সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
১৩০৮-এর ১৬ বৈশাখ। কলকাতার হাটখোলার দত্ত পরিবারের বৈঠকখানা রোডের বাড়িতে বসে এক আড়ম্বরপূর্ণ বিবাহ-বাসর। বর আঠাশ বছর বয়সি অরবিন্দ ঘোষ, বরোদা কলেজের অধ্যাপক। চোদ্দো বছরের কনে মৃণালিনী বসু বাগবাজারের মহাকালী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। এই বিয়ের ঘটকালি করেন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ গিরীশচন্দ্র বসু। অরবিন্দের জন্য পাত্রী-সন্ধানে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের সূত্রেই এই বিয়ের যোগাযোগ শুরু। অধ্যক্ষ গিরীশচন্দ্র বসুর বাড়িতে স্বয়ং অরবিন্দ আসেন কনে দেখতে।
অরবিন্দ-মৃণালিনীর বিবাহ-বাসরে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, লর্ড সিনহা, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী প্রমুখ প্রথিতযশা আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ। বিয়ের অনুষ্ঠান অবশ্য একেবারে ঝঞ্ঝাটমুক্ত ছিল না। অরবিন্দ ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ও তাঁর ভাবী শ্বশুর ভূপালচন্দ্র বসু হিন্দু সমাজের— আবার দু’জনেই বিলেত-ফেরত। বিপত্তি দেখা দেয় এই নিয়ে যে, বিলেত প্রত্যাগত হওয়ার কারণে— উভয়কেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু কিছুতেই রাজি হননি অরবিন্দ। তিনি শুধু বলেন, ‘বিলেত যাওয়া কোনও অপরাধের নয়।’
শোনা যায়— শেষে সমাজ ও শাস্ত্রের মুখরক্ষা করেন নাকি এক চাণক্য-অনুরক্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিত, তাঁর পরামর্শে সমাধান সূত্র বেরয় কাঞ্চন-মূল্যের বিনিময়ে।
বিয়ের পর অরবিন্দ নব-পরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলেন দেওঘর, পরে নৈনিতাল পাহাড়ে এবং সেখান থেকে ফিরে যান কর্মস্থল বরোদায়।
দেওঘরে মামাবাড়িতে কাটান কয়েকটি দিন, সঙ্গে ছিলেন পত্নী মৃণালিনী ও ছোটবোন সরোজিনী। কিন্তু পত্নী ও বোনের মধ্যে দেখা দেয় তালমিলের অভাব। মৃণালিনীর খুঁত ধরতেন। কখনও কথা শোনাতেন। তিনি স্বামীকে সরোজিনীর বিষয়ে কিছু জানালে বা অভিযোগ করলে অরবিন্দ বলতেন— ধৈর্য ধরতে, সহ্য করতে।
একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় মৃণালিনীর। উত্তপ্ত কণ্ঠে অরবিন্দকে জানালেন— তিনি যদি সরোজিনীকে কিছুই না বলেন তাহলে তিনি আর সংসার করতে পারবেন না।
সব শুনে শান্ত ধীরকণ্ঠে অরবিন্দ বললেন— ‘তুমি যেভাবে চাও সেভাবে কি কারও আচরণের পরিবর্তন হতে পারে? আমি তোমাকে বা সরোজিনীকে যদি তিরস্কার করে বলি তাহলে তোমরা কি তখনই খাঁটি হয়ে যাবে?’
এরপর অবশ্য পরিবর্তন আসে মৃণালিনীর জীবনদৃষ্টিতে।
অরবিন্দের বাংলা শিক্ষক দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন ‘জ্যোতিষ শাস্ত্রে অরবিন্দের প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। মানব জীবনের উপর গ্রহ নক্ষত্রাদির প্রভাব আছে ইহা তিনি স্বীকার করিতেন। ...আমি অরবিন্দের অনুরোধে বারাসত গভর্নমেন্ট স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ভট্টাচার্য্য মহাশয়কে দিয়া তাঁহার একখানি জন্ম-পত্রিকা প্রস্তুত করাইয়া লইয়াছিলাম।’
সেই ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছিলেন, ‘গার্হস্থ্য জীবনের সুখ তাঁহার (অরবিন্দের) অদৃষ্টে বড় নাই।’
চার বছর পরে অরবিন্দ বরোদা থেকে পত্নীকে যেসব চিঠি লেখেন সে-সম্বন্ধে গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী জানান— ‘অরবিন্দ যখন তাঁহার স্ত্রীকে এই চিঠি লিখিতেন... এই সময় তাঁহারা উভয়ে মাত্র চার বৎসর চার মাস বিবাহিত জীবন যাপন করিয়াছেন। চিঠিতে দেখিতে পাই, অরবিন্দের স্ত্রী অভিযোগ করিতেছেন যে— অরবিন্দের কোনও উন্নতি হইল না। অরবিন্দ এই অভিযোগের উত্তরে উন্নতির পথ বাতলাইয়া দিতেছেন। অরবিন্দের দাম্পত্য জীবনের কথা কেহ কিছুই স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন না। ইহা, এখনও পর্যন্ত আলো-আঁধারে জড়াইয়া অস্পষ্ট এবং শুধু গল্পগুজবের মধ্য দিয়া লোকমুখে রটিত। সুতরাং তাহা সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু এই চিঠি অরবিন্দের দাম্পত্য জীবনের উপর অনেকটা আলোকপাত করিয়াছে।’
পত্নীকে লেখা চিঠিতে অরবিন্দ নিজের তিনটি ‘পাগলামি’র কথা একের পর এক নম্বর দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। প্রথম ‘পাগলামি’ সম্বন্ধে লেখেন— ‘এই দুর্দ্দিনে সমস্ত দেশ আমার দ্বারে আশ্রিত। আমার ত্রিশ কোটি ভাইবোন এই দেশে আছে, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে অনাহারে মরিতেছে, অধিকাংশই কষ্টে ও দুঃখে জর্জ্জরিত হইয়া কোন মতে বাঁচিয়া থাকে। তাহাদের হিত করিতে হয়।’
দ্বিতীয়, ‘... সম্প্রতি ঘাড়ে চেপেছে; পাগলামিটা এই, যে-কোনও মতে ভগবানের সাক্ষাদ্দর্শন লাভ করিতে হইবে। ... ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে তাঁহার অস্তিত্ব অনুভব করিবার, তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার কোনও-না- কোনও পথ থাকিবে। সে পথ যতই দুর্গম হোক আমি সে পথে যাইবার দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়া বসিয়াছি। হিন্দু ধর্ম্মে বলে— নিজের শরীরে নিজের মনের মধ্যে সেই পথ আছে। যাইবার নিয়ম দেখাইয়া দিয়াছে, সেই সকল পালন করিতে আরম্ভ করিয়াছি। এক মাসের মধ্যে অনুভব করিতে পারিলাম, হিন্দুধর্ম্মের কথা মিথ্যা নয়। যে যে চিহ্নের কথা বলিয়াছে সেই সব উপলব্ধি করিতেছি। এখন আমার ইচ্ছা তোমাকেও সেই পথে নিয়া যাই।’
তৃতীয়, ‘পাগলামি এই যে, অন্য লোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলা মাঠ ক্ষেত্র বন পর্ব্বত নদী বলিয়া জানে। আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মা’র বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয়, তাহা হইলে ছেলে কী করে? নিশ্চিন্তভাবে আহার করিতে বসে, স্ত্রী পুত্রের সহিত আমোদ করিতে বসে— না, মাকে উদ্ধার করিতে দৌড়াইয়া যায়? আমি জানি, এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করিবার বল আমার পায়ে আছে— শারীরিক বল নয়, তরবারি বন্দুক নিয়া আমি যুদ্ধ করিতে যাইতেছি না। জ্ঞানের বল। ক্ষাত্রতেজ একমাত্র তেজ নহে, ব্রহ্মতেজও আছে। সেই তেজ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।’
অরবিন্দের এ পত্রাংশের অনুষঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে— বহুকাল পরের একটি ঘটনা। তখন ঋষি অরবিন্দ জনকোলাহল থেকে দূরে— রাজনীতির ধূলিধূসর প্রাঙ্গণের বাইরে— সুদূর পণ্ডিচেরিতে ধ্যানের আসনে আসীন। দিলীপকুমার রায় তাঁর কাছে এসেছেন দীক্ষা নেবার মানসে। বললেন, ‘দেশে ফিরে বন্ধুবান্ধব হ’ল অগুন্তি— বোধহয় টাকাকড়ি, অবসর ও মেশবার ক্ষমতা ছিল বলে। কিন্তু আশ্চর্য ভগবানকে নিয়ে ‘আধ্যাত্মিক’ ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে বড় কাউকে মাথা ঘামাতে দেখলাম না। আমার চেনাশোনাদের মধ্যে ভগবানকে চাইতে দেখলাম শুধু এক ইংরেজ বন্ধুকে— রোনাল্ড নিক্সন। সেই আমাকে প্রথম বলল যে, আপনি মস্ত যোগী, পড়ালো আপনার বইটই। তারপর থেকে কেবলই মনে হয় আপনার কাছে যদি দীক্ষা পাই তবেই এ দুর্গম পথের পথিক হ’লেও হতে পারি— নইলে— অসম্ভব। কিন্তু ওদিকে জীবনও যে আবার টানে। যেমন ধরুন বলছিলাম, সামাজিক আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব, স্নেহ-ভালোবাসা এইসব। প্রশ্ন জাগে— যোগ করতে হলে কি এসব ছাড়তেই হ’বে?’
শ্রীঅরবিন্দ খুব মন দিয়ে শুনলেন, শুনতে শুনতে তাঁর মুখে ফুটে উঠে মৃদু-স্নিগ্ধ হাসি— করুণার্দ্র চোখ। ধীরকণ্ঠে বললেন— ‘কি জানো? সামাজিক আদান-প্রদান বন্ধুত্ব স্নেহ-ভালোবাসা, দরদ এইসবের ভিত হল প্রাণগত— আর এসবের কেন্দ্র হল আমাদের অহংবুদ্ধি। সচরাচর মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে অন্যে আমায় ভালোবাসছে এতে সুখ আছে ব’লে, অন্যের সঙ্গে মাখামাখি হ’লে আমাদের অহং যে ফুলে ওঠে তাতে মনটা খুশি হয় বলে— প্রাণশক্তির দেওয়া-নেওয়ায় আমাদের ব্যক্তিরূপ খোরাক পায়— উৎফুল্ল হয় বলে। এছাড়া আরও স্বার্থসংকীর্ণ উদ্দেশ্য মিশেল থাকে। অবশ্য উচ্চতর আধ্যাত্মিক, আন্তর, মানসিক ও প্রাণিক উপাদানও থাকে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ নমুনার মধ্যেও পাঁচমিশেলি থাকেই থাকে। এইজন্যেই হয় কি, অনেক সময় হয়তো দেখা গেল কারণে বা অকারণে সংসার, জীবন সমাজ, প্রিয়পরিজন, লোক-হিতৈষণা— সবই ঠেকল বিস্বাদ— জাগালো অতৃপ্তি। মনে রেখো, লোক-হিতৈষণার মধ্যেও অহংবুদ্ধি কায়েমি হয়ে থাকতে পারে।’
ফিরে আসা যাক, অগ্নিযুগের দিনগুলোয় অরবিন্দ-পত্নী মৃণালিনীর কথকতায়। ১৯০৮ সালের ২৯ এপ্রিল অরবিন্দ কলকাতার স্কটলেনের বাড়ি ছেড়ে ৪৮ নং গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে (নীচতলায়) আসেন।
২ মে সকালে সেখানে গ্রেপ্তারের বর্ণনা স্বয়ং ‘কারাকাহিনী’তে লেখেন— ‘শুক্রবার রাত্রিতে আমি নিশ্চিন্তমনে ঘুমাইয়াছিলাম, ভোরে প্রায় ৫টার সময় আমার ভগিনী সন্ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া নাম ধরিয়া ডাকিল; জাগিয়া উঠিলাম। পরমুহূর্তে ক্ষুদ্র ঘরটি সশস্ত্র পুলিশে ভরিয়া উঠিল— সুপারিন্টেন্ডেট ক্রেগান, ২৪-পরগনার ক্লার্ক সাহেব, সুপরিচিত শ্রীমান বিনোদকুমার গুপ্তের লাবণ্যময় ও আনন্দদায়ক মূর্ত্তি, আর কয়েকজন ইন্সপেক্টর, লালপাগড়ী, গোয়েন্দা খানাতল্লাসীর সাক্ষী। হাতে পিস্তল লইয়া তাহারা বীরদর্পে দৌড়াইয়া আসিল, যেন বন্দুক কামানসহ একটি সুরক্ষিত কেল্লা দখল করিতে আসিল। শুনিলাম, একটি শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ আমার ভগিনীর বুকের উপর পিস্তল ধরে; তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই। বিছানায় বসিয়া আছি, তখনও অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থা। ক্রেগান জিজ্ঞাসা করিলেন— অরবিন্দ ঘোষ কে, আপনিই কি? আমি বলিলাম— আমিই অরবিন্দ ঘোষ। অমনি আমাকে গ্রেপ্তার করিতে একজন পুলিশকে বলেন। তাহার পর ক্রেগানের একটি অতিশয় অভদ্র কথায় দুজনের অল্পক্ষণ বাগ্বিতণ্ডা হইল। আমি খানাতল্লাসীর ওয়ারেন্ট চাহিলাম, পড়িয়া তাহাতে সহি করিলাম। ওয়ারেন্টে বোমার কথা দেখিয়া বুঝিলাম, এই পুলিশ সৈন্যের আবির্ভাব মজঃফরপুরের খুনের সহিত সংশ্লিষ্ট। কেবল বুঝিলাম না— আমার বাড়ীতে বোমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাইবার আগেই body warrant-এর অভাবে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে। তবে সেই সম্বন্ধে বৃথা আপত্তি করিলাম না। তাহার পরেই ক্রেগানের হুকুমে আমার হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি দেওয়া হইল। একজন হিন্দুস্থানী কনস্টেবল সে দড়ি ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া রহিল।’
