সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। ফাঁসি হওয়ার কয়েকদিন আগে একটি চিঠি লেখেন অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। প্রীতিলতাও কিছুকাল পরে আত্মাহুতি দেন মুক্তির মন্দির সোপানতলে।
মাস্টারদা সূর্য সেনের হাতে-গড়া সূর্যকন্যাকে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে একদিন তোমার ব্লাউজে একখানা স্বামীজির মনোগ্রাম আঁটা দেখেছিলাম। আমার ওটা খুব ভালো লেগেছিল। যুগগুরুর প্রতি অকপট শ্রদ্ধা এমনি করে চিরদিন তোমার অন্তর আলো করে রাখবে কি? ওঁকে তোমার খুব ভালো লাগে, আমারও তাই। কেউ যদি আমায় জিজ্ঞাসা করে, ওঁর কী পরিচয় তোমার জানা আছে? কী জবাব দেব তা ভেবে পাইনে। ওঁকে কতখানিই বা আমরা চিনতে পেরেছি? পশ্চিমের লোকেরা বলেছে Cyclonic Hindu আমার মতে, He is more moral and spiritual force of India. আজকালকার দিনে তো কথা কাটাকাটির অন্ত নেই। কারণ, blind belief জিনিসটা পছন্দ করে না কেউ। ওঁর প্রত্যেকটি কথা শুধু ওঁর কথা বলেই বিনা বিচারে মেনে নেওয়া চলে, ওঁর আদর্শের উপর একান্ত চিত্তে নির্ভর করা চলে। শুধু সেন্টিমেন্টের দিক থেকে আমার এ ধারণা জন্মেনি, ওঁকে চিনবার যেটুকু চেষ্টা করেছি তার তরফ থেকেই আমি বলছি, মনুষ্যত্বের এত বড় আদর্শ আর কেউ দিতে পারেনি, পারবে কি না তাও জানি না। মানুষকে শুধু মানুষ বলেই আর কেউ এমন ভালোবেসেছে কি?’
নিবেদিতার ফ্রেঞ্চ জীবনীকার লিজেল রেঁম তাঁর বইয়ের কাজের জন্য দেখা করেছিলেন বিবেকানন্দ-অনুগামী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের সঙ্গে। লিজেল রেঁম লিখেছেন, ‘মিস ম্যাকলাউড স্বামী বিবেকানন্দের কিছু চিঠি দেখিয়ে আমাদের বলেছিলেন, এগুলি একেবারে আগুনে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কালে লেখা। স্বামীজি অনেক কিছুই করেছিলেন। চন্দননগরের মধ্য দিয়ে ভারতে অস্ত্র চালান হয়েছে। আমি সেগুলি কিনেছি। অস্ত্রশস্ত্রসহ একটি নৌকা ধরা পড়ে, কিন্তু তার সূত্রে কাউকে ধরা যায়নি।’
রেঁম আরও লেখেন, ‘আমরা মিস ম্যাকলাউডকে ঐসব চিঠি নষ্ট করতে দেখেছি। তিনি বললেন, এসব অতীত ইতিহাস। সে যাইহোক একদিন ভারত স্বাধীন হবে— স্বামীজি খুশি হবেন।’
মিস ম্যাকলাউডের এই কথায় বোঝা যায় অগ্নিযুগের ঊষালগ্নে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন ভারতের বিপ্লবপ্রচেষ্টায়। লেখিকা লিজেল রেঁমকে কথিত ম্যাকলাউডের বক্তব্যে প্রকাশ— তিনি ভারতের মুক্তিসংগ্রামে জড়িত ছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিপদসংকুল কাজেও।
প্রশ্ন ওঠে, কার নির্দেশে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন এই অস্ত্র সংগ্রহে অথবা তা তুলে দিতে চেয়েছিলেন কার হাতে?
এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের মেলেনি উত্তর। অনেক কুয়াশা ধোঁয়াশায় পথ চলতে চলতে মনে হয় গ্রন্থিমোচনের জায়গা একটিই।
জোসেফিন ম্যাকলাউড একদিন বিবেকানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘স্বামীজি, কীভাবে আপনাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারি?’ অরবিন্দের ‘প্রেরণাপুরুষ’ বিবেকানন্দের তুরন্ত জবাব, ‘ভারতবর্ষকে ভালবাসো।’
দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের আর এক প্রেরণাপুরুষ অরবিন্দ। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখেছেন, ‘কলেজের ছাত্ররূপে যা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, তা অরবিন্দের নামকে ঘিরে দুর্জ্ঞেয়তা নয়, বরং তাঁর রচনা ও পত্রগুলি। অরবিন্দ তখন আর্য্য নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করতেন। বাংলাদেশে কয়েকজন বিশেষ লোকের কাছে তিনি পত্রও লিখতেন। ঐসব পত্র হাতে হাতে দ্রুত ঘুরে বেড়াত, বিশেষত সেইসব মহলে যারা আধ্যাত্মিকতা মিশ্রিত রাজনীতিতে আগ্রহী ছিল। আমাদের মহলে সাধারণত কোনও একজন পত্র পড়িয়ে শুনাত এবং আমাদের মধ্যে বাকি সকলে তা থেকে উদ্দীপনা লাভ করত। এরূপ একটি পত্রে অরবিন্দ লিখেছিলেন, আমাদেরকে অবশ্যই দিব্য আলোকশক্তির উৎস হতে হবে, যাতে আমাদের প্রত্যেকে যখন উঠে দাঁড়াবে তখন চতুর্দিকে হাজার হাজার জন সেই আলোকে উদ্ভাসিত হবে— স্বর্গীয় সুখ ও আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমরা নিশ্চিতরূপে বুঝেছিলাম যে, জাতীয় সেবাকে কার্যকরী করতে আধ্যাত্মিক সিদ্ধির প্রয়োজন।’
বাংলার বৈপ্লবিক সাহিত্যের মধ্যে বিশেষ স্মরণযোগ্য অরবিন্দের ‘ভবানী মন্দির’— পুলিস বিপজ্জনক সাহিত্য মনে করে সেটিকে বাজেয়াপ্ত করে। তাঁর ‘বাজীপ্রভু’ কবিতাতেই সর্বপ্রথম ‘মা ভবানী’র সন্ধান মেলে। বরোদায় থাকতে অরবিন্দের কবিকল্পনাকে ছত্রপতি শিবাজির আরাধ্যা দেবী ‘মা ভবানী’ কতখানি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তা এই কবিতাটি পড়লেই বোঝা যায়। মহারাষ্ট্রের দুর্গম গিরিপথের প্রবেশমুখে বিশাল মোগল সৈন্যকে মা ভবানীর ভক্ত বাজীপ্রভু মাত্র পঞ্চাশজন সঙ্গী নিয়ে কীভাবে জীবনের বিনিময়ে পর্যুদস্ত করেছিলেন, স্বাধীনতা রক্ষার সেই রক্তস্নাত কাহিনি এই কবিতার বিষয়বস্তু।
১৯০৫ সালের শেষের দিকে অরবিন্দ বরোদা থেকে কলকাতা আসার পূর্বে লেখেন ‘ভবানী মন্দির’। পনেরো-ষোলো পাতার ইংরেজিতে লেখা চটি বইটি তিনি বারীন্দ্রকুমারকে দিয়ে পাঠান কলকাতায়।
বারীন ঘোষ কলকাতায় এসে ‘ভবানী মন্দির’ চটি বইখানি রাতারাতি ছেপে গোপনে শুরু করেন বিলি করতে। বিপ্লবীদের মৃত্যুভয় অতিক্রম করে অমিততেজা করে তুলতেই এই রচনা। শক্তিমূর্তি ভবানীর উদ্দেশে একটি স্তব দিয়ে শুরু— গুপ্ত সমিতির বেদ ‘ভবানী-মন্দির’ বইখানি।
ভবানীর মন্দির প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে অরবিন্দের নির্দেশে বারীন ঘোষ গিয়েছিলেন শোন নদের তীরে কাইনুর পাহাড়ে। তিনি মন্দিরের জন্য জমি দেখতে গিয়ে ফিরে আসেন মাসখানেক কাটিয়ে। ১৯০৬ সালে বরোদায় থাকতেই অরবিন্দ ভারতবর্ষের কোনও এক দুর্ভেদ্য মনোরম স্থানে এই মন্দির স্থাপনের চিন্তা করেছিলেন। সেই সময় তিনি প্রত্যুষে স্নান সেরে প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ করতেন।
১৯১৮ সালে রাওলাট কমিটি বিস্তৃত আলোচনা করে ভবানী মন্দির সম্বন্ধে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর অনুকরণে যে এটা লিখিত এ কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হলেও তখন বিস্ময়করভাবে এর প্রকৃত লেখক রয়ে গিয়েছেন অজানা, অধরা।
১৯০৬ সালে ইউরোপ যাত্রার সময় বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো পর্যন্ত জানতেন না যে ‘ভবানী মন্দির’-এর লেখক অরবিন্দ। ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’ গ্রন্থে তিনি লেখেন ‘আনন্দমঠের অনুকরণে ভবানী মন্দিরের খেয়াল দেবব্রতবাবুর মাথায় এসেছিল। শুনেছিলাম, তাঁর মতলব ছিল, লোকচক্ষুর আড়ালে পাহাড়ে বা জঙ্গলে এক একটি কুটীর করে তাতে কালীমূর্তি স্থাপন করা। ভক্তদের ভয় ও ভক্তি উদ্রেকের জন্য যতরকম আড়ম্বর ও উপসর্গ হতে পারে, তাতে তা থাকবে। একজন সত্যানন্দের মতো গেরুয়াধারী পূজারী সেখানে থেকে ভবানীর নানা রূপের নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়ে ভক্তদিগকে ভবানীরূপী দেশ উদ্ধারের জন্য সম্মোহিত করবে। খরচ সঙ্কুলানের এবং পুলিসের চোখে ধুলো দেবার জন্যে সেখানে হবে চাষ-আবাদের চেষ্টা। শক্তি অনুশীলনের জন্য লাঠি, তলোয়ার, বন্দুক পিস্তল প্রভৃতি ব্যবহার শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।’
এখানে বলে রাখা ভালো, বিপ্লবীদের মধ্যে অরবিন্দ-অনুরাগী ছিলেন না হেমচন্দ্র কানুনগো। বরং অরবিন্দ-বারীন্দ্র-দেবব্রতর বিরুদ্ধে বার বার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অন্তহীন বিতৃষ্ণা। অনেক তাঁর অভিযোগ। অরবিন্দ ছোটভাই বারীন্দ্রের বিষয়ে স্নেহান্ধ। অন্যদের সম্বন্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ। ক্রান্তিলগ্নে নেতাদের লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাওয়াকে ক্ষমা করতে পারেননি কখনও, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও কম করেননি। অভিযোগ এনেছেন— ‘দীক্ষাদাতা গুরু নিজে যদি এই ব্রত লঙ্ঘন করেন, তবে তাঁর কি দণ্ডের ব্যবস্থা হবে, বা কে ব্যবস্থা করবে, এ কথা দুর্ভাগ্যবশতঃ কারো মনে এসেছিল বলে শুনিনি।’
অবশ্য হেমচন্দ্র পাঠকদের আশ্বস্ত করে এমনও বলেছেন ‘মহৎ উদ্দেশ্যে তাঁদের [অরবিন্দ, বারীন্দ্র প্রমুখের] দেশসেবার সমালোচনা করেছি। ‘ক’-বাবু [অরবিন্দ] ও বারীনের প্রকৃত স্বরূপ যা, তা থেকে তাঁরা একটুও ছোট বা হীন হবেন না।’
ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে, চারের দশকের শুরুর দিকে গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় লিখছিলেন অরবিন্দের বিপ্লবপ্রচেষ্টার বিষয়ে। তখন গিরিজাশঙ্কর ‘বিশ্বস্তসূত্রে’ শোনেন, ‘[শ্রীঅরবিন্দ বলিয়াছেন] আমার রাজনৈতিক জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশগুলিকে (‘dark period’) কেহ লেখে, ইহা আমি ইচ্ছা করি না। যদি কেহ সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস উদ্ধার করে, সে আমার মুখের হাসি কাড়িয়া লইবে।’
গিরিজাশঙ্করের অনেক আগেই কিন্তু সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশগুলির উপর তীব্র রোষ-কষায়িত আলোকপাত করেছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো। সেখানে অবশ্য অরবিন্দকে স্ব-নামে উল্লেখ বা চিহ্নিত না করে কিঞ্চিৎ সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পরিচায়িত ‘ক’-বাবু নামে।
বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো সম্বন্ধে আরও একটি বিস্ময়ের ব্যাপার লক্ষণীয়। ভগিনী নিবেদিতা সারা দেশ ঘুরে দলে রিক্রুট করতেন, একথা স্বয়ং অরবিন্দও বলেছেন। নিবেদিতার চিঠিপত্রেও পাওয়া যায় আভাস ইঙ্গিত। ১৯০৩-এর জুনে তেমনি এক সফরে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরে।
