বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
‘চলো হে লতার বাড়ি থেকেই খেয়ে আসি...’
বিশ্বজিৎ
আমি, অমল আর বুড়ো (তরুণকুমার) এক সময় খুবই বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে আড্ডা মারতাম, ঘুরতে যেতাম। সেই বন্ধুত্বের সূত্রেই অমলদের ভবানীপুরের বাড়িতে আমার নিত্য যাতায়াত ছিল। মেসোমশাই ও মাসিমা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এই অমলের মেজদা ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বন্ধুর দাদা, সেই সুবাদে আমিও ওঁকে মেজদা বলেই ডাকতাম। যদিও সেই সময় উনি বেশিরভাগ সময়টা বম্বেতেই থাকতেন। আমি তখন রংমহলে নাটক করি। এই ফাঁকে বলে নিই অমলের সুরেই আমি প্রথম গান রেকর্ড করেছিলাম— ‘তোমার ওই হরিণ চোখের পলক চাওয়াতে’ আর ‘কখন নদীর তীরে সন্ধ্যা নামবে ওগো’।
একবার বম্বে থেকে মেজদা মানে হেমন্তদা ফিরলেন। আমি ওঁদের বাড়ি গিয়েছি। মেসোমশাই বললেন, ‘বিশ্বজিৎ রংমহলে নাটক করে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ডিরেকশনে রেডিওতেও নাটক করেছে। ওর অভিনয়ের খুব শখ।’ এর মধ্যে আমি বাংলা ছবিতেও কাজ শুরু করেছি। বাংলা ছবির নায়ক হওয়া সত্ত্বেও স্টেজ ছাড়িনি। নাটক চালিয়ে যাচ্ছি। কেন এটা বললাম, পরে বলছি। ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে কাজ করার আগে একবার আমি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার চেষ্টা করেছিলাম। সেবার বম্বে পৌঁছনোর পর হেমন্তদাই গাড়িতে বসিয়ে আমাকে ওঁর বাড়ি ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে সোজা ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ফিল্মিস্তানের মালিক তুলারাম জালানের সঙ্গে। তখন ওঁদের প্রোডাকশন পার্টটা দেখতেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। এস মুখার্জি ভীষণ রাশভারী মানুষ, বিশাল ব্যক্তিত্ব। আমাকে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হিন্দি বলতে পারো?’ এখনও মনে আছে, সেদিন ওখানে ‘তুমসা নেহি দেখা’র শ্যুটিং চলছিল। শাম্মি কাপুর আর অমিতা শ্যুট করছিলেন। আমার সঙ্গে ওঁদের পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি তো কলকাতায় ফিরে এলাম। বাংলা ছবি আর নাটক চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে শুনলাম, এস মুখার্জি ফিল্মিস্তান ছেড়ে দিয়েছেন এবং ফিল্মালয়া থেকে তাঁর ছেলে জয়কে হিরো হিসেবে লঞ্চ করছেন। বুঝে গেলাম, বিশ্বজিতের বম্বের স্বপ্ন শেষ! খানিকটা মুষড়ে পড়লাম। সেদিন রংমহলে আমার নাটক ছিল। অভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হেমন্তদার বন্ধু। উনি এসে বললেন, ‘তোর সঙ্গে হেমন্ত দেখা করতে এসেছে। ব্যাক স্টেজে অপেক্ষা করছে।’ হেমন্তদা হঠাৎ এখানে দেখা করতে এলেন? বুঝতে পারছি না। যাই হোক, দেখা করতে গেলাম। বললেন, ‘দু’মাসের মধ্যে নতুন হিন্দি ছবি করছি, সব ফাইনাল। তোমাকে হিরো হতে হবে।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘এখানে সাহেব-বিবি-গোলাম রমরম করে চলছে। রংমহলের সঙ্গে আমার চুক্তি রয়েছে।’ উনি জোর দিয়ে বললেন, ‘বিশ্বজিৎ, স্টেজ তোমায় ছাড়তেই হবে।’ সত্যি বলতে তখনকার রংমহল কর্তৃপক্ষ আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। ওরা চুক্তি বাতিল করে আমাকে বম্বে যাওয়ার অনুমতি দিল। ওরা সাহায্য না করলে সত্যিই আমি বড় বিপদে পড়তাম।
বিশ সাল বাদের জন্য বম্বে গিয়ে ‘গীতাঞ্জলি’তেই উঠেছিলাম। মেজদা বলেছিলেন, ‘তুমি অমলের বন্ধু। আমাদের ঘরের ছেলে। আমার বাড়িতেই থাকবে।’ ওঁর সঙ্গেই স্টুডিওতে যেতাম, ছবির ডিরেক্টর বীরেন নাগের বাড়িতে যেতাম। এই ছবির শ্যুটিং হয়েছিল ফিল্মিস্তানেই। তখন ওঁকে খুব সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আর গাড়িতে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় জুলুম করে ওঁর থেকে প্রচুর গান শুনে নিতাম। খালি গলায় পাশে বসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান শোনাচ্ছেন, এ তো রীতিমতো স্বপ্নের মতো ব্যাপার।
যখন ‘বিশ সাল বাদ’ করি, তখন ওয়াহিদা রহমান প্রতিষ্ঠিত নায়িকা। আমি বাংলার নায়ক। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। হেমন্তদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওয়াহিদা আমার বিপরীতে কাজ করবেন?’ উনি আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘সব ম্যানেজ করে নিয়েছি। তুমি শুধু মেহনত করো।’ ওঁর বাড়িতে থাকার সুবাদে এই ছবির গানের কাজও স্বচক্ষে দেখেছিলাম। তাছাড়া মিউজিক আমাকে চিরকালই আকর্ষণ করে। প্রথমে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বম্বেতে এসে বাংলায় গানগুলো লিখলেন। হেমন্তদা সেগুলির সুর করলেন। যেমন গৌরীদা লিখলেন, ‘কত দিন গেল কত রাত, তুমি এলে না, এলে না, এলে না...’ পরে সেই সুরেই শাকিল বাদাউনি হিন্দিতে লিখলেন, ‘কঁহি দীপ জ্বলে কঁহি...’ আর এই গানটির জন্যই লতা মঙ্গেশকর এবং শাকিল বাদাউনি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর এই ছবিতে হেমন্তদার গাওয়া আমার লিপে ‘বেকারার করকে হামে ইয়ুঁ না যায়ি য়ে’ তো মনে হয় আজও সুপারহিট। যদিও বাংলাতে এর অনেক আগেই আমার জন্য বহু গান গেয়ে ফেলেছিলেন উনি। ‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা’র মতো গানগুলো আজও মানুষ মনে রেখেছেন।
সেই সময় হেমন্তকুমার বম্বের একটা স্তম্ভ। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কে না গীতাঞ্জলিতে আসতেন! আমার জীবনের অর্ধেক বলিউডের সঙ্গে পরিচয় গীতাঞ্জলিতে বসেই হয়েছে। ‘বিশ সাল বাদ’-এর সময় আর একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, আমার নাম বিশ্ব‘জিৎ’ শুনে দিল্লির সাংবাদিকরা ভেবেছিলেন আমি পাঞ্জাবি। হেমন্তদা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও পুরো বাঙালি। বাংলার হিরো। ও বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি।’ এই ছবির প্রিমিয়ার আজও মনে পড়ে...। কে আসেননি লোটাস হলের ওই প্রিমিয়ারে! দিলীপকুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলরা তো ছিলেনই, এমনকী মানিকদা মানে সত্যজিৎ রায়ও এসেছিলেন। শো-এর পর লতাজি আমাদের অভিনয়ের ভীষণ প্রশংসা করে ওঁর বাড়িতে খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। হেমন্তদা বললেন, ‘চলো হে লতার বাড়ি থেকেই খেয়ে আসি।’ ওঁকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন লতাজি।
হেমন্তদার মতোই আমার আর এক আপনজন ছিলেন বাঙালির মহানায়ক উত্তমকুমার। উত্তমদার লিপে হেমন্তদার গান আজও বাঙালি ভোলেনি। তাঁদের দু’জনের একটা অজানা গল্প বলি। ‘বিশ সাল বাদ’ ব্লকবাস্টার হওয়ার পর প্রযোজক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘শর্মিলি’ বলে একটা ছবির ঘোষণা করেছিলেন। এই ছবিরও পরিচালক ছিলেন বীরেন নাগ আর নায়িকা ওয়াহিদা রহমান। নায়ক হিসেবে নেওয়া হল উত্তমকুমারকে। চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। ধানবাদে শ্যুটিং হবে বলে বম্বে থেকে ইউনিট কলকাতায় চলেও এসেছিল। কিন্তু এখান থেকে কারা কী বোঝাল, উত্তমদা বেঁকে বসলেন, ‘আমি এই ছবি করব না। স্ক্রিপ্টটা জমছে না।’ এই ঘটনার পর সেই ছবিটাই আর হল না। হেমন্তদা খুব আঘাত পেয়েছিলেন। উনি ‘কোহরা’র কাজ শুরু করলেন। সেই সময়টা হেমন্তদা আর উত্তমদার মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। পরে যদিও দু’জনে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছিলেন। উত্তমদা আমাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। সেই সুযোগে আমি অনেক কথাই ওঁকে মুখের উপর বলার সাহস পেতাম। অনেকে সেটা পারত না। যখন ‘ছোটি সি মুলকাত’ ফ্লপ করল, আমি বলেছিলাম, ‘দাদা, তুমি রাজ কাপুরের সঙ্গমের অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলে। ঠিক আছে বুঝলাম। এমনকী, হেমন্তদার ছবিও না করে দিয়ে শেষে ছোটি সি মুলাকাত-এর মতো নায়িকাপ্রধান ছবি করলে!’ উত্তমদা স্বীকার করেছিলেন, ‘আমি সেদিন বুঝতে পারিনি, ভুল করেছিলাম বিশু।’ আসলে মেজদা বাংলা থেকে অনেককেই সুযোগ দিয়েছিলেন। যেমন— তাঁর প্রযোজনায় ‘ফারার’ ছবিতে কাজ করেছিলেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অনিল চট্টোপাধ্যায়। উনি সব সময় চাইতেন, বম্বের মাটিতে বাঙালি আলাদা জায়গা করে নিক।
আমার ছোটবেলায় কে এল সায়গল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচীন দেববর্মন, সুধীরলাল চক্রবর্তীদের গান শুনে বড় হয়েছি। একদিন হঠাৎ মা (স্মৃতিময়ী দেবী) আমাকে বললেন, ‘খোকা, তুই তো গান শুনতে খুব ভালোবাসিস। একজন নতুন সিঙ্গার এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ওঁর গান শুনে দেখিস।’ তখন সবে সবে হেমন্তদার ‘কথা কও নাকো শুধু শোনো’- এই গানগুলো বাজারে এসেছে। আমার মায়ের গান-বাজনার খুব শখ ছিল। ওঁদের একটা শখের দলও ছিল। ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’— এইসব নৃত্যনাট্যে সেই দল থেকে উনি অভিনয়ও করেছিলেন। আসলে হেমন্তদার নামটা প্রথম শুনেছিলাম কিন্তু মায়ের মুখেই। মা হেমন্তদার গানের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। আর সেই মানুষটাই তাঁর ছেলেকে হাতে ধরে বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে দিলেন, এটা দেখে যেতে পারলে মা খুবই খুশি হতেন। পরে হেমন্তদাকে একদিন এই গল্পটা শুনিয়েছিলাম।
মেজদা অকাতরে মানুষকে সাহায্য করেছেন। আত্মীয়-স্বজন তো বটেই, বাইরের অনেককেও। আমি অনেকটাই জানি। উনি যে কাউকে সাহায্য করছেন, সেটা অন্য কাউকে জানানোও পছন্দ করতেন না। এর পাশাপাশি বলব, ওঁর কথার দাম ছিল বিশাল। অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ একজন মানুষ। পরিবারের সকলের আবদার তিনিই মেটাতেন। একবার মনে আছে, কী একটা উপলক্ষে বাড়ির সকলে তাঁকে ধরলেন চাইনিজ খাওয়ানোর জন্য। ঘটনাচক্রে আমিও সেই সময় ওঁর বাড়িতে উপস্থিত। যখনকার কথা বলছি, তখন খার, বান্দ্রা— এ তল্লাটে চাইনিজের দোকান নেই। বম্বের ‘তাজমহল’ হোটেলের পাশে নানকিং বলে একটা চাইনিজ রেস্তরাঁ ছিল। বললেন, ‘তুমিও চলো বিশ্বজিৎ। আজ একসঙ্গে সকলে মিলে চাইনিজ খেয়ে আসি।’ উনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে সকলকে নিয়ে গেলেন। হইহই করে চাইনিজ খেয়ে আসা হল। এমনই আমুদে মানুষ ছিলেন তিনি। আর তাঁর গায়কসত্তা নিয়ে বলতে গেলে— হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সঙ্গীতশিল্পী। বাংলা আর হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতে তো চুটিয়ে কাজ করেছেন। ওঁর ‘নাগিন’-এর টিউন তো আজও সাপুড়েদের বিনে বাজে। নাগিনকে মিউজিক্যাল রেভেল্যুশন বললে এতটুকু অত্যুক্তি করা হয় না। সেইসঙ্গে তামিল, গুজরাতি, মারাঠি ভাষার ছবিতেও কাজ করেছেন। এমনকী ইংরেজি ছবি কনরাড রুকস পরিচালিত ‘সিদ্ধার্থ’-এও উনি ছিলেন মিউজিক ডিরেক্টর। ‘হেমন্ত’ একটা যুগের নাম।
আমি নিজের শো-এর সূত্রে দু’বার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। ওদের বলতে শুনেছি, ইন্ডিয়া থেকে প্রথম যে লেজেন্ডারি সিঙ্গার ওখানে পা রেখেছিলেন, তিনি হেমন্তকুমার। ওখানে তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। উনি ওদেশে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, প্লেন থেকে যখন উনি স্যুট পরে নামছেন, ওরা দাবি তুলেছিল, যে ট্র্যাডিশনাল পোশাকে আপনার ছবি দেখেছি, সেই পোশাক পরেই নামতে হবে। হেমন্তদা আবার প্লেনে ঢুকে পোশাক পরিবর্তন করে ধুতি আর শার্ট পরে নেমেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাওয়ার যাত্রাপথ রিলে করে শোনানো হয়েছিল।
আর এই মানুষটাই বাড়িতে থাকতেন অতি সাধারণ। গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে হলঘরে বসে সকলের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা দিতেন। ভীষণ আম খেতে ভালোবাসতেন। ওঁর আম খাওয়া ছিল রীতিমতো দেখার মতো বিষয়। আঁটি আর খোসার পাহাড় জমছে যেন। আর উনি ছিলেন চেন স্মোকার। কিন্তু কখনও মদ্যপান করতে আমি দেখিনি। থার্টি ফার্স্ট নাইটে গীতাঞ্জলিতে বড় পার্টিও দিতেন। আমি একবার বলেই ফেলেছিলাম, ‘মেজদা, আপনি গান করেন। অথচ, এত সিগারেট খান!’ উনি বলেছিলেন, ‘ওতে কিছু হয় না আমার।’ সত্যি, এটাই বুঝি ভগবান প্রদত্ত প্রতিভা।
হেমন্তদা কলকাতায় মারা গিয়েছিলেন। আমি তখন বম্বেতে। মেজদাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতায় যেতে পারিনি, এটা আমার আক্ষেপ। তবে, পরে ওখানে ওঁর স্ট্যাচুর উদ্বোধন হয় যখন, তখন উপস্থিত ছিলাম। শতবর্ষে হেমন্তদাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মেসোমশাই মানে ওঁর বাবার একটা কথা ধার করতেই হবে। একবার কথায় কথায় মেসোমশাই আমাকে বলেছিলেন, ‘হেমন্ত আমার ছেলে হতে পারে। কিন্তু ওর এত গুণ, আমারও ওর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’ সত্যিই মানুষ হেমন্ত এবং গায়ক হেমন্ত ছিলেন গুণের আধার। যতদিন মিউজিক থাকবে, ততদিন হেমন্তদার নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে আজ মেজদাকে আমার প্রণাম।
‘প্রথম দেখায় খুব রেগে গিয়েছিলাম’
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়
একটা মজার গল্প দিয়ে শুরু করি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে প্রথম একদম সামনা-সামনি দেখার অভিজ্ঞতা। প্রথম দিন কিন্তু আমি ওঁর উপর খুব রেগে গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম, পরবর্তীকালে আমি ওঁর এত বড় ফ্যান হয়ে যাব বা আমিই ওঁর পুত্রবধূ হব। যাই হোক, তখন আমার প্রথম ছবি ‘বালিকা বধূ’র রিহার্সাল চলছে নিউ থিয়েটার্সে। একদিন হঠাৎ ছবির পরিচালক তরুণ মজুমদারকে কে একটা খবর দিলেন, স্টুডিওতে হেমন্তবাবু এসেছেন। তনুকাকু তো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। উনি ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখুন হেমন্তবাবু, আমরা আমাদের বালিকা বধূকে খুঁজে পেয়েছি।’ আমি তো তার আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ফাংশনে বা পত্র-পত্রিকায় ছবিতে দেখেছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘এ! এ পারবে? এ তো বড্ড বাচ্চা!’ তখন আমার যে কী রাগ হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। বাড়িতে আমার মা, দিদিমা সবাই ওঁর গানের ফ্যান। আমি বাড়ি ফিরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে নিন্দে-মন্দ শুরু করলাম। আমার স্ক্রিন নেম মৌসুমী, কিন্তু আমার আসল নাম তো ইন্দিরা। উনি আমাকে ‘ইন্দু’ বলে ডাকতেন। ‘বালিকা বধূ’র কিছুটা শ্যুটিং হওয়ার পর সকলে মিলে একদিন দেখা হল, ছবি কেমন এগচ্ছে। ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে উনিও উপস্থিত ছিলেন। উনি বেরিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস রে!’ সেদিন থেকে আমিও ওঁর ‘ফ্যান’ হয়ে গেলাম।
২০২০-তে যেমন আমার শ্বশুরমশাইয়ের জন্মশতবর্ষ, তেমনই আমার বাবারও জন্মশতবর্ষ। এর মধ্যেই আমার ছোট মেয়ে মেঘাকে বলছিলাম, এই বছর তোমার দুই দাদুরই বার্থ সেন্টিনারি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একজন লেজেন্ড। স্বল্পপরিসরে ওঁকে বর্ণনা করা কঠিন। উনি গায়ক হিসেবেও
যেমন বড় ছিলেন, মানুষও ছিলেন ততটাই বড়। পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখেছি, গান নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন, সংসারের সব খুঁটিনাটি ওঁর দেখা সম্ভব হতো না। আবার এটাও শুনেছি, উনি খুব ভালো রান্না করতে পারতেন। ব্যাচেলার লাইফে আমার দিদি শাশুড়িকে নাকি সংসারের কাজে প্রচুর সাহায্য করতেন।
সম্প্রতি আমার বড় মেয়ে পায়েল আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে, অনেকেই জানেন। উনি বড় নাতনিকে খুব ভালোবাসতেন। একটা সময় ভাবি, আজ উনি নেই ভালোই হয়েছে, না হলে পায়েলের চলে যাওয়ার যন্ত্রণাটা হয়তো সহ্য করতে পারতেন না। যাই হোক, জন্মশতবর্ষের লেখায় মন ভারাক্রান্ত করব না।
বাবুর সঙ্গে বিয়ের পর আমি তো মুম্বই চলে আসি। এখানে আসার পর আমার শ্বশুরমশাই আমাকে উর্দু শেখাবেন বলে টিচারও রেখে দিয়েছিলেন। গীতিকার এইচ এস বিহারী আমাকে উর্দু শেখাতেন। ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে বলতে পারি, বম্বেতে তখন আমার আপনজন বলতে তেমন কেউই ছিলেন না। সেই দিনগুলিতে শ্বশুরমশাই-ই আমার কাছে মাও ছিলেন, বাবাও ছিলেন। কারণ, উনি নিজের হাতে আমাকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। তাই সেই সময় যখনই আমার সঙ্গে বাবুর ঝগড়া হতো, উনি ছেলের পক্ষে নয় বউমার হয়ে কথা বলতেন। এটাও কিন্তু বেশ মজার। এখন সেসব দিনের কথা মনে পড়লে হাসি পায়।
ভাই-বোন, তাঁদের ছেলে-মেয়ে এবং শ্যালক ও শ্যালিকাদের জন্য তিনি অনেক করেছেন। শুধু পরিবারের সদস্য বলে নয়, বাইরের মানুষকেও বহু সাহায্য করেছেন। একটা ঘটনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তখনও আমার বিয়ে হয়নি। ঘটনাটা কলকাতার। হঠাৎ বললেন, ‘একটা জায়গায় যাবি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়? কী করতে যাবে?’ উনি বললেন, ‘কিছু নয়, ওই একটা এনভেলপ দিতে যাব।’ আমি তো শুনে হাঁ, ‘একটা খাম দিতে যাবে!’ উনি বললেন, ‘চল না।’ সেদিন গিয়েছিলাম পরিচালক বীরেন নাগের বিধবা স্ত্রীয়ের কাছে। উনি আমার শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করলেন। দেখলাম, ওঁর হাতে উনি একটা খাম দিলেন। এমনই মানুষ ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। অথচ, এই মানুষটার জন্য কলকাতায় একটা সংগ্রহশালা তৈরির বহু চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তেমন সাহায্যই পাইনি। এটা আমার কাছে সত্যিই বেদনার।
মজার গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। আর একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করি। পুত্রবধূ হিসেবে উনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, আমি ওঁকে যে অবস্থাতেই গান শোনাতে বলব, উনি শোনাবেন। খাওয়ার মাঝেও যদি গাইতে বলি গাইবেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উনি এই প্রতিশ্রুতিটা রেখেওছিলেন। তখন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শ্যুট চলছে, আমি গল্পচ্ছলে ব্যাপারটা রঞ্জিতবাবুকে (মল্লিক) বলি। উনি তো বিশ্বাস করতেই চাইছেন না। পরের দিন তাড়াতাড়ি প্যাকআপের পর রঞ্জিতবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি গেলাম। আমার শ্বশুরমশাই তখন বাথরুমে দাড়ি কাটছেন। গিয়েই বললাম, ‘তুমি অমুক গানটা শোনাও।’ উনিও শুরু করলেন আর আমিও হেসে ফেলেছি। উনি বললেন, ‘তুই হাসলি কেন, আমি কি ভুল গাইছি।’ তখন বললাম, একজন ব্যাপারটা বিশ্বাস করেননি, স্বচক্ষে দেখতে এসেছেন। সেদিন খুব মজা হয়েছিল।