দক্ষিণেশ্বর থেকে কিছু মাটি সংগ্রহ করে রাখা ছিল একটি মাটির ভাঁড়ে। পুলিস উল্লসিত সেই ভাঁড়ের মাটি বোমা তৈরির উপকরণ মনে করে। স্বামীর অমন গ্রেপ্তার-দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালেন মৃণালিনী।
অরবিন্দ-জায়া বলেছেন— ‘তখন স্পষ্ট আমার প্রতীয়মান হইল যে, তাঁহার সঙ্গচ্ছিন্ন আমার জীবনে মৃত্যুই একমাত্র পথ। কিন্তু আমার মৃত্যুবরণ হইল না। এই সময় সুধীরা আসিয়া আমাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করিল।’
অনিশ্চয়তার অন্ধকারে মৃত্যুর মুখোমুখি অরবিন্দ। চূড়ান্ত উদ্ভ্রান্ত পত্নী মৃণালিনী। বান্ধবী সুধীরা তাঁর মানসিক প্রশান্তির জন্য নিয়ে গেলেন শ্রীমা সারদা দেবীর কাছে।
শ্রীমা সব কথা মন দিয়ে শুনে বললেন— ‘চঞ্চল হও না, চাঞ্চল্যে কিছু লাভ নেই। তোমার স্বামী শ্রীভগবানের আশ্রিত পুরুষ, ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি সত্বর নিষ্পাপ প্রমাণে মুক্ত হয়ে আসবেন।’
কীভাবে মানসিক অশান্তি দূর হবে, কেটে যাবে মনের অন্ধকার— এ প্রশ্ন শুধানোয় শ্রীমা সারদা দরদীকণ্ঠে অরবিন্দ-জায়াকে বললেন— ‘সব সময় ঠাকুরের বই পড়বে, আর এখানে মাঝে মাঝে আসবে, তাহলেই মনের অন্ধকার পালাবে।’
সুধীরার সঙ্গে মাঝে মাঝে শ্রীমাকে দর্শন করতে যেতেন মৃণালিনী দেবী। শ্রীমা ‘বউমা’ সম্বোধনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন স্নেহস্নিগ্ধ অন্তরে।
এক সময় মুক্তি পান অরবিন্দ,— ভবিতব্যের অমোঘ বিধানে বিদায় নেন পণ্ডিচেরিতে। ‘মেনু’র গভীর দুঃখের দিনে বড় সহায় ছিলেন সই সুধীরা। শ্রীমা-র স্নেহসিক্তা সুধীরা সেই সময় এক চিঠিতে মৃণালিনীকে লেখেন—
‘স্বামীপরিত্যক্তা এই কথাটি আর কখনও উল্লেখ করিও না, আমার মনে ভয়ানক লাগে, যে দেবতা প্রেমময়, যিনি সকলকে ভালবাসেন, সকলের জন্য যিনি সর্বত্যাগী তিনি তাঁহারই সর্বস্বকে ভালোবাসেন না, এ কথা আমি বলিতে পারি না। বুদ্ধদেব যখন সংসার ত্যাগ করিয়া যান তখন বলিয়াছিলেন যে, গোপাকে বলিও তাহার ভালোবাসাই আমাকে সংসার ত্যাগ করিতে বলিতেছে। আরও বলিও তাহাকে ভালোবাসি বলিয়াই এ জগতকে ভালোবাসিতে শিখিয়াছি ইত্যাদি। মানুষের ভালোবাসা যখন উচ্চতর সোপানে আরোহণ করে তখন সেভাবেই আলাদা, আমরা মর্তের মানুষ তাহা বুঝিতে পারি না। আশা করি, তুমি যখন সেই সোপানে উঠিবে, তখন বুঝিবে কী ভালোবাসা তুমি পাইতেছ। সে মিলনে আর কখনও বিরহ আসিবে না... তবে সাংসারিক পক্ষে লোকচক্ষে, তুমি স্বামী-পরিত্যক্ত বটে, কারণ সংসারে স্বামীকে যেরূপ পায় তুমি সেরূপে পাও নাই, তাই সংসারী লোক তা-ই ভাবিতে পারে। তুমি কখনও তাহা ভাবিতে পার না কারণ তুমি তো সংসারী নও, তুমি সংসারের অনেক উচ্চে। এখনও বুঝিতে পার না যে কী শক্তি লইয়া তুমি জন্মগ্রহণ করিয়াছ, কোন অংশে তোমার জন্ম— তাই এত কষ্ট ভোগ করিতে হইতেছে। যদি না সেই মহৎ অংশে তোমার এ জন্ম হয়, তবে এত শক্তিমান মহতের সঙ্গে তোমার যোগ হইত না।’