পরবর্তীকালে হেমচন্দ্র কানুনগো নিবেদিতার পাঁচদিন মেদিনীপুর অবস্থানের একটি সুন্দর বর্ণনা লেখেন মাসিক বসুমতীতে প্রকাশিত ‘বাংলার বিপ্লব কাহিনী’ ধারাবাহিকে। কিন্তু কোনও দুর্বোধ্য কারণে পরে নিবেদিতা সংক্রান্ত অংশটি তিনি বাদ দেন ‘বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা’ গ্রন্থখানিতে।
মাসিক বসুমতীর পৌষ, ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ও গ্রন্থে বর্জিত নিবেদিতা সম্পর্কিত অংশে হেমচন্দ্র লিখেছিলেন—
‘১৯০৩ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে, বোধহয় জুন মাসে, শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতী ভগিনী নিবেদিতা অ-বাবুর চেষ্টায় মেদিনীপুরে এসেছিলেন। ... তাঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্য মেদিনীপুর স্টেশনে সমিতির সভ্যগণ প্রায় সকলে ও অন্যান্য ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। গাড়ি স্টেশনে থামলে তাঁকে দেখে অনেকে হিপ-হিপ হুর্রে বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। এই না শুনে তিনি আঁতকে উঠলেন এবং নিষেধসূচক হাত নেড়ে চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন। আমরা নিশ্চয় অবাক হয়েছিলাম। তখন তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, হিপ্-হিপ্ হুররে ইংরাজ জাতির জাতীয় উল্লাসধ্বনি, ভারতবাসীর উল্লাসধ্বনি ইহা হওয়া উচিত নহে। তখনও বন্দেমাতরম্ ব্যবহৃত হয়নি। যখন বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আমাদের তেমন কিছুই নাই, তখন তিনি নিজ হাত তুলে উচ্চস্বরে তিনবার বলেছিলেন— ওয়া গুরুজি কি ফতে, বোল বাবুজি কি খাল্সা। আমারও তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। ... একজন ওহেন ইংরাজ মহিলাকে, আমরা এই ইংরাজ তাড়াবার ব্যাপারে সহায় পেলাম মনে করে, অন্ততঃ আমাদের মিইয়ে যাওয়া উদ্যম ও আগ্রহ আবার তাজা হয়ে উঠল।
সেই অসাধারণ করুণাময়ী ভগিনীর বিষয়ে এখানে কিছু না বলে পারলাম না। ...তিনি এখানে পাঁচদিন ছিলেন। প্রত্যহ সন্ধ্যায় ধর্মের মধ্য দিয়ে রাজনীতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতেন; সকালে সে সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তর দিতেন। প্রথম দিনের বক্তৃতায় অনেক লোক এসেছিল, বক্তৃতা শেষ হওয়ার পূর্বে অনেকে সরে পড়েছিল। সেজন্য স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত একজন উচ্চ কর্মচারী তাঁকে বলেছিলেন— আপনার বক্তৃতায় রাজনীতির তীব্রতা বেশি ছিল বলে অনেকে সরে পড়েছিলেন। পরের বক্তৃতায় হয়তো লোক হবে না।’
বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোর গ্রন্থে বর্জিত, মাসিক বসুমতীর ধারাবাহিকে বর্ণিত অংশে জানা যায়— উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কথার উত্তরে নিবেদিতা বলেছিলেন, ‘আপনি আমায় ভয় দেখাবেন না। আমার শিরাতে স্বাধীন জাতির রক্ত এখনো প্রবাহিত। যারা ভয় পায়, আমার বক্তৃতা তাদের জন্য নয়।’
হেমচন্দ্র লিখছেন, ‘ভগিনী নিজে তলোয়ার খেলে, মুগুর ভেঁজে, লাঠি ঘুরিয়ে ও অন্যান্য কসরত করে আমাদিগকে অনুপ্রাণিত করে দিয়েছিলেন। ... ভগিনীর আগমন ব্যাপার আমাদের মরাগাঙ্গে আবার বান ডাকিয়ে দিল।’
যে-সব বিপ্লবী যুবকের উপরে নিবেদিতার ‘কালী দি মাদার’ বইয়ের গভীর প্রভাব, তাঁদের অন্যতম বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘Sister Nivedita wrote an inspiring booklet Kali the Mother. That book served as an inspiration to our workers.’
অরবিন্দ যখন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হননি, চলছে মানসিক প্রস্তুতি-পর্ব এমন সময় তাঁর হাতে আসে উত্তরকালের বিপ্লবীদের মন্ত্রপুস্তক নিবেদিতার এই বই। এটি পড়ে তিনি কতটা প্রবল উদ্দীপনা বোধ করেন সে-সম্বন্ধে বলেন, ‘I was very much enamoured at the time [When in Baroda] of her book, Kali the Mother’
অরবিন্দ সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘তাঁর (নিবেদিতার) বই কালী দি মাদার উদ্দীপনাপূর্ণ বই, তেমনি বিদ্রোহমূলক, অহিংস নয়।’ (শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে কথাবার্তা, নীরদবরণ)
অরবিন্দের ‘ভবানী মন্দিরের’ উপর নিবেদিতার ‘কালী দি মাদার’-এর ছিল গভীর প্রভাব। উভয় পুস্তকের স্টাইলের মধ্যেও ‘অদ্ভুত ঐক্য’ বা সাযুজ্যের কথা বলেন অনেকে। তবে ‘ভবানী মন্দির’-এর প্রকৃত লেখক যে অরবিন্দ— তা প্রকাশ হতে কেটে যায় বহুকাল। বিস্ময়ের শেষ থাকে না যখন হেমচন্দ্র কানুনগোর মতো বিপ্লবী অরবিন্দের রচনা ধরতে না পেরে গুলিয়ে ফেলেন দেবব্রত বসুর লেখার সঙ্গে। ‘যুগান্তর’-এর আড্ডার কথায় হেমচন্দ্র লেখেন, ‘ওই (যুগান্তর) অফিসেই তখনকার গুপ্তসমিতির আড্ডা ছিল। এইটেই বঙ্কিমবাবুর আনন্দমঠের বা দেবব্রতবাবুর ভবানী মন্দিরের স্থানীয় ছিল বললেও হয়। কিন্তু ভবানী মূর্তি এতে ছিল না। নীচের তলায় ছিল প্রেস। ওপরের তলায় অফিস, শোবার ঘর আর একটি ছোট্ট কুঠরীতে একটি কাঠের সিন্দুক ছিল। তাতে থাকত নাকি অস্ত্রশস্ত্র। তার সারানো ও পর্যবেক্ষণের ভার ছিল একটি অজাতশ্মশ্রু বালক নেতার ওপর। এঁর কাছে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের একটু বেশি রকম লম্বা-চওড়া বচন শুনে, একদিন গোটাকতক রিভলবার কিনতে গেছলাম! দেবব্রতবাবু সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই অস্ত্রাগারে তিনি আমায় খুব ভারী চালে, অন্তত আধ ঘণ্টা অনেকরকম বচন দিলেন। আমি রিভলবারের কথা তুলতে, তিনি সেই বালক নেতাকে ডেকে রিভলবার দেখাতে আদেশ দিলেন। একটা সেকেলে রিভলবার আমায় দেখানো হলো। আমি নগদ মূল্যস্বরূপ কয়েকখানা নোট বের করে তিনটে কি চারটে রিভলবার চেয়ে বসলাম। তাতে বুঝলাম, সেই একটি মাত্র সম্বল। আর বুঝলাম, অস্ত্রাগারের শূন্যতা পূরণের জন্য ছিল এত বচন। শীঘ্র পাঠিয়ে দেবার কথাতে মূল্য জমা নিলেন। তারপর অনেক তাগাদা করে দু’মাস পরে একটি মাত্র ভাঙা পুরনো রিভলবার আদায় করতে পেরেছিলাম। তাও সারাবার জন্য পাঠিয়ে আর ফেরত পাইনি।
এই চাঁপাতলার আড্ডাতেই প্রথম নরেন গোঁসাই-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।’