বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
দিল্লি থেকে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছিলেন তিনি একটি এয়ারফোর্স ট্রান্সপোর্ট এরোপ্লেনে। পাশেই ছিলেন এয়ার কমান্ডার সুন্দরাজন। অ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সুন্দরাজন জাফার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এই দৃষ্টিটা খুব অস্বস্তিকর। আর ভয়ের। কারণ এয়ারফোর্সে তাঁদের ইউনিটে সকলে জেনে গিয়েছে সুন্দরাজনের একটা অদ্ভুত ক্ষমতার কথা। সেটা জ্যোতিষবিদ্যা নাকি কোনও বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তি কেউ জানে না। কিন্তু কমবেশি সকলেই বিশ্বাস করে যে, অ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুন্দরাজনের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান এবং সেটা হাত দেখে, ললাটলিখন পাঠ করে কিংবা ঠিকুজি কোষ্ঠীর মাধ্যমে নয়। সুন্দররাজন নাকি হঠাৎ স্থির হয়ে কোনও একজনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর তারপর কিছুক্ষণ কোনও কথা বলেন না। বেশ কিছু সময় পর তিনি নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলতে শুরু করেন। মৃদু কণ্ঠে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট। সেই কথাগুলিই আসলে তাঁর দেখা ভবিষ্যতের বিবরণ। এর আগে এরকম কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি স্কোয়াড্রন লিডার জাফার। সেদিন প্রথম। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন সুন্দররাজন সম্ভবত আবার সেই বিশেষ শক্তির আভাস পাচ্ছে। এবার কি তাহলে তাঁর সম্পর্কেই কিছু বলবেন? ভবিষ্যৎ? সর্বনাশ! কী কপালে আছে কে জানে! এখন আকাশে বাতাসে যুদ্ধের ধ্বনি। শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনও সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এরকম সময়েই হঠাৎ সুন্দরাজন তাঁর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন মানে হয় জয় অথবা পরাজয়! হয় বেঁচে থাকা। অথবা মৃত্যু! স্মার্ট এবং চূড়ান্ত আধুনিক মনস্ক স্কোয়াড্রন লিডার জাফা পর্যন্ত একটু যেন অস্বস্তিতে। ভাবছেন, এসব বিশ্বাস করা উচিত? কিন্তু সুন্দরাজন তো অনেকের ভবিষ্যৎ মিলিয়ে দিয়েছেন! ফাইটার জেট ক্র্যাশ করে পাকিস্তানের মাটিতে এসে পড়া জাফার এরকম এক বিপদসঙ্কুল সময়ে সেই সেদিনের প্লেনের মধ্যে ঘটা ওই সুন্দরাজনের দৃশ্যটি চোখের সামনে ঠিক সিনেমার মতো ভেসে উঠছে। সুন্দরাজনকে জাফা বলেছিলেন, কী ব্যাপার স্যার! কিছু বলবেন?
সুন্দরাজন কোনও উত্তর না দিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন, দু’মাস... ঠিক দু’মাস...
জাফা ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, দু’মাস? কীসের দু’মাস?
সুন্দরাজন বলছেন, একটা অ্যাক্সিডেন্ট...দু’মাস পর একটা অ্যাক্সিডেন্ট... তারপরই চোখ বুজে তিনি নিজের মাথাটা চেপে ধরেন।
জাফা উদগ্রীব হয়ে জানতে চান যে, কী হল? বলুন স্যার, তারপর কী?
সুন্দরাজন একটু ধাতস্থ হয়ে বলছেন, ডোন্ট ওরি! তুমি প্রাণে বেঁচে থাকবে। কিছু হবে না। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট হবে। আর একটা সাংঘাতিক অ্যাবনর্মাল সিচ্যুয়েশনের মধ্যে থাকতে হবে।
জাফা বুঝতে পারছেন না কেমন অ্যাবনর্মাল পরিস্থিতি! কী হতে পারে?
সুন্দরাজন বললেন, আমি এর বেশি আর কিছু দেখলাম না। একটা কোথাও তুমি পড়ে আছো। আহত। এটা বুঝলাম। তারপর কী সেটা জানি না। বাট অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্যাট, দেয়ার উইল বি হোপ অ্যান্ড লাইফ!
আজ ঠিক দু’মাস পর সেরকমই অবিকল পরিস্থিতি। একটু আগেই পাকিস্তানে বোমা ফেলতে এসে প্লেন ভেঙে পড়েছে ভারতের এয়ারফোর্স অফিসার জাফার। এখন তিনি শত্রুরাজ্যে। অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর। আর এরকম সময়ে সেই সুন্দরাজনের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়ছে। কীভাবে হুবহু মিলে গেল সুন্দরাজনের ওই পূর্বাভাস? এও কি সম্ভব?
হঠাৎ ভিড় সরিয়ে লম্বা একটা চেহারা জাফার সামনে উপস্থিত। দেখেই জাফা বুঝতে পারলেন পাকিস্তান আর্মির অফিসার। লোকটা বলল, অস্ত্র আছে?
জাফা কোনও বাক্যব্যয় না করে মাথা নেড়ে পিছনে কোনওমতে হাতটা নিয়ে গিয়ে রিভলবার দিয়ে দিলেন।
পাকিস্তানি আর্মি অফিসার জানতে চাইলেন, ইনজুরি? কোথায় জখম আছে? হাঁটতে পারবেন?
জাফা বললেন, মনে হয় কোমরটা ভেঙেছে। উঠতে পারছি না।
এখন আর স্কোয়াড্রন লিডার জাফার কোনও টেনশন নেই। যে কোনও সামরিক অফিসার শত্রুরাষ্ট্রে ধরা পড়লে কিংবা প্লেন ক্র্যাশ হলে অন্য দেশের মাটিতে পড়লে, সবার আগে চায় যেন আর্মি এসে ক্যাপচার করে। কারণ, একবার যুদ্ধবন্দি হয়ে গেলে সেটা অফিসিয়াল হয়ে যায়। তখন গণপিটুনিতে আর মরতে হবে না। ওয়ার কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করতে হবে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে। এবার তাই জাফা স্বস্তি পেলেন।
চা খাবেন? সেই অফিসার জানতে চাইলেন। মাথা নাড়লেন জাফা।
এবার পশতু ভাষায় সেই অফিসার কাউকে কিছু নির্দেশ দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে চা হাজির। কিন্তু উঠে বসে চা খাওয়ার ক্ষমতা নেই।
অতএব চোখের ইশারা করলেন সেই অফিসার।
এক পাকিস্তানি জওয়ান এগিয়ে এসে একটা বাটিতে চা ঢেলে চামচ দিয়ে দিয়ে জাফাকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। গরম চা খেয়ে বেশ চাঙ্গা লাগছে।
সেই অফিসার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এবার পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে জাফার মুখে বসিয়ে দিয়ে হাসলেন। বললেন, রিলাক্স। আমরা কিছুক্ষণ পর ক্যাম্পে নিয়ে যাব। আজ আমাদের দু’জনও আপনাদের ওদিকে ক্যাপচারড হয়েছে। আর আপনি এখানে। বলে হাসলেন।
জাফার মুখে হাসি। কী আশ্চর্য! কয়েকদিন ধরে তিনি এই শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছিলেন একের পর এক ফাইটার প্লেনের আক্রমণে। আর তাঁকে আজ এই লোকগুলোর আতিথেয়তায় শুয়ে থাকতে হবে! কতদিন? এরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে? নাকি মেরে ফেলবে? যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? আমরা জিতব তো? এসব ভাবতে ভাবতে চা আর সিগারেট খেয়ে নার্ভগুলো যেন একটু শিথিল হয়ে গেল। এবার স্কোয়াড্রন লিডার জাফার ঘুম পাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে আসছে ধোঁয়া ধোঁয়া একটা শরীর...সঙ্গীতার মুখটা মনে পড়ছে... আর কি দেখা হবে? শেষবার কী যেন চিঠি দিয়েছিল সঙ্গীতা? স্কোয়াড্রন লিডার জাফার চোখে নেমে এল গভীর নিদ্রা!
....
ওই যে জামালপুর। ভারতের বর্ডার আউটপোস্ট থেকে দেখতে পাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ব্রার। যাঁকে সকলেই বুলবুল নামে ডাকে। জামালপুর দখলের দায়িত্ব তাঁর উপরে পড়েছে। তাঁর সামনে বসে আছে দু’জন মানুষ। আবু বকশি আর হান্নান। দুই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের হাত ধরে দু’টি মেয়ে। আর তাদের মা। এঁরা পালিয়ে এসেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে উদ্বাস্তু হয়ে পালানো চলছে সেই এপ্রিল থেকে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার পর জামালপুরের মানুষ দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। টাঙ্গাইলের মধুপুর ব্রিজ আটকে রেখেছিল তারা দীর্ঘদিন। যাতে হানাদার খান সেনারা ঢুকতে না পারে।
কারা ছিলেন সেই মরণপণ সংগ্রামের নেতৃত্বে? অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম, পাকিস্তানের এয়ারফোর্সে চাকরি করা মেহবুব হোসেন চৌধুরী, পাকিস্তান নেভির জওয়ান মন্টু, সার্জেন্ট মনিরুজ্জামান। আর অসংখ্য সাধারণ মানুষ। কিছুতেই এই মানুষদের হারানো যাচ্ছে না। অবশেষে ২২ এপ্রিল আকাশে দেখা যায় ফাইটার জেটের সারি। অর্থাৎ পাকিস্তান এয়ারফোর্স এবার সিভিলিয়ানদের উপর চালাবে বিমান আক্রমণ। অসংখ্য বোমা ফেলা হচ্ছে। মারা যাচ্ছেন শাহপুরের আবদুল হাই, জেলা স্কুল রোডের তারাপদ শীল, মাতৃসদন রোডের মদন সরকারের মতো অজস্র সাহসী মানুষেরা। তাদের মৃতদেহের উপর দিয়ে ঢুকল পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক।
মধুপুর ব্রিজের ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়ার পর যখন পাকিস্তান আর্মি প্রবেশ করল জামালপুরে, তখন শুরু হল এক অবর্ণনীয় অধ্যায়। পিটিআইতে ক্যাম্প তৈরি করে পাকিস্তানের খান সেনার বাহিনী শহরে, জনপদে ঢুকে ঢুকে চালাচ্ছিল নির্বিচার গুলি। দয়াময়ী মন্দির মর্টার দিয়ে ভেঙে ফেলা হল, সাধু মহারাজকে কুয়োয় ফেলে দেওয়া হল, আগুনে পুড়ে যাচ্ছে পাথালিয়া, ঢাকাই পট্টি, তমালতলা মোড়, মেডিক্যাল রোড, স্টেশন রোড, দয়াময়ী মোড়।
আর থাকা গেল না। তাই সেই শুরু হয়েছিল জামালপুর থেকে পালানো। পাক বাহিনী এই শহর, এই জেলাকে ধ্বংস করে দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাইছে। কর্নেল আবু তাহের ঠিক করলেন নাগরিকদের নিয়ে সীমান্ত এলাকায় নয়তো ভারতে আশ্রয় নেবেন। সেইমতো রাতের অন্ধকারে পালিয়েছিলেন জামালপুর থেকে। বকশিগঞ্জ পেরিয়ে দিনরাত হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা যেখানে এসে শিবির তৈরি করলেন, সেই খবর পেয়েই হাজির ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। জায়গার নাম মানকর চর। ভারতের মেঘালয় আর অসমের সীমান্তবর্তী এক নদীচর। পরিচয় পেয়ে বিএসএফকে আবু তাহের বললেন, ‘সার, আমরা এখানে শুধুই আশ্রয় নিতে আসিনি। আমাদের ট্রেনিং চাই। আমরা যুদ্ধ করব ওদের বিরুদ্ধে।’
শুরু হয়েছিল ট্রেনিং। একটি করে ট্রেনিং সেশন শেষ হয়, আর একটি করে টিম গোপনে ঢুকে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। এভাবে আজ এই ডিসেম্বর মাসে গোটা জামালপুরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তাঁরা বীরের মতো আক্রমণ করে পাকিস্তানকে রীতিমতো নাজেহাল করে রেখেছে। এবার ভারতের পালা।
জামালপুর হল মুক্তিযোদ্ধাদের ১১ নম্বর সেক্টর। ১১ নম্বর সেক্টরকে ৮টা সাব সেক্টরে বিভাজিত করা হয়েছে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকরচর, পুরকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ি, রংড়া, মহেশখোলা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করিডর ছিল কামালপুর। বকশিগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল। সেখানে থেকে সোজা গেলে ঢাকা। ১২ মে থেকে ২৮ নভেম্বর এই পর্বে মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাকিস্তান সেনার মধ্যে শুধু এই ১১ নম্বর সেক্টরে হয়েছে ৫২ বার যুদ্ধ। সাধারণ মানুষকে নিয়ে তৈরি হওয়া সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের অফিসিয়াল সেনাবাহিনীর এরকম একের পর এক যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছে? ১৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। আর তার পাল্টা পাকিস্তানের ৫৭৬ জন সেনাকে খতম করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।
১৪ নভেম্বরের যুদ্ধে আবু তাহেরের পায়ে মর্টার শেল এসে বিঁধেছে। তাই তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয় নেতৃত্ব দেওয়া। এখন নেতা উইং কমান্ডার হামিদুল্লা খান। ভারতীয় সেনাকে তিনি খবর দিয়েছেন দু’দিক থেকে তারা প্রথমে ঘিরে ফেলবে পাকিস্তানকে। তারপর ভারত প্ল্যান করবে কীভাবে জামালপুরকে মুক্ত করা যায়। ভারত যেভাবে বলবে, এরপর অগ্রসর হওয়া যাবে সেভাবে। অতএব হামিদুল্লার মেসেজের অপেক্ষায় রয়েছেন লেফটেন্যান্ট বুলবুল। কিন্তু এখন তাঁর সামনে বসে আছে দু’টি মেয়ে আর তাঁদের মা। বকশিগঞ্জ থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু কাঁদছে।
তোমাদের কোনও ভয় নেই। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। এখানে ক্যাম্প আছে। তোমাদের পৌঁছে দেওয়া হবে। আবু আর হান্নান এদের পৌঁছে দিয়েই আবার ফিরবে। কিন্তু এই মেয়েরা আর মা কিছুতেই ক্যাম্পে যাবে না। তারা এখানেই এই বর্ডারে যুদ্ধের মধ্যেই বসে থাকতে চায়।
বিরক্ত হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্রার। তবু এদের অবিশ্রান্ত কান্না দেখে বুঝতে পারছেন কিছু একটা সাংঘাতিক হয়েছে এদের ভাগ্যে। এবার হান্নান বলল ঘটনা। স্যার, ওরা পাঁচজন ছিল। মেয়ে দুটোর বাবাকে গুলি করেছে পাকিস্তানি সেনারা। এদের চোখের সামনে। আর একমাত্র ভাইকে আটকে রেখেছে। সেই ভাইকে না নিয়ে এরা বলছে যাবে না। কত বয়স ভাইয়ের? ১১। হঠাৎ সেই মা পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বললেন, সার, আপনিই পারেন আমার ছেলেকে উদ্ধার করতে। আমাকে আমার ছেলে ফিরিয়ে দিন। দুই বোনও মায়ের দেখাদেখি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল পায়ের কাছে। আমাদের বাবাকে মেরে ফেলেছে। একমাত্র ভাইটাকে বাঁচান স্যার। স্তব্ধ হয়ে লেফটেন্যান্ট ব্রার ভাবছেন কর্নেল প্রদীপ সাক্সেনার কাছে শোনা একটি মর্মান্তিক কাহিনির কথা।
তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি। আগস্ট মাস। ত্রিপুরার বর্ডার আউটপোস্টে ছিলেন কর্নেল প্রদীপ সাক্সেনা। অবিরত উদ্বাস্তু স্রোত। আসছে। ঢুকছে। ভারতে পা রেখে তারা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলে বসে পড়ছে। মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বস্তি! কর্নেল সাক্সেনা দেখলেন তিনজন মেয়ে রাস্তায় বসে পড়েছে। একজনের বয়স বেশি। সম্ভবত সে এদের মা। মেয়েদের দুটোর বয়স দশ-বারোবছরের মধ্যে। প্রদীপ সাক্সেনার কাছে এসেছে বেশ কিছু খাম। পার্সেল। তাঁর কমান্ডের মধ্যে থাকা জওয়ান আর অফিসারদের জন্য রাখি এসেছে বাড়ি থেকে। আজ রাখিবন্ধন। হঠাৎ প্রদীপ সাক্সেনার দিকে চোখ পড়ল তাদের উপর। রাইফেল হাতে বসে থাকা ইন্ডিয়ান আর্মির কর্নেলকে একটি মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, সার, আজ কি রাখি?
সাক্সেনা বুঝতে পারছেন না বাংলা কথা। তবে বাংলা জানা স্টাফ আছে। তাকে ডাকার পর সে ওদের বলল, হ্যাঁ। আজ রাখি। কেন? একথা শুনে হঠাৎ যেন একটা আকাশ কালো করা মেঘ এল। তাদের চোখে। মাটিতে প্রায় শুয়ে পড়ল দুই বোন। কাঁদতে কাঁদতে। কী ব্যাপার?
জানা গেল, গতকাল রাতে তাদের বাবাকে আর ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানের খান সেনারা। বাবাকে মারার পর তাদের দিকে আঙুল তুলে বলেছে চলে যা তোরা। তারা ভয়ার্ত হয়ে বলেছে, ভাইকে ছেড়ে দাও...দিদিকে ছেড়ে দাও...। পাকিস্তান সেনারা ৬ বছরের ভাইকে হাত বেঁধে বলেছে, এটা বড় হলে আমাদেরই শত্রু হবে। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। বলেই গুলি করে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ভাইয়ের বুক থেকে। আর ১৬ বছর বয়সি দিদিকে আটকে রেখেছে তারা! আজ রাখিবন্ধন। আর তার আগের দিন ভাইটাকে মেরে ফেলল! তিনটি নারীকণ্ঠের আকুল কান্নায় যেন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
কর্নেল প্রদীপ সাক্সেনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমাদের ভাইকে আমি ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু দিদিকে আমি ফিরিয়ে দেব। কথা দিলাম। বলেই বাঘের ক্ষিপ্রতায় উঠে গিয়ে তিনি বিএসএফের পোস্ট কমান্ডারকে বললেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ফ্ল্যাগ মিটিং ডাকুন। ইমিডিয়েট!
(চলবে)