বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
২০১১ সালে স্পেস শাটল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রথেকে বিজ্ঞানীদের আনা এবং এখান থেকে তাঁদের মহাকাশে পাঠানোর জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া আমেরিকার কাছে কোনও বিকল্প ছিল না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়াও আমেরিকার থেকে বিপুল টাকা নেয় এই অভিযানগুলোতে। তবে স্পেস এক্সের সাফল্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নয়া হাতিয়ার এনে দিল। কারণ, আর অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না নাসাকে। অনেক কম খরচেই নিজেদের মহাকাশচারীদের যাতায