সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
দেবতাদের জন্য দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে কচ ফের ফিরে আসেন স্বর্গে। তেমনি অরবিন্দের একদা মন্ত্রশিষ্য হেমচন্দ্র কানুনগো ১৯০২ সালে বোমা তৈরি শেখার জন্যে গিয়েছিলেন ইউরোপ। দীর্ঘদিন ছিলেন প্যারিসে। গুপ্ত-সমিতির নিয়মপ্রণালী ও বোমা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ১৯০৮ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফিরে আসেন বম্বে।
সেখান থেকে নাসিক, পুনে হয়ে নাগপুরে গিয়ে যোগাযোগ করেন সেখানকার গুপ্ত সমিতির সঙ্গে। তিনি লিখলেন — ‘কয়েকদিন মাত্র আগে সুরাট কংগ্রেস থেকে ফেরবার পথে অরবিন্দবাবু নাগপুরে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার প্রভাবে নাগপুরে শিক্ষিত মহলের রাষ্ট্রনৈতিক মতটা একটু উগ্র হয়ে উঠেছিল। সে বক্তৃতায় বিশেষ করে ছিল পূর্ণ স্বাধীনতার বাণী, অর্থাৎ কি না ভারত ভারতবাসীরই জন্য, আর ইংরেজের সঙ্গে ভারতের কোনও সম্পর্ক না রাখা। বিপ্লববাদের শুরুতে বাংলায় যেমন বৈপ্লবিক গুরু বলে মারহাট্টাদের ওপর আমাদের একটা বড় ধারণা ছিল, নাগপুরে বিপ্লববাদী আর চরমপন্থী যে ক’জন ছিলেন তাঁদের সেই রকম বাঙালীদের ওপর একটা ভারী আশাপ্রদ ধারণা জন্মেছিল।’
অরবিন্দকে পুনে-যাত্রার অভিমুখে ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন বারীন ঘোষ। মানিকতলা বোমার বাগানে এসে তিনি যা বললেন তা লিখেছেন বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘সুরাটে নরম, গরম, অতি-গরম, সবরকম নেতারাই একত্র হইয়াছিলেন। তাঁহাদের সহিত কথাবার্তা কহিয়া বারীন যাহা সার-সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল তাহা সে এক কথায় বলিয়া দিল চোর, বেটারা চোর।
সমস্বরে আমরা ধ্বনি করিয়া উঠিলাম—
কেন? কেন? কেন?
বারীন বলিল— এতদিন স্যাঙ্গাতেরা পট্টি মেরে আসছিলেন যে, তাঁরা সবাই প্রস্তুত; শুধু বাংলাদেশের খাতিরে তাঁরা বসে আছেন। গিয়ে দেখি না সব ঢুঁ ঢুঁ। কোথাও কিছু নেই; শুধু কর্তারা চেয়ারে বসে বসে মোড়লি কচ্ছেন। দু’একটা ছেলে একটু আধটু কাজ করবার চেষ্টা করছে, তা’ও কর্তাদের লুকিয়ে। খুব ক’ষে ব্যাটাদের শুনিয়ে দিয়ে এসেছি!
এতদিন শুনিয়া আসিতেছিলাম বর্গীরা একেবারে খাপ খুলিয়া বসিয়া আছেন; আর আজ এইসব ফক্কিকারের কথা শুনিয়া মনটা বেশ খানিকটা দমিয়া গেল। কিন্তু বারীন বলিল—
কুছ পরোয়া নেই। ওরা যদি সঙ্গে এল তো এল; আর তা যদি না হয়— তাহলে একলা চল রে। আমরা বাংলাদেশ থেকেই পাঁচ বছরের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে দেব। লেগে যাও আজ থেকে ছেলে জোগাড় করতে।’
ইউরোপ ফেরত হেমচন্দ্রের এই সময়েই পরিচয় উল্লাসকর দত্ত ও উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে। হেমচন্দ্র জানিয়েছেন, ‘যে সময়ের কথা লিখছি, (১৯০৮) তার মাস কতক আগে শ্রীমান উল্লাসকর প্রেসিডেন্সী কলেজে সাহেব ঠেঙিয়ে কোনো গতিকে বারীনের হাতে এসে পড়েছিল। আমার সঙ্গে প্রথম দর্শনেই গান গেয়ে হেসে-খেলে নেহাত আপনজন হয়ে গেছল। যাইহোক, আমার মনে হয়, উল্লাসের মতো এত সরল, মহৎ, কপটতার লেশমাত্রহীন, ভাবপ্রবণ যুবককে বৈপ্লবিক তাণ্ডবলীলার কর্মী করা যে নিতান্ত হৃদয়হীনতার ও নির্বুদ্ধিতার কাজ হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
উল্লাসভায়ার সঙ্গে আলাপের দু-একদিন পরে স্বনামধন্য শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক অদ্ভুত বেশে দেখা দিলেন। তাঁর শ্রীচরণ দু’খানি ছিল পাদুকাহীন। শ্রীঅঙ্গের অধোভাগে ছিল মুক্তকচ্ছ করে পরা গৈরিক বাস; তদূর্ধ্বে গৈরিক পাঞ্জাবী; আর সযত্নে মুণ্ডিত-মস্তকে ছিল টিকি। দাড়ি-গোঁফ যে ছিল না সে কথা বলাই বাহুল্য। এ হেন ভণ্ডামীর ঠাট দেখে ভক্তি উথলে না উঠলেও, (সত্য বলতে কি, বরং ভয়ঙ্কর বিটকেল বলে মনে হলেও) একটুখানি আলাপের পর মনে করতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, বাংলাদেশে গুপ্তসমিতির সভ্য হবার মানুষ যদি কেউ থাকে তো এই ইনিই তাদের মধ্যে উপযুক্ততম। আলাপের পর দেখেছিলাম, অন্য বিষয়ে যেমন, ভোজনেও ওঁর toleration-এর অন্ত ছিল না। অ-হিন্দুর স্পৃষ্ট, প্যাঁজ দিয়ে রাঁধা মাংস, কিছুতেই তাঁর অরুচি বলতে শুনিনি।’
তখন বিষ্ণুভাস্কর লেলেকে কলকাতা থেকে এক চিঠিতে বারীন ঘোষ লেখেন— ‘তুমি একবার বাঙ্গলায় এসো, আমি পাথেয় দেব।’
১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেলে এলেন কলকাতায়, উঠলেন অরবিন্দের স্কট্স লেনের বাসায়।
মানিকতলা বাগানে আলাপ উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে। বেদান্ত প্রতিপাদ্য জ্ঞান-পন্থার কথা আর ব্রহ্মবস্তুই চরম বস্তু বলে উপেন্দ্রনাথ তর্ক জুড়ে দিতেন লেলের মন্তব্যে। লেলে বলতেন ‘দেখো, অরূপ সত্য, কিন্তু রূপও সত্য— আমি দেখেছি।’
বারীন্দ্রকুমার লিখছেন, ‘বেলুড় মঠে একদিন লেলে গিয়া ব্রহ্মানন্দ স্বামীর সহিত ঘরে দুয়ার দিয়া সাধনায় বসিয়াছিলেন, তাঁহার সম্বন্ধেও লেলের খুব উচ্চধারণা ছিল। তখন বাগানের কাজ জোর কদমে চলিয়াছে, বৈদ্যনাথ জংশনের আড্ডাও দুই একমাস হইল আরম্ভ হইয়াছে। লেলেকে বাগানে আনিয়াছিলাম, তাঁহাকে ভিতরের খবর কিছুই দিই নাই বটে, কিন্তু তিনি সবই টের পাইয়াছিলেন। তিনি বুঝিলেন, এরা না-জানি কী একটা দানবে কাণ্ড বাধাইয়া বসিবে, পরিণাম বিচার না করিয়া আপনাদের ক্ষুদ্র অহমিকার শক্তিতে অন্ধ-বিশ্বাসী এরা দৃঢ় ত্বরিৎ পদে চলিয়াছে, একটা সর্বনাশা লক্ষ্যে— নিশ্চিত মৃত্যুর কবলে।’ যোগী বিষ্ণু ভাস্কর লেলে তখন বারীন ঘোষকে বললেন— ‘দেখো, তোমরা এ পথ কীসের জোরে ধরেছ? ভারত স্বাধীন একদিন হবেই, তা অনিবার্য; কাল প্রাতে উদয়াচলের কোলে সোনার থালা সূর্য উঠবে, এ যেমন অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী, ভারতের ভাবী স্বাধীনতাও তাই। কিন্তু এ পথে নয়।’
বারীন শুধোন— তবে কোন পথে?
লেলে বললেন— দেশকে— মানুষকে মুক্ত করতে হলেই কি তা রক্তারক্তি ছাড়া হয় না? ভারত বিনা রক্তপাতেই মুক্ত হবে।
বারীন জিজ্ঞেস করেন— কী করে?
লেলে— কী করে, তাই যদি দেখবে তো আমার সঙ্গে এসো। একটা নির্জন পার্বত্য গুহায় আমি তোমায় বসিয়ে দেব, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা এমন করে দেবো, তুমি সেখানে বসেই সব পাবে। ছয় মাস সেখানে সাধনা করো; আমি বলছি, ভগবানের আদেশ পাবে। যারা দেশের নেতা হতে যাচ্ছে, এত কোটি মানুষের ভাগ্য হাতের মুঠোয় নিতে যাচ্ছে, তাদের অন্ধ হয়ে কাজ করলে তো চলবে না। দেখে পথ চলো, ভগবানের আদেশ নিয়ে পথ চলো, তাহলে ভুল আর হবে না, যাঁর কাজ তিনি শক্তি দেবেন, পথ দেখাবেন।
বারীন বললেন— তা কী করে হয়? আমি কত মানুষের কাছে হাজার হাজার টাকা নিয়েছি, গীতা ও অসি ছুঁয়ে শপথ করেছি, যতদিন দেহে প্রাণ আছে, ততদিন আমার এই ব্রত। আমি ছয় মাসের জন্য কী করে কাজ ছাড়তে পারি?
লেলে— কাজ আমি ছাড়তে বলছি নে, আদেশ পেয়ে তুমি যা ইচ্ছা কোরো, তখন আমি কোনও আপত্তি করবো না।
বারীন— তা হয় না।
লেলে— আচ্ছা, তিন মাসের জন্যে এসো, আমি কথা দিচ্ছি, তিন মাসের মধ্যেই ভগবানের বাণী শুনতে পাবে।
বারীন— আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তিন মাসের জন্যেও কাজ ছাড়তে পারিনে।
লেলে— শিগগির তোমাদের সামনে ভীষণ বিপদ আসছে।
বারীন— কী? মৃত্যু? না হয় ঝুলিয়ে দেবে, তার জন্যে তো প্রস্তুত হয়েই এ কাজ করতে নামা।
লেলে— সে বিপদ মৃত্যুর চেয়েও ভীষণ।
বারীন্দ্রকুমার শুনলেন না বিষ্ণুভাস্কর লেলের অত্যাশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি যখন কিছুতেই কর্ণপাত করলেন না তাঁর আগাম সাবধান হুঁশিয়ারি— তখন লেলে ফের বোঝাতে লাগলেন ধীরস্থির যুক্তিনিষ্ঠ উপেন্দ্রনাথকে।
‘লেলের কথায় প্রায় ভিজিয়া উপেন সন্দেহ-দোলায় দুলিতে লাগিল,’ মন্তব্য বারীন্দ্রকুমারের। এবার শোনা যাক এ সম্বন্ধে উপেন্দ্রনাথের বক্তব্য। তিনি লিখেছেন, ‘১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধু (লেলে) মানিকতলা বাগানে আসিয়া উপস্থিত হন। দুই-চারদিন আমাদের সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া তিনি বলিলেন— তোমরা যে পন্থা ধরিয়াছ তাহা ঠিক নহে। অশুদ্ধ মন লইয়া এ কাজে লাগিলে খানিকটা অনর্থক খুনোখুনির সম্ভাবনা। এ অবস্থায় যাহারা দেশের নেতৃত্ব করিতে চায়, তাহাদের অন্ধের মত কাজ করা চলিবে না। ভবিষ্যতের পর্দা যাঁহাদের চোখের কাছ হইতে কতটা সরিয়া গিয়াছে, ভগবানের নিকট হইতে যাঁহারা প্রত্যাদেশ পাইয়াছেন, তাঁহারাই এ কাজের যথার্থ অধিকারী। তোমাদের মধ্যে জন কয়েককে এই প্রত্যাদেশ পাইবার জন্য সাধনা করিতে হইবে।
সাধনার ফরমাশ শুনিয়া ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। প্রত্যাদেশ না অশ্বডিম্ব! ইংরেজের সহিত যুদ্ধ করিব তাহার মধ্যে আবার ভগবানকে লইয়া এত টানাটানি কেন?
সাধু বলিলেন— সকলের জন্য এ সাধনা নয়! শুধু নেতাদের জন্য। যাহারা দেশের লোককে পথ দেখাইবে, তাহাদের নিজেদের পথটা জানা চাই। দেশ স্বাধীন করিতে হইলেই যে খুব খানিকটা রক্তারক্তি দরকার, এ কথাটা সত্য নাও হইতে পারে।’
‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখনকার মনের অবস্থা সম্বন্ধে জানান— ‘বিনা রক্তপাতে যে দেশোদ্ধার হইবে এ কথাটা আমাদের নিতান্ত আরব্য উপন্যাসের মত মনে হইল...সে-দিন সাধু চলিয়া যাইবার পর আমাদের মধ্যে বিষম তর্কাতর্কি বাধিয়া গেল। বারীন ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল— কিছুতেই নয়। কাজ আমি ছাড়ব না। বিনা রক্তপাতে ভারত উদ্ধার— এটা ওঁর খেয়াল! সাধুর আর সব কথা মানি, শুধু ঐটে ছাড়া।
আমার মনটা কিন্তু সাধুর কথায় বেশ একটু ভিজিয়াছিল; দেখাই যাক না, রাস্তাটা যদি কোনও রকমে একটু পরিষ্কার হয়! নিজের সঙ্গে বেশ একটা বোঝাপড়া না হইলে কোনও কাজেই যে মন যায় না! আমি আর দুই-একটি ছেলেকে লইয়া সাধুর সঙ্গে যাইব বলিয়া স্থির করিলাম। সাধু আর একদিন বারীনকে বুঝাইতে আসিলেন কিন্তু পরের উপদেশ লইবার সু-অভ্যাস বারীনের একেবারেই নাই। কোন রকমে বারীনকে বাগাইতে না পারিয়া শেষে সাধু বলিলেন— দেখো, এ রাস্তা যদি না ছাড় তো তোমাদের অল্পদিনের মধ্যে ভীষণ বিপদ অনিবার্য।...
সেদিনের সভা ঐখানেই ভঙ্গ হইল। সাধু ফিরিয়া যাইবার দিন স্থির করিলেন। কিন্তু সেদিন যতই নিকটবর্তী হইয়া আসিল, আমার পা-ও যেন ততই বাগান ছাড়িয়া উঠিতে চাহিল না। স্ত্রী-পুত্র, ঘর-বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়াছি, সেটা তত কঠিন বলিয়া মনে হয় নাই; কিন্তু যাহারা আমাদের দেখিয়া মা-বাপের স্নেহ, ভবিষ্যতের আশা, এমনকী প্রাণের মমতা পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়াছে, তাহাদের ছাড়িয়া আজ কোথায় পালাইব?’
উপেন্দ্রনাথের মতো মহাবিপ্লবীর এই মনের সন্ধান করতে গিয়ে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী বলেছেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র সাংসারিক জীব, যারা ফুলের ঘায়ে মূর্চ্ছা যাই, মশা মারতে কামান পাতি; এবং আমরা বলতে আধুনিক বাঙালী, যারা স্বরাজলাভের জন্য উদগ্রীব কিন্তু প্রায়ই ভুলে যাই যে মনের স্বরাজ লাভ করাই বাইরে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান ও প্রথম সোপান। এই বই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ও বিশ্বাস করবার সাহায্য করে যে, এই প্রত্যক্ষ জড়পিণ্ড গণ্ডগোলপূর্ণ বস্তু জগতের অন্তরালে মন নামক একটি চিৎপদার্থ আছে, যা আগুনে পোড়ে না, জলে ডোবে না, আশা ছাড়ে না ও লক্ষ্য ভোলে না।’
মানিকতলার মুরারিপুকুর বাগানে বারীন্দ্রকুমার ও উপেন্দ্রনাথকে অনেক বুঝিয়েও সহিংস সশস্ত্র পথের পরিবর্তন করাতে না পেরে বেদনাহত হয়েছিলেন লেলে। অবশেষে বিদায়বেলায় প্রফুল্ল চাকীকেও বারংবার সমঝানোর চেষ্টা করেন— বিভীষিকা-পন্থার পথ পরিত্যাগ করতে। কিন্তু নিয়তির উদভ্রান্ত অভিঘাতে মানুষ কী তীব্রভাবে ধাবমান নির্দিষ্ট ভবিতব্যের দিকে! পরবর্তীকালে সেই হাহাকারই শোনা যায় বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমারের কণ্ঠে— ‘লেলে যাইবার সময়ে আমাকে ও উপেনকে না পাইয়া প্রফুল্ল চাকীকে লইয়া চলিলেন। আমি আপত্তি করি নাই, কিন্তু উপেন তাহাকে বুঝাইয়া বুঝাইয়া আধপথ হইতে ফিরাইয়া আনিল। তখন মরণ তাহার শিয়রে, চাকীর মনের এতদিনকার ঐকান্তিক কামনা সকলের হৃদবিহারী দেবতা তখন শুনিয়াছেন, তাহার সাধু হইতে যাওয়া ঘটিবে কেন? অগত্যা লেলে একাই ক্ষুণ্ণমনে ফিরিয়া গেলেন।
তাহার পরই আমাদের সকল সাধে জলাঞ্জলি ও গ্রেপ্তার। মহাপুরুষের বাক্য সফল হইল, আমরা মৃত্যুকল্প বিপদ মাথায় করিয়া জেলে ঢুকিলাম। লেলে যে অসাধারণ শক্তিমান সাধক ছিলেন তাহাতে আর সন্দেহ নাই। একদিন সেজদার বাড়িতে বসিয়া উপেনের অতি গুহ্য কথা বলিয়া দিয়াছিলেন, উপেনকে একদিন কাছে বসাইয়া কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তির এক আনন্দের স্তরে অল্পক্ষণের জন্য তুলিয়া দিয়াছিলেন। এত দেখিয়াও আমাদের পাপ মন কিন্তু বুঝিল না; তখনও এ কয়টা ভাঙা কুলায় করিয়া বিধাতার ছাই ফেলা সাঙ্গ হয় নাই, তখনও অনেক ঘাটের জল খাইয়া অনেক ঘোরা ঘুরিতে হইবে যে।’
বারীন্দ্রকুমার, উপেন্দ্রনাথ ও প্রফুল্ল চাকীকে লেলের আসন্ন বিপদের ইঙ্গিতপূর্ণ পরামর্শ প্রদানের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বিপ্লববাদী কর্মকাণ্ড। ১৯০৭-এর ৬ ডিসেম্বর ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টা হয় খড়্গপুরের কাছে নারায়ণগড়ে রেললাইনে ডিনামাইট পুঁতে।
মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা-লড়া যে বিপ্লবীকে দেখে নজরুল বলেছিলেন— মূর্তিমান প্রলয়োল্লাস, সেই উল্লাসকর দত্ত মুক্ত ভারতের জন্য পিকরিক অ্যাসিডের বোমা তৈরিতে সফল হন কিছুদিন আগেই। সেই বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেওঘরের নিকটবর্তী দিঘিরিয়া পাহাড়ে প্রফুল্ল চক্রবর্তী নিহত হন ১৯০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি।
সহ-বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তীর দুর্ঘটনায় অমন শোচনীয় মৃত্যুতে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ পায় উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য়— ‘তাঁহার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া মাথার মাঝখান হইতে কোমর পর্যন্ত মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়া কি যেন একটা সড়াৎ করিয়া নামিয়া গেল।
একটা অন্ধ রাগ আর ক্ষোভে মনটা ভরিয়া গেল। মনটা শুধু আর্তনাদ করিতে করিতে বলিতে লাগিল— সব চুলোয় যাক, সব চুলোয় যাক।’
(চলবে)