বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
আমার মধ্যে একটা বাউণ্ডুলে ছেলে ছিল। সে জন্ম থেকে আমার মধ্যে বেড়ে উঠেছিল, নাকি পরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল কে জানে! তখন বছর চোদ্দো বয়স, সকালবেলা সাইকেল চালিয়ে মাইল চারেক দূরের হলদি নদীর ধারে চলে যেতাম। সেখানে একটা অনাদরের ন্যাড়ামুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। ও ছিল শীতের পাতাঝরা গাছ। বসন্তে শরীর উজাড় করে লাল রঙের ফুল ফোটাত। আমি তার একফালি ছায়ার নীচে বসে হলদিকে দেখতাম। সেই বয়সে যেসব কিশোরী আমার প্রণয়-প্রস্তাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হলদি নদীর জলে তাদের গ্রীবাভঙ্গি ছায়াছবির মতো ভেসে উঠত! সে দৃশ্য ছিল গোটা পৃথিবীতে আমার একার।
বাউণ্ডুলে ছেলেটা আমার সঙ্গেই ঘুরে বেড়াত। আমি তখন মহিষাদল রাজ কলেজে বাংলা অনার্স পড়ি। তখন ছিল ভণ্ডুল পড়াশোনার যুগ। পুলিসে-বন্দুকে-বারুদে বিলীন করে দিচ্ছিল এক-একটা তরুণ প্রাণ! তখন একবার ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা শেষ হলে তার রেজাল্ট বেরত দেড় বছর পর। সেই অতি লম্বা ছুটির দিনে একদিন আমার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল বাউণ্ডুলেপনা। আমাদের মেদিনীপুরের রাজারামপুর গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় হৃষীকেশকাকার লসে-চলা একটা ছোটমতো যাত্রার দল ছিল। তাঁর বাড়ি গিয়ে বললাম, ‘ঋষিকাকা, আমার পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। রেজাল্ট কবে বেরবে তার ঠিক নেই। আমি তোমার যাত্রাদলের সঙ্গে যাব!’
কাকা বলল, ‘যাবি? তা বেশ! কিন্তু আমরা তো আজই সুন্দরবন চলে যাচ্ছি। বনশ্যামনগরে কাল থেকে বায়না আছে। তুই তা হলে কাল-পরশু চলে আয়। মোট মাসখানেকের বায়না আছে। পুরোটা থাকবি তো?’
কাকা আমার মুখের চিন্তার ছায়া উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বাসে কাকদ্বীপ চলে আসবি। তারপর ওখান থেকে দেখবি অচিন্ত্যনগরের নৌকা ছাড়ছে। রাত দশটার দিকে নৌকায় চড়ে বসবি। পরের দিন ভোরবেলা বনশ্যামনগরের ঘাটে তোকে নামিয়ে দিয়ে নৌকা চলে যাবে অচিন্ত্যনগরে!’
কাকাকে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘তা হলে পরশু যাচ্ছি কাকা!’
সেই বয়সে টের পেয়ে গিয়েছি, বাউণ্ডুলে জীবন এমন, সে কারও অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করে থাকে না। বাবা বাড়ি ছিলেন না। মাকে বললাম, ‘ঋষিকাকার যাত্রাদলের সঙ্গে সুন্দরবন যাচ্ছি। ফিরতে মাস খানেক পেরিয়ে যাবে!’
বিকেল যখন নিভু-নিভু, তখন চারদিক ঝাপসা হয়ে শুরু হল ঝড়বৃষ্টি। বাস থেকে যখন কাকদ্বীপে নামলাম, তখন অন্ধকার লুটেপুটি খাচ্ছে মাটিতে। নদীদেশের অন্ধকার এত বেশি খাঁ-খাঁ করে আগে জানতাম না! আকাশে তখন মিটমিট করছে গুটি কয়েক তারা আর চন্দ্রিমা আড়াল করা কয়েক টুকরো কালো মেঘ।
বনশ্যামনগরের ফেরিঘাট খুঁজে পেতে আরও আধঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেল। অন্ধকারে কাদা হাটকে শেষমেশ একটা ছই-দেওয়া নৌকা খুঁজে পেলাম বটে। ভিতরে টিমটিম করে একটা তেলের কুপি জ্বলছে। নৌকার হালের দিকে দুটো লোক বিড়ি টানতে-টানতে গুলতানি করছে। গলুইয়ের নীচে একটা লোক রাতের রান্না সারছে কড়াইতে তেলের উপর পাঁচফোড়নের ছোঁক দিয়ে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও মাঝিভাই, তোমার নৌকা বনশ্যামনগর যাবে?’
গুলতানি করা দু’জন লোকের একজন বলে উঠল, ‘যাবে গো! উঠে বসে যাও। প্যাসেঞ্জার হোক!’
