সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়: বাংলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রথম পর্বের মূল নেতা ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাল্যবন্ধু। ইংরেজি বলতেন চমৎকার, লিখতেন পরিশুদ্ধ বাংলা।
‘কংগ্রেসে গিয়া গলাবাজি করিয়া নামার্জন করিবার প্রবৃত্তি তাঁহার কখনও ছিল না। কংগ্রেসে চেঁচাইয়া দেশবিখ্যাত নেতা হইবার সুবিধা তাঁহার বিশেষই ছিল, কিন্তু তিনি বক্তৃতা দেওয়াকে বিশেষ ঘৃণা করিতেন এবং কখনও আবেদন ও নিবেদনকারীদের রাজনীতির সহিত মিশেন নাই,’ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সম্পর্কে এ অভিমত প্রকাশ করেন। এই সময়ই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজ সংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমনকী গোল থামাইতে গোল করে।... কাজেই বঙ্গসমাজে চেঁচানোটাই চলিত হইয়াছে। পক্ষীজাতির মধ্যে কাকের সমাজ, পশুজাতির মধ্যে শৃগালের সমাজ, আর মনুষ্য জাতির মধ্যে বাঙালির সমাজ যে এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে ইহা শত্রুপক্ষকেও স্বীকার করিতে হইবে।’
হেমচন্দ্র কানুনগো জানিয়েছেন, ‘বৃদ্ধ ব্যারিস্টার পি মিত্রই ছিলেন বাংলার বৈপ্লবিক গুপ্তসমিতির প্রধান কেন্দ্রের সভাপতি।’ গুপ্তসমিতি তৈরির অনেক আগে যখন তিনি ‘বিলেতে পড়তে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই সিক্রেট সোসাইটির খেয়াল তাঁর মাথায় ঢুকেছিল এবং ক-বাবুর [অরবিন্দের] অনেক পূর্বে অনুশীলন সমিতি বা ঐ রকম কিছু নাম দিয়ে একটি গুপ্তসমিতি চালিয়ে আসছিলেন।’
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গ্রন্থে পি মিত্রের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন— ‘প্রমথনাথ মিত্র মহাশয় বলিতেন, ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে [?] বঙ্গীয় বৈপ্লবিক সমিতি স্থাপনের পূর্বে কয়েকবার তিনি বৈপ্লবিক সমিতি স্থাপন করিয়াছিলেন। পূর্বে চারবার তাঁহার এই উদ্যম ব্যর্থ হয়।’
পি এন মিত্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থ পরিকল্পনা ছিল ১৮৮৩ সালে। ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয়ের জন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত কারাদণ্ড দেয় ৬ মাস। বাল্যবন্ধুকে জেল ভেঙে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সুরেন্দ্রনাথের এই কারাদণ্ড একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সারা ভারত আলোড়িত। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘এ নেশন ইন মেকিং’-এ ঘোষণা করেন— ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য আমিই আমার প্রজন্মে প্রথম কারাবাস করেছি।’
বিচারকালে হাইকোর্টে উদ্বেলিত বিরাট জনতা। ছাত্ররা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত। পুলিসের উপর ইট-পাটকেল ছুঁড়ে, জানলা ভেঙে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেইসব চণ্ড-বিক্ষুব্ধ যুবকদের একজন ছিলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ধরপাকড় চলে। রায় দেওয়ার দিন হাইকোর্টের আশপাশ ভরে যায় উত্তেজিত জনতায়। তাই শাস্তিপ্রাপ্ত সুরেন্দ্রনাথকে সোজা রাস্তা ছেড়ে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়া হয় জেলে। তাঁর জেল যাওয়ার দিন সর্বত্র পালিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল।
এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে প্রমথনাথ মিত্র উৎসাহিত হন প্রকাশ্য বিদ্রোহের পরিকল্পনায়। কিন্তু বন্ধুকে জেল ভেঙে মুক্ত করার পরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। এ সম্পর্কে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন— ‘যখন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ডিফামেশন কেস-এ জেলে নিক্ষিপ্ত হন তাঁহার [পি মিত্রের] বৈপ্লবিক বন্ধুরা তাঁহাকে এই উদ্দেশ্যে বরিশালে পাঠাইয়াছিলেন যে, তথায় বৈপ্লবিক পতাকা উড্ডীন করিয়া বহুসংখ্যক লোকসমেত কলিকাতায় আসিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে জেল ভাঙিয়া নিষ্কৃতি দিবেন। তিনি বলিতেন, এজন্য বরিশালের লোকও প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কলিকাতার নেতারা প্রতিশ্রুত sign দিলেন না। উদ্যম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।’ [অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস]
এরপরে পি মিত্র ও সরলা দেবী কর্তৃক সংগঠিত একটি সমিতির কথা লিখেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতের জাতীয় আন্দোলন’ গ্রন্থে। সেই সমিতির উদ্দেশ্য, ছেলেদের লাঠিখেলা, বক্সিং, নানারকম অস্ত্রশিক্ষা ইত্যাদিতে উৎসাহিত করা।
বাংলার তরুণদের লাঠিখেলা ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে উদ্যোগী হওয়ার নেপথ্যে একটি ঘটনার কথা সরলা দেবী বলেছেন, ‘জীবনের ঝরাপাতা’য়।
একবার রুডিয়ার্ড ক্লিপিংয়ের একখানা ছোট গল্পের বই সরলা দেবীর হাতে আসে। তাতে একটা গল্প ছিল— ভারত সীমান্তে পাঠানদের মুলুকে একবার এক বাঙালি আইসিএস নিযুক্ত হন ডেপুটি কমিশনার। তাঁর উপর ভার ছিল সেখানকার সমস্ত জেলার। একবার পাঠানরা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে আরম্ভ করে খুন-খারাপি ও লুটতরাজ। তখন সেই বাঙালি ডেপুটি কমিশনার ‘দুষ্কৃতের শাসন ও সুকৃত প্রজার পালনে’ এগিয়ে না এসে কোথায় চলে যান। শেষে পাঠান চরেরা তাকে খুঁজে খুঁজে বের করে। তিনি প্রাণভয়ে একটি নিভৃত স্থানে লুকিয়েছিলেন।
তাকে ধরে ফেলেই এক কোপে তার গলাটা কেটে মুণ্ডটা একটা শূলের উপর গেঁথে তারা সারা শহরময় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল আর আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল— ‘বাঙালি গিদ্দর’ (শৃগাল)।
রুডিয়ার্ড কিপ্লিংয়ের এই গল্পটা পড়তে পড়তে সরলা দেবীর লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে রক্ত টগবগ করতে থাকে। তিনি ভাবেন, বাঙালি হিসেবে কীভাবে প্রতিশোধ নেবেন এই অপমানের। তেজস্বিনী সরলা উত্তেজিত হয়ে একটি চিঠি লিখে ফেললেন কিপ্লিংকে। সেই চিঠির মর্মার্থ— ‘আমার জাতিকে তুমি যে কলঙ্কিত করেছ সে কলঙ্ক ঘোচানোর জন্যে আমি তোমাকে আহ্বান করছি— আমার ভাইদের একজন কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে। পাঁচ বৎসর সময় দিচ্ছি তোমায়। বন্দুক হোক, তলোয়ার হোক, যে কোন অস্ত্র তুমি ইচ্ছে কর নিজেকে তাতেই অভ্যস্ত করে নাও— আজ হতে পাঁচ বছর পরে সে তাতেই তোমাকে যুদ্ধদান করবে।’
সমস্যা দেখা দিল, রুডিয়ার্ড কিপ্লিংয়ের ঠিকানা জানা ছিল না সরলা দেবীর। কোথায় পাঠাবেন চিঠিখানা? ঠিকানার সন্ধানে দেরি হতে লাগল। এরই মধ্যে তাঁর তাগাদা এল কটকে যাওয়ার।
সেখানে পরিচয় ওড়িশার স্বদেশভক্ত মধুসূদন দাসের সঙ্গে। তিনি বাঙালি-অনুরাগী। সরলা দেবী তাঁকে বললেন কিপ্লিংকে প্রেরিতব্য চিঠির কথা। সঙ্গেই ছিল চিঠিখানা, পড়ে শোনালেন তাঁকে।
মধুসূদন দাস তিনি পরামর্শ দিলেন— ‘ওকে যখন পাঁচ বছর সময় দিচ্ছেন, নিজেও পাঁচ বছর সময় নিয়ে অপেক্ষা করুন। এই পাঁচ বছরে বাঙালি ছেলেদের তৈরি করে নিন, সবরকম অস্ত্রচর্চায় পারদর্শী করে তুলুন। একটা নামডাক হোক তাদের। তারপর কিপ্লিংকে challenge পাঠাবেন। সেইটেই সঙ্গত হবে।’ মধুসূদন দাসের কথার যুক্তিযুক্ততা মেনে নিলেন তিনি।
এর কিছুকাল পরে ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনে স্বল্প সময়ের জন্য আবির্ভাব এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জাপানি শিল্পশাস্ত্রী, জাপানের নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ, ‘এশিয়া এক’ বাণীর প্রবক্তা কাউন্ট ওকাকুরা কাকুজো। ১৯০২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় আসেন বিবেকানন্দকে প্রস্তাবিত টোকিও বিশ্বধর্ম সম্মেলনে নিয়ে যেতে।
অগ্নিপথের অভিযাত্রায় সরলা রায়ের সঙ্গে ওকাকুরার ঘনিষ্ঠতার কথা লিখেছেন গিরিজাশঙ্কর। আসলে ওকাকুরা-অনুরাগী ছিলেন সরলার মামাতো ভাই সুরেন্দ্রনাথ।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন— ‘... [বাংলার সহিংস] আন্দোলনকে ভালো করে বুঝতে গেলে, তার পিছনে বুদ্ধিজীবীদের যে প্রভাব ছিল তাকে ভুলে গেলে চলবে না। তাঁরাই এই আন্দোলনের জমি তৈরি করেছিলেন, যদিও তাঁদের অধিকাংশই সামনে আসেনি। ... তাঁদের প্রসঙ্গে ভাবতে গেলে প্রথমেই যে দু’টি নাম আমার মনে আসে তাঁরা বাঙালি নন, ভারতীয় পর্যন্ত নন, দু’জন বিদেশি— কাকুজো ওকাকুরা ও ভগিনী নিবেদিতা।
কাউন্ট ওকাকুরা যখন প্রথম কলকাতায় এলেন কেউ লক্ষ করেনি, একেবারে অজ্ঞাত বিদেশী হিসেবেই এসেছিলেন। কী করে যে আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হল বলতে পারি না। কিন্তু দেখা গেল আমার জ্যেঠতুতো ভাই সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তাঁদের বাড়িতেই তিনি বাস করছেন। এখানে থেকে তিনি দ্রুত সমাজের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁর আইডিয়ালস অব দ্য ইস্ট বইটি প্রকাশিত হলে আমাদের দেশের মানুষের সামনে যেন দিব্যদৃষ্টি উন্মুক্ত হয়ে গেল। ... শুধু আমাদের পরিবারেই যে তিনি বন্ধু পেলেন তা নয়, জগদীশচন্দ্র বসু, ভগিনী নিবেদিতা, বিপিনচন্দ্র পাল এবং চরমপন্থী নেতাদের কারও কারও সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল।’
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম সাক্ষাতেই ওকাকুরা জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার দেশের জন্য আপনি কী করতে চান, বলুন?’
গোড়াতেই হঠাৎ অমন প্রশ্ন। সুরেন্দ্রনাথ হতভম্ব। নিতান্ত অপ্রস্তুত আমতা-আমতা করে এই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন যে, দেশের উন্নতির জন্য সঙ্ঘবদ্ধ চেষ্টা করার ব্যাপারে তাঁর বাধা কতখানি।
ওকাকুরা ইংরেজি বলতেন থেমে-থেমে, ঠিক কথাটি যেন খুঁজে পাচ্ছেন না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা তিনি পেয়ে যেতেন।
সুরেন ঠাকুরের কথা নিঃশব্দে শোনার পরে ওকাকুরা বলেন, এদেশের তরুণদের মধ্যে নৈরাশ্যের ভাব তাঁকে ব্যথিত করেছে। তারপর তাঁকে তাতিয়ে তোলার জন্য ওকাকুরা নিজে কী ধরনের পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তার বর্ণনা দেন।
তাঁর অতি বাল্যকালের একটি ঘটনা যখন শোনাচ্ছিলেন তখনই ওকাকুরার মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক— শৈশবে একদা পাশের ঘরে বাগবিতণ্ডার শব্দ শুনে ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন, তাঁর কাকার মুণ্ডহীন ধড় উপবিষ্ট, আর গলা থেকে ফিনকি দিয়ে উঠছে রক্তের ফোয়ারা।
সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শুরুতেই এমন কথোপকথনে ওকাকুরার চরমপন্থী মানসিকতার পরিচয় মেলে। এ পরিচয় অজানা ছিল না নিবেদিতার। তাই জাতীয়তাবাদী মহলের সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওকাকুরার।
ওকাকুরার সঙ্গে পরিচয়ের পরে ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য নিবেদিতার চরমপন্থা অবলম্বন করার উৎসাহ বেড়ে যায় অনেক।
পুলিসের গোয়েন্দারা নিবেদিতার চিঠিপত্রের উপর নিয়মিত নজরদারি করত। সে-কারণে জোসেফিন ম্যাকলাউড বা অন্যান্যদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে তিনি ওকাকুরাকে চিহ্নিত বা উল্লেখ করতেন বিবিধ ছদ্মনামে। যেমন, Japanese poet Nigu, Chieftain, Banner chief, Glenghis ইত্যাদি।
ওকাকুরা-অনুগামী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাকুজো ওকাকুরা’ শীর্ষক ইংরেজিতে একটি নিবন্ধ লেখেন মৃত্যুর বছর তিনেক পূর্বে। ওকাকুরার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিচারণায় লিখছেন— ‘তার প্রথম দর্শনের ছাপ আমার মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। গৃহস্বামিনীর পাশে উপবিষ্ট মাঝারি উচ্চতার বলিষ্ঠ একটি মানুষ, কালো-সিল্কের কিমোনোয় আবৃত দেহ, তার উপরে পারিবারিক প্রতীক চিহ্ন পাঁচ পাপড়ির সাদাসিধে একটি ফুল কাজ করা বা ছাপা। তাঁর হাতে ছিল বাঁশ ও কাগজের তৈরি পাখা, তাতে রক্তপিঙ্গল রঙের পল্লবগুচ্ছের অলঙ্করণ। জাপানি কাপড়ের মোজায় পা ঢাকা, পরেছিলেন ঘাসের চটি। মুখ দেখলে জাপানির চেয়ে চীনা মনে হয়; চোখের পাতা ভারী, যৎসামান্য গোঁফ, কিন্তু গায়ের রঙ লালচে, স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে আসীন, গাম্ভীর্যে সমাহিত, মিশরীয় সিগারেটের ধূমপান করে যাচ্ছিলেন ক্রমান্বয়ে।
ওকাকুরা নীরবে বসেছিলেন, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যে প্রবলভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন নিবেদিতা— আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষায় তাঁকে কথাবার্তার মধ্যে টেনে আনাই ছিল নিবেদিতার সুস্পষ্ট অভিপ্রায়।...
কিছু পরে ওকাকুরা উঠে গেলেন। আমিও অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ধরে নিয়ে বিদায় নিতে অগ্রসর হলাম। তখন নিবেদিতা রহস্যময়ভাবে আমার কাছে এসে আমাকে পাশের ঘরে যেতে বললেন। নির্দেশিত দরজা দিয়ে আমি ছোট কাচ-বসানো বারান্দায় হাজির হলাম, সেখানে কেবল একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার, যার একটিতে বসে আছেন ওকাকুরা, তখনও ধূমপান করছেন এবং পূর্বের মতোই অটল গাম্ভীর্যে পূর্ণ। আমি যদিও তাঁর থেকে অল্প বয়স্ক এবং বয়সের তুলনায় অপরিণত, তবু তিনি নত হয়ে সমমর্যাদার অভিবাদন জানালেন, পাশের চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন এবং সুন্দরভাবে হাতের তালু মেলে ধরলেন, তাতে আমার জন্য একটি সিগারেট। তখন আমি আবিষ্কার করলাম, তার কিমোনোর ঢোলা হাতার একটিতে রয়েছে পুরো এক টিন সিগারেট।’
সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় ওকাকুরার বিপ্লবচেষ্টার সংবাদ ছিল না। ইংরেজ শাসনকালে প্রকাশিত রচনায় তা সহজবোধ্য কারণেই লেখা সম্ভব ছিল না। তবু ওকাকুরার অমৃতসর ভ্রমণের কথায় সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘তাঁর [ওকাকুরা] সামুরাই বংশের প্রাণ অবিলম্বে শিখদের স্বর্ণমন্দিরের দিকে ধাবিত হয়েছিল— তাঁদের কৃপাণ-ব্রতের দিকে।’
এ সম্বন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ অভিব্যক্তি সুবিখ্যাত গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর— ‘ওকাকুরার উল্লিখিত কৃপাণ-নীতি কিংবা বাল্যকালে নিজ খুল্লতাতের মুণ্ডহীন ধড় ও রক্তফোয়ারা দর্শনের স্মৃতিতে প্রৌঢ় ওকাকুরার মৃদুহাস্য— সুরেন্দ্রকে যত শিহরিত করুক, তা অবশ্যই আতঙ্কিত করেনি মৃত্যুপূজারী বিবেকানন্দের আইরিশ বিপ্লববাদিনী শিষ্যা নিবেদিতাকে।’
বড় বিস্ময় লাগে, কয়েক মাস পরে বিদায়কালে ওকাকুরার সঙ্গে নিবেদিতার সব সম্পর্ক যায় ঘুচে। অগ্নিযুগের সংগ্রামের ইতিহাসে সে-এক ভিন্নতর সুদীর্ঘ আখ্যান। নিবেদিতার প্রীতিভাজন সুহৃদ ‘স্টেটসম্যান’-সম্পাদক এস কে র্যাটক্লিফের বক্তব্য থেকে জানা যায়— ওকাকুরার প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও শেষ পর্যন্ত সন্দেহ দেখা দেয় নিবেদিতার মনে। অবশ্য অক্ষুণ্ণ ছিল সুরেন ঠাকুরের ওকাকুরা অনুরাগ।
‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে এক অসাধারণ স্মৃতিচিত্র উপহার দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর— ‘...ওকাকুরা যখন প্রথমবার আসেন এ দেশে, যতদূর মনে পড়ে কলকাতায় সুরেনের বাড়িতেই ছিলেন। সেবার খুব বেশি আলাপ হয়নি তাঁর সঙ্গে। মাঝে মাঝে যেতুম, দেখতুম বসে আছেন তিনি একটা কৌচে। সামনে ব্রোঞ্জের একটি পদ্মফুল, তার ভিতর সিগারেট গোঁজা; একটি করে তুলছেন আর ধরাচ্ছেন। বেশি কথা তিনি কখনোই বলতেন না। বেঁটেখাটো মানুষটি, সুন্দর চেহারা, টানা চোখ, ধ্যাননিবিষ্ট গম্ভীর মূর্তি। বসে থাকতেন ঠিক যেন এক মহাপুরুষ, রাজভাব প্রকাশ পেত তাঁর চেহারায়। সুরেনকে খুব পছন্দ করতেন ওকাকুরা। সুরেন সম্বন্ধে বলতেন— হি ইজ ফিট টু বি এ কিং।’
অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের বোমার মালমশলার ফরমুলা এবং বোমা তৈরির পদ্ধতি শেখাতেন ওকাকুরা, লিখেছেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় ‘গগনেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে।