সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি কত আসন পেয়েছিলেন? ২৮২। দ্বিতীয়বার ২০১৯ সালে তাঁর মুখ সামনে রেখে এনডিএ জোট কত আসন পেল? ৩৫১। আশ্চর্য মিল। ১৯৭১ সালের নির্বাচনের দু’বছরের মধ্যে প্রথম কোন রাজ্য থেকে সবথেকে বড় ধাক্কা খেলেন ইন্দিরা গান্ধী? বিহার। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা বিরোধী জেপি আন্দোলনের সর্বাগ্রে কোথা থেকে সূত্রপাত হয়েছিল? বিহার থেকে। গঠিত হয়েছিল গোটা রাজ্যের ছাত্রসমাজকে নিয়ে একটি কমিটি। বিহার ছাত্র সংঘর্ষ সমিতি। কে ছিলেন সেই সমিতির সভাপতি? লালুপ্রসাদ যাদব নামের এক তরুণ!
২০১৯ সালের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জয়ের পর সর্বাগ্রে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের ময়দানে ধাক্কা খেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বাংলায় পর্যুদস্ত হয়ে গিয়ে। কিন্তু তাঁর দলের আগ্রাসী মনোভাব সংশোধিত হয়নি। বরং আরও বেড়েছে। এবার বিহার নরেন্দ্র মোদিকে আকস্মিক এক অপ্রত্যাশিত চমক দিল। কেন চমক? কারণ তিনি নির্বাচনে জয়ের মুখ! তিনি যেখানে, সাফল্য ও বিজয় সেখানে। সুতরাং, সেই সাফল্যের অংশীদার হতে এনডিএ জোটের শরিকের তো শত অপমান অসম্মানেও দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকাই নিয়ম। তা হল না। বরং নীতীশকুমার মোদির হাত ছেড়ে দিলেন। নীতীশকুমার আবার কার কাছে ফিরলেন? লালুপ্রসাদ যাদবের কাছে। কোন লালুপ্রসাদ যাদব? যিনি ১৯৭৪ সালের জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে প্রথম প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন ছাত্র সংঘর্ষ সমিতির সভাপতি হয়ে। অর্থাৎ আবার বিহার থেকে বিদ্রোহের সূচনা। ১৯৭৪ সালের ঠিক তিন বছরের মধ্যে সাফল্যের পর্বতশৃঙ্গে বসে থাকা ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় ঘটে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে। এ সপ্তাহের বিহার বিদ্রোহের দু বছরের মধ্যেই আসছে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট। তাহলে কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে বিজেপি গরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। নীতীশকুমার বিজেপির হাত ছেড়ে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বুধবার ঠিক একই কথা বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। এই দুই নেতানেত্রীর পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন বিগত ২০ বছরে ভুল হয়নি। এই দুজনের উত্থান বিগত ২০ বছরে চমকপ্রদ। তাই তাঁরা কি নিছক বিরোধিতার জন্যই এরকম একটা কথা বললেন? নাকি তাঁরা কোনও আভাস পাচ্ছেন?
নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহেরা নতুন বিজেপি বন্ধু ধরে রাখতে পারছেন না কেন? বাজপেয়ি ও আদবানির সাধের এনডিএ আপাতত অতীত। বরং ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, এক আশ্চর্য প্রবণতা। যে আঞ্চলিক দলই বিজেপির সংসর্গে এসেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে জোটে থেকে গিয়েছে, তারাই পরবর্তীকালে কোনও না কোনও কারণে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। অথবা ভেঙে গিয়েছে। সবথেকে পুরনো জোটশরিক কারা? শিবসেনা এবং শিরোমণি আকালি দল। শিবসেনা ভেঙে দু টুকরো। শিরোমণি আকালি দল পাঞ্জাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন। জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে কয়েকসপ্তাহ আগেই দুই গোষ্ঠীতে বিভাজিত হয়ে গেল। অর্থাৎ দল ভেঙে দুই অংশ। কোনও গ্রহণযোগ্য নেতা-নেত্রী নেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার চাপেই হোক অথবা অন্য কারণ, মায়াবতী যখনই বিজেপি বিরোধিতা ছেড়ে ক্রমেই বিজেপির সমর্থক দলে পরিণত হলেন, তাঁর দল (দলিত আন্দোলনের এক গবেষণাগার) বহুজন সমাজ পার্টি এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই, ভোটব্যাঙ্কও নেই।
চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অসম গণ পরিষদের আর নামই শোনা যায় না। রামবিলাস পাসোয়ানের লোকজনশক্তি পার্টি ভেঙে দুই টুকরো। বিহারে আর কোনও চর্চাই হয় না এই দল নিয়ে। এই অবস্থা থেকেই রক্ষা পেতে হয়তো মোক্ষম সময়ে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন নীতীশকুমার। সময়মতো। কারণ, মোদি এবং অমিত শাহের নয়া বিজেপির একটি আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, তাঁরা সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষের রাজনীতির নিয়ন্তা হয়ে গিয়েছেন। তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সিংহভাগ তাঁদের সঙ্গেই থাকতে চাইবে। যে কোনও প্রলোভনেই হোক, সেটা হচ্ছেও। রাজ্যে রাজ্যে। কিন্তু এই প্রথম দেখা গেল, বিজেপির সাফল্য-সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে আগেভাগেই বিজেপির হাত ছেড়ে দিলেন নীতীশকুমার। তাঁর কোনও সিদ্ধান্তই তাঁকে পথে বসায়নি এখনও পর্যন্ত। এবারও সম্ভবত তাঁর নিজের কাছে কোনও অঙ্ক আছে। সেটা নিছক ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া ছাড়াও অন্য কোনও রাজনৈতিক ইনস্টিংকটও হতে পারে। সেটা কী?
বিজেপির সঙ্গত্যাগ করেছেন বহু আগে এবং তারপর থেকে ক্রমাগত উন্নতি আর রাজনৈতিক সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন কারা? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়ক। আজও তাঁরা অপ্রতিরোধ্য। আজও তাঁদের পরাস্ত করতে পারেননি মোদি। কারা কখনও বিজেপির জোটে আসেনি? অথচ নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বার্থরক্ষার জন্য সংসদে মোদি সরকারকে সমর্থন করেছে নানা ইস্যুতে। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির কে চন্দ্রশেখর রাও এবং অন্ধ্রপ্রদেশের জগনমোহন রেড্ডি। এঁদের মধ্যে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটানা শুধুই বিরোধিতা করে গিয়েছেন মোদির। বাকিরা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ভালো রেখে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চন্দ্রশেখর রাও এখন বুঝতে পেরেছেন বিজেপির প্রকৃত লক্ষ্য কী। বিজেপির লক্ষ্য হল, কংগ্রেস তো বটেই, ধীরে ধীরে তাবৎ আঞ্চলিক দলের শক্তিকেও শেষ করা। হায়দরাবাদের পুরসভা ভোটের পরই চন্দ্রশেখর রাওয়ের বোধোদয় ঘটেছে যে, বিজেপির সঙ্গে কেন্দ্রে সম্পর্ক ভালো রাখলেও লাভ হবে না। আজ নয় কাল বিজেপি দখল করতে চাইছে তাঁর রাজ্য এমনকী দলও। তাই তিনি এখন অনেক বেশি মোদিবিরোধী হয়ে গিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে শুধু কংগ্রেসমুক্ত ভারত নির্মাণ করাই যে যথেষ্ট নয়, সেটা মোদি এবং অমিত শাহ বুঝেছেন। কারণ, রাজ্যে রাজ্যে একঝাঁক আঞ্চলিক দল রয়েছে, যাঁদের শক্তি অনেক বেশিই রয়ে যাচ্ছে। তাই আঞ্চলিক দলগুলিকে ধ্বংস করতে উদ্যত বিজেপি। ফর্মুলাটি হল, প্রথমে তাদের সঙ্গে জোট করে বন্ধুত্ব পাতানো। তারপর ধীরে ধীরে তাদের ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানো। কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই দলকে ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস কিংবা দুর্বল করা। অন্য কৌশল হল, কোনওভাবে বশে না এলে সিবিআই এবং ইডি। আঞ্চলিক দলগুলিকে স্থির করতে হবে যে, তারা এই ফাঁদ বাঁচিয়ে নিজেদের একক অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারছে কি না। তাদের সাপোর্ট বেস তারা ধরে রাখতে পারছে কি না। অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়ক, জগনমোহন রেড্ডি, তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদবরা পেরেছেন এখনও পর্যন্ত। বিজেপি এই দলগুলিকে খতম করতে পারছে না। আবার এরকম একঝাঁক রাজ্য আছে, যেখানে কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বিজেপির সংখ্যা ২০২৪ সালে কি কমবে? অবশ্যই। কারণ সিংহভাগ রাজ্যে বিজেপি সর্বোচ্চ প্রাপ্ত আসনে পৌঁছে গিয়েছে। আমরা যদি আমাদের রাজ্যকেই ধরি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আবার ১৮টি লোকসভা আসন পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে? এরকম আরও রাজ্য আছে।
আপাতত কোনও রাজ্যের একক শক্তিশালী আঞ্চলিক দল এনডিএ জোটে নেই। একটিও নয়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে এককভাবে বিজেপিকে গরিষ্ঠতার সংখ্যা পেরতে হবে। আর যদি না পারে? তাহলে কি এই যে আঞ্চলিক দলগুলি আছে তাদের অনেকেই বিজেপিকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসবে না? অবশ্যই আসতে পারে। কিন্তু তখন সেটাই হবে নরেন্দ্র মোদির সবথেকে এক পরাজয়। কারণ দু’বার এককভাবে দাপটে সরকার চালানোর পর, তৃতীয়বার তাঁকে সহ্য করতে হবে শরিকদের চোখ রাঙানি। তখন সেই শরিকরাই সকালে ও বিকালে ব্ল্যাকমেল করে মোদি সরকারকে চালনা করবে। ওয়ান নেশন ওয়ান পার্টির স্বপ্ন দূর অস্ত! দিল্লির মসনদ সামলাতে পারবে তো বিজেপি?