কাঠের সিঁড়িটা নদীর পলিতে গেঁথে আছে। একজন গলুই থেকে লগি বাঁশটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমি টালমাটাল হতে-হতে উঠে পড়লাম নৌকায়। দাঁড়িয়ে আছি, নৌকা বাতাসে দুলছে। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে, দেখলাম, ছইয়ের নীচে বাচ্চা কোলে করে আধখানা ঘোমটা মাথায় দিয়ে একটা বউ বসে আছে।
বউটিই কথা বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? দেখছ না, দুলুনি হচ্ছে? পড়ে যাবে যে!’ বউটি ছইয়ের একধারে সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল। আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে বসে পড়লাম। স্বগতোক্তি করলাম, ‘নৌকা কখন ছাড়বে কে জানে!’
বউটি বলল, ‘তুমি কোথায় যাবে?’
আমি বললাম, ‘বনশ্যামনগর।’
বউটি বাচ্চাটার গায়ে শাড়ির আঁচলের খুঁটটা ভালো করে ঢেকে দিয়ে বলল, ‘ও তো আমার খোকারবাবার দেশের আগের দেশ গো! আমি তো অচিন্ত্যনগর যাব। তুমি তার আগের ঘাটে নেমে যাবে।’
মনে-মনে ভাবলাম, ভালোই হল। একজন অন্তত সওয়ারি পাওয়া গেল, যে বনশ্যামনগরের পরের ঘাটে নামবে। নৌকা ছাড়তে-ছাড়তে আরও ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে গেল। সওয়ারি আর হল না। আড়াইজন, আমি, বউটি আর তার ঘুমন্ত বাচ্চাটি।
নৌকা ছাড়ার পর-পরই আকাশে মুখ তুলল একটা রুপোর গোল চাঁদ। বেশ লাগছিল। এটিই আমার জীবনের প্রথম নৌকাযাত্রা! নদীর জলে ছপছপ করে দাঁড় পড়ছে। হেডমাঝি শক্ত হাতে হাল ধরে ঢেউকে সামাল দিচ্ছে। পেটে এবার খিদে জানান দিতে শুরু করেছে। মনে-মনে ভাবলাম, কিছু না খেয়ে নৌকায় ওঠা ঠিক হয়নি। এবার রাতে খাব কী?
নৌকায় যেতে-যেতে নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসা কত যে চিত্রকল্প কুড়োচ্ছিলাম, নোনা বাতাসে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে জোনাকির মতো কত যে উপমা ধরছিলাম, মন ভরে উঠছিল। আর বাউণ্ডুলে মানুষদের কোনও কারণে মন ভরে উঠলে খিদে পায় না। আমারও তাই।
মাঝিরা পালাক্রমে নৈশাহার সেরে ফেলল। আমি জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বউটি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি অমন করে কী দেখছ?’
ওর কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী?’
‘বিন্দু! ভালো নাম বিন্দুবাসিনী। তুমি বনশ্যামনগরে কোথায় যাবে?’
—ওখানে আমাদের যাত্রাদল গিয়েছে।
—তুমি কি যাত্রায় রাম সাজো? তোমার মুখটা ঠিক রামের মতো!
—না, না, আমি কিচ্ছু সাজি না। এমনি এমনি যাচ্ছি!
আমার উত্তরে বিন্দুর মন ভরল বলে মনে হল না। আমি মুখ ঘুরিয়ে নদীতে ঢেউয়ের দাপাদাপি দেখছি। একটু পরে বিন্দু তার ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে নৌকার পাটাতনের উপর শুইয়ে দিল। পাশের পোঁটলা থেকে মুড়ি আর নারকেল নাড়ু বের করে আঁচল পেতে ঢেলে দিয়ে বলল, ‘নাও, খাবে এসো!’
—না। তুমি খাও!
বিন্দু মুখভার করে বলল, ‘আমার খোকার বাবার মতো তোমারও তো দেখছি খুব ট্যামক! নাও, খাও!’
আমি না করতে পারলাম না। রাত যে কখন ভোরের দিকে পাড়ি দিয়েছে বুঝতে পারিনি। নৌকার ছইয়ের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ বিন্দুবাসিনী ডাকল, ‘কই, উঠে পড়ো! বনশ্যামনগরের ঘাট এসে গিয়েছে।’
আমি ধড়মড় করে উঠে মাঝিকে পারানির টাকা মিটিয়ে দিয়ে কাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেলাম। বিন্দু ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে উঠে এল আমার কাছে। একটা কাপড়ের পুঁটলি এগিয়ে ধরে বলল, ‘এটা নিয়ে যাও! রাস্তায় খেও। এতে তিলের নাড়ু আছে। আমার খোকার বাবা খুব ভালোবাসে!’
আমি বিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমাকে দিয়ে দিচ্ছ? তোমার খোকার বাবার কই?’
বিন্দুর গলা ভারী শোনাল, ‘আমি বাড়ি ফিরে খোকার বাবার জন্য কাল বানিয়ে দেব!’
অলঙ্করন: সোমনাথ পাল