শ্রীমা সারদার কাছে মৃণালিনীর সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে নিবেদন— তাঁর ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন। আর্জি জানালেন দীক্ষা নেবার। একদিন সুধীরা বসু শ্রীমাকে অনুরোধ জানান, তিনি যেন মৃণালিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা দেন। এ কথায় শ্রীমা সারদা বললেন— ‘বউমার আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নেবার প্রয়োজন নেই।’
এদিকে, কন্যার দীক্ষা নেবার ইচ্ছে শুনে পিতা ভূপালচন্দ্র বসু এ বিষয়ে শ্রীঅরবিন্দের অভিমত জানতে চিঠি লেখেন পণ্ডিচেরিতে। সেই চিঠির উত্তরে শ্রীঅরবিন্দ জানান, মৃণালিনীর দীক্ষা নেবার প্রয়োজন নেই, তাঁর প্রয়োজনীয় যা কিছু আধ্যাত্মিক সাহায্য তিনিই প্রেরণ করবেন।
১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে মৃণালিনী দেবী আক্রান্ত হন কঠিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে। পূর্বে কিছুদিন যাবত ভুগছিলেন চোখের সমস্যায়। তখন কলকাতায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভয়াবহ মহামারীর আকার নিয়েছে। জ্বর তাঁর ক্রমশ বেড়ে চলে। খ্যাতনামা চিকিৎসক বারিদবরণ মুখোপাধ্যায় আসেন তাঁর চিকিৎসায়। জ্বরের ঘোরে মৃণালিনী একদিন হঠাৎ বলে উঠেন, তাঁকে লেখা অরবিন্দের চিঠিপত্র রয়েছে যে বাক্সে সেটি যেন তালাবন্ধ করে ফেলে দেওয়া হয় গঙ্গায়। বিদায় বেলায় অভিমান, না স্বামীর নিরাপত্তা ভাবনা? এদিকে, তাঁর গুরুতর অসুখের সংবাদে উদ্বিগ্ন শ্রীমা সারদা। ১৭ ডিসেম্বর সকালে মৃত্যু মৃণালিনীর। সেদিন বিকেলে সুধীরা বসু মৃণালিনী দেবীর গর্ভধারিণী মাকে নিয়ে শ্রীমায়ের বাড়ি ‘উদ্বোধনে’ গিয়েছিলেন। শ্রীমা তখন ছিলেন ধ্যানস্থা, কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলে সুধীরা ও মৃণালিনীর মাকে দেখে বললেন, ‘তোমরা এসেছ? আমি এতক্ষণ বউমাকে দেখছিলাম। ও তো শাপভ্রষ্টা দেবী ছিল, সামান্য কর্মফল ছিল তাই ভোগ করার জন্য তোমাদের মেয়ে হয়ে জন্মেছিল।’ সেদিন পণ্ডিচেরিতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। অরবিন্দের ঘরে রাখা মৃণালিনীর ছবিটি হঠাৎ পড়ে ভেঙে যায় খান খান হয়ে। কিছুক্ষণ পরেই টেলিগ্রামে এল পত্নীর প্রয়াণ সংবাদ। মৃণালিনীর অগ্রজ সৌরীন বসু তখন পণ্ডিচেরিতে। তিনি সেখান থেকে তাঁর মা-কে এক চিঠিতে লেখেন, আজ পৃথিবীর নবম আশ্চর্য দেখলাম। পাষাণেও জল দেখলাম। মৃণালিনীর মৃত্যুসংবাদ বহনকারী টেলিগ্রাম হাতে করে অরবিন্দ বসে আছেন, আর তাঁর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছ।