সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে গ্রামের রাস্তায় বহুবছর পর
হঠাৎ দেখা মহল্লার মসজিদের মোয়াজ্জিন ওসমান চাচার সঙ্গে। ভালোই আছি শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে ভালো আছ? গ্রামে আমাদের তো বুক কাঁপে! গতকাল মগরিবের আজান দিয়ে মসজিদের বাইরে পা বাড়িয়েছি। সাইকেল চালিয়ে হুস করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একজন বলল, ‘আর ক’টা দিন মাইক বাজিয়ে আজান দিয়ে লে।’ স্তোক দেওয়ার মতো করে বললাম, কেউ ফাজলামি করেই বলেছে হয়তো। তবে চাচা, বছর চল্লিশ আগে তুমি খালি গলায় যে আজান দিতে সেগুলো ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় অনেক বেশি ভালো লাগত শুনতে! মাইক না ব্যবহার করে খালি গলায় আজান দিলে ভালো হয় না?
ওসমান চাচা আমাকে বাধা দিয়ে বলল, ধুর এই বুড়া গলায় এত জোর আছে নাকি, গ্রাম কত বড় হয়ে গিয়েছে তুমি জান? আমার গলার আওয়াজ পৌঁছবে? একথা সেকথার পর ভয়ার্ত চোখে জিজ্ঞাসা করল, তোমার দাদি বাইরে কোথাও গেলে বোরখা ছাড়া বেরয় না, কলকাতার দিকে গেলে পুলিস কি বোরখা পরতে দেবে না? পুলিসের কথা এড়িয়ে বললাম, আচ্ছা চাচি তো পঁচাত্তর পেরিয়ে গেল বোধহয়। এখন বোরখার আর কী দরকার! না রে বাজান, এটা অভ্যাসের ব্যাপার, বুঝলে কি না? এই যে আমার বড় নাতনি আমেনা হিজাব পরে না। আবার ছোট নাতনি মোমেনা হিজাব মাথায় না দিয়ে আদৌ স্কুলেই যাবে না। ওদের আব্বা হিজাব পরা-না-পরা নিয়ে কিচ্ছুটি বলে না! খালপাড়ে পুলের উপর আড্ডায় সবাই বলছিল কর্ণাটকে এসব নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। এগুলো নাকি সব বন্ধ হয়ে যাবে?
কী জানি! সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি হলে বোঝা যাবে! কাজের দোহাই দিয়ে চলে যাচ্ছি বুঝতে পেরে চাচা জিজ্ঞাসা করল, হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যাবে নাকি? আমরা ভোট দিতে পারব তো! ওসমান চাচাকে পিছনে ফেলে জোরে জোরে পা চালিয়ে দিলাম। বুড়ো হলে মানুষ বেশি কথা বলে। দুশ্চিন্তা করে আর ভয় বাড়ে মনে! দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো আছেই!
গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের সময় কানপুর ক্যান্টনমেন্টে এলাকার সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার এক মুসলমান আত্মীয়ার বহুদিন বাদে ফোন পেলাম রাত ৮টা নাগাদ। ভয়ার্ত গলায় বলল, ঘণ্টা দেড়েক আগে পাঁচ-ছ’জনের একটা গ্রুপ বাড়ির দরজায় বেল বাজিয়ে বলল, আমরা ভোটে হারলে, বুঝব তোমরা ভোটটা দাওনি! যোগীজি ক্ষমতায় আসছেন। আমাদের প্রার্থী হারলে পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নেব। থানার পুলিস সব শুনে বলল, তাহলে যেমন বলেছে তেমন ভোট দাও। না-হলে চামড়া ছাড়াতে এলে এস থানায়!
ভোটের রেজাল্টের সময় একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সাবধানে থাক, ক’দিন পরে সবাই ভুলে যাবে। আরে, এইজন্যই তোমার দুলহা ভাইকে বলেছিলাম, যেদিকটায় মুসলমানদের বাস ওদিকটায় থাকব, আমার কথা শুনলে কি আর
এইসব বিপদ হয়! বিপদে পড়লে আমাকে জানিও, তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলাম।
ক’দিন আগে সদর দপ্তরে এক সিনিয়র পুলিস অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিউটাউনে নবনির্মিত ‘খাকি পুলিস আবাসনে’ থাকবে তো? বললাম, কলকাতা থেকে অনেক দূরে, কী করব জানি না। অফিসারটি বললেন, আমি তো থাকব। কলকাতায় মিক্সড এরিয়ায় দু-চারবছর পরে কী হবে বলা মুশকিল। ‘খাকি’তে থাকলে যাদের সঙ্গে এত বছর কাজ করছি, তারা আর যাই হোক নিশ্চয় পেটাবে না! মুসলমানদের এক জায়গায় এককাট্টা হয়ে থাকতে হবে যে।
গত ডিসেম্বরে হরিদ্বারে ধর্মমহাসভা থেকে যতী নরসিঙ্ঘানন্দ গিরি এবং অন্যদের তোপ দাগা দিয়ে শুরু। গত জানুয়ারিতে হিন্দু মহাসভার পূজা শকুন পাণ্ডে বললেন, ‘ভারতকে বাঁচাতে সৈনিক তৈরি করে মুসলমানদের হত্যা করে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে।’ বেশকিছু হিন্দু উগ্রপন্থী ছত্তিশগড়ের ওদাগাঁওতে চার্চে আক্রমণ শানিয়ে যাজক পিটিয়ে ঘোষণা করল, ‘মুসলমান আর খ্রিস্টানদের তাড়িয়ে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে হবে।’
২০১৭ সাল থেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করছিলাম যোগী আদিত্যনাথ তাঁর অপছন্দের মানুষদের, বিশেষ করে মুসলমানদের ঘরবাড়িসহ ব্যবসার জায়গা অবৈধ ঘোষণা হলেই বুলডোজারকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে ধ্বংসলীলা চালিয়ে ‘বুলডোজার বাবা’ হিসাবে খ্যাত হয়েছেন। সেই শুরু। তারপর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী এবং শাহিনবাগে মুসলমানদের বাড়ি-দোকানের উপর বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করার মতো ঘটনা। এই সুযোগে যোগী নূপুর শর্মার হজরত মহম্মদের উপরে করা বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে কানপুরে বিক্ষোভকারীদের উপর বুলডোজারের প্রয়োগ করে তাঁর টিআরপি বেশ বাড়িয়ে নিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, অসম, গুজরাতেও বেশকিছু জায়গায় বুলডোজারের প্রয়োগ দেখলাম, বিশেষত মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায়। বুলডোজার প্রয়োগে পিছিয়ে পড়ছেন, এই ভাবনা থেকে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বুলডোজারের অ্যাকশন সংখ্যা বাড়িয়ে ‘বুলডোজার মামা’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছেন।
মুসলমানদের মনে এই সন্দেহের বাতাবরণের কারণ আছে বইকি! গণতন্ত্রের সূচকে ১৬৭ দেশের মধ্যে আমরা ৯৩তম র্যাঙ্ক করেছি ঠিকই, কিন্তু আমেরিকার কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমদের দেশ ‘পার্টিকুলার কনসার্নে’র জায়গায় রয়েছে।
মসজিদে মসজিদে মাইকে আজান দেওয়ার অভ্যাস
যত তাড়াতাড়ি নিজেরাই গুটিয়ে রাখবে ততই মঙ্গল। রাতে দেরি করে ঘুমানো অনেক মানুষের পক্ষে ভোরের লাউডস্পিকারে আজানের আওয়াজ সত্যিই অসুবিধাজনক। ঘড়ি ছাড়াও নামাজের সময় অভ্যাসের ব্যাপার, আজান নাই-বা শুনতে পেলেন।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের পরবর্তী অ্যাজেন্ডা সংবিধানের ৪৪ নম্বর ধারায় বর্ণিত ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোডে’র প্রণয়ন। সংবিধানের ২৫-২৮ ধারাগুলিতে উল্লেখ্য ধর্মীয় স্বাধীনতার মান্যতা দিয়ে নাগরিকদের ‘পার্সোনেল ল’ অনুযায়ী বিবাহ, বিচ্ছেদ, খোরপোশ, বংশানুক্রমে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা এবং দত্তক নেওয়া ইত্যাদির বিধান রয়েছে। ‘মুসলিম পার্সোনেল ল’ যেটা কি না অনেকটাই শরিয়ত আইন অনুযায়ী প্রণীত, তাই আঁকড়ে বসে থাকলে ‘জান অউর মালে’র হেফাজতে ব্যস্ত মুসলমানদের ইজ্জত বাঁচিয়ে রাখার আশা না করাই ভালো। ‘যেমন দেশ তেমন ভেশ’ মেনেও বলা চলে, মেয়েদের হিজাব ধরে টানাটানি বরং ছেড়ে দিক বিজেপি-আরএসএস। ইউরোপেও বেশিরভাগ দেশে হিজাব নিষিদ্ধ নয়। তথাকথিত আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক ভারতের ক্ষতি কী, কিছু মেয়ের কান-চুল-ঘাড় না দেখতে পেলে?
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে আরবি ভাষায় অনার্সের তিরিশটা সিট বাড়িয়ে পঞ্চাশটা করার জন্য কয়েকজন আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের বলি, বর্তমান ভারতে গাদা গাদা আরবি অনার্সের বিশেষ কী প্রয়োজন? ছাত্রদের ভবিষ্যৎ ভেবে দেখেছেন কী? খারিজি মাদ্রাসা আইন করেই বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। ধর্মশিক্ষা, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কিংবা বাড়িতে বসেও হতে পারে। মুসলমানরা বরং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ছেড়ে বেরিয়ে সমাজের অন্যান্য স্কুলগুলোর সঙ্গে মিশে যাক, যাতে কোনও মহাপ্রভু বলতে না পারেন ‘চুল-দাড়ি আর পোশাক দেখলেই চেনা যায়’। মুসলমানরা যত তাড়াতাড়ি ভারতের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাবে তাতেই তাদের মঙ্গল। ইমান এবং ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে হলে সময় নষ্ট না করে মুসলমানরা বরং জিহাদ ঘোষণা করুক সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলি, সায়েন্স এবং টেকনোলজিতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে।
২০২৪-এ ভারত যদি হিন্দু-রাষ্ট্র হয়েই যায় কে আটকাবে? হজরত মহম্মদকে নিয়ে কুকথায় মধ্যপ্রাচ্য খেপে উঠেছিল। তাই বলে তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামাবে এমনটা ভাবা চরম বোকামি। ভারতের বাজার বড্ড বড় যে, সৌদি পারলে আরও একবার আমাদের মোদিজিকে সর্বোচ্চ ‘আব্দুলাজিজ আল সাউদ’ সম্মানে ভূষিত করবে।
দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচন জিতে মোদি সরকার বলেছিল, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ অউর সবকা বিশ্বাস’। বিশ্বাস বোধহয় আর কেউ করে না, আর বিকাশ জাজ্জ্বল্যমান, আপনি না দেখতে পেলে আপনার চোখের দোষ।