পাটকরকে।
অরবিন্দের ঘরে গিয়ে পাটকর তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে খাবার জুড়িয়ে যাচ্ছে। মৃদু হেসে টেবিলে গিয়ে দ্রুত খেয়ে নিয়ে ফের বসলেন পড়তে।
পাটকর লিখছেন, ‘আর একটা জিনিস লক্ষ করে দেখেছিলাম— অর্থ সম্বন্ধে কোনো-রকম আকর্ষণই ছিল না তাঁর। একটা থলি ভরে তিনি একসঙ্গে তিন মাসের মাহিনা নিয়ে এসে ঢেলে রেখে দিতেন একটা বারকোশের ওপর। টাকা কখনো তালা-চাবি দিয়ে বাক্সে রাখতেন না। খরচপত্রের কোনো হিসেবও রাখতেন না তিনি।’
একদিন কথায় কথায় পাটকর তাঁকে বলেন— ‘অমন টাকা ফেলে রাখেন কেন?’
অরবিন্দ হেসে বললেন— ‘আমরা যে সৎ সহৃদয়সঙ্গে রয়েছি, এতেই কি তার প্রমাণ পাই না?’
—‘কিন্তু হিসেব তো আপনি কখ্খনো রাখেন না, কী করে টের পান যে সৎসঙ্গেই রয়েছেন?’
প্রশান্ত মুখে অরবিন্দ বললেন, ‘আমার হিসেব ভগবান রাখেন। আমার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক সেইটুকু দিয়ে, বাকিটা উনি নিজের কাছে রেখে দেন। আর যাইহোক, আমার কোনো অভাব তো ভগবান ঘটতে দেন না, তবে কেন আমি উতলা হব?’
বরোদায় অবস্থানের প্রারম্ভের দিনগুলোয় অরবিন্দ ‘ইন্দুপ্রকাশ’-এ লেখেন পর পর অনেকগুলি রাজনৈতিক প্রবন্ধ। তখন বেশ কিছুদিন যাবত কংগ্রেসের নেতারা ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট আর জনগণের কাছে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আবেদন নিবেদন জানিয়ে এসেছেন।
নরমপন্থী নেতাদের তোলা নিরামিষ সব দাবিও নাকচ করে দেয় ইংরেজ সরকার। কংগ্রেসের অধিবেশনগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে তিন-চারদিনের তামাশা। বাৎসরিক সভায় সভ্যদের লোকে ঠাট্টা করে বলে ‘কঙ্গরসে রঙ্গরস’।
প্রথম প্রবন্ধেই অরবিন্দ ঘোষণা করেন, ‘একজন অন্ধ ব্যক্তি যদি আর একজন অন্ধকে চালনা করে, তাহলে তারা দু’জনেই কি গভীর খাতে গিয়ে পড়বে না? প্রায় কোনো ভারতবাসীই একথা স্বীকার করতে চাইবেন না, বস্তুত দু’বছর পূর্বে আমিও নিজে স্বীকার করতে চাইতাম না, যে এ কথা জাতীয় কংগ্রেস সম্বন্ধে সত্য সত্যই প্রযোজ্য।’
তিনি শুরু থেকেই চাইতেন, কংগ্রেসকে বাক্-সর্বস্বতা থেকে উদ্ধার করে প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে। ক্ষান্ত থাকেননি শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা করেই, বরোদায় থাকতেই তাঁর সংযোগ বম্বের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে।
স্বামী বিবেকানন্দের দেহান্তের পূর্বেই অরবিন্দ সুদূর বরোদা থেকে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেন। তিনি বিলেতে থাকতে দেখেছিলেন, ক্ষুদ্র আইরিশ জাতি কীরূপ নাস্তানাবুদ করে দুর্ধর্ষ ইংরেজশক্তিকে। ভারতেও তেমনি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজরাজকে অতিষ্ঠ করে তোলার কথা ভাবেন। কিন্তু সে-এক এমন সময় যখন শৌখিন শিক্ষিত বাঙালি আখ্যায়িত ‘বাবু’ আখ্যায়। ইংরেজের কৃপায় সামরিক বাহিনীতে বাঙালির নেই কোনও স্থান।
অরবিন্দ তখন অন্তরঙ্গ বন্ধু লেফটেন্যান্ট মাধব রাও যাদবের সহায়তায় যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক বীর যুবককে বরোদার সৈন্যবিভাগে পদাতিকরূপে নিয়োগ করেন।
কিছুকাল পরে এই যতীন্দ্রনাথই অরবিন্দ-নির্দিষ্ট গুপ্ত সমিতি গঠন করতে আসেন কলকাতায়। তিনি স্বয়ং তাঁকে শেখান বিপ্লবের বিবিধ পাঠ ও কর্মকৌশল।
বরোদার অশ্বারোহী বাহিনী থেকে গায়কোয়াড়ের দেহরক্ষী বাহিনীতে উন্নীত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি পরিচয়পত্র দিয়ে অরবিন্দ পাঠালেন কলকাতায় সরলা দেবীর কাছে। অভিনব এই আগন্তুক— পরবর্তীকালের স্বামী নিরালম্বকে সরলা দেবী পরিচয় করিয়ে দেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের সঙ্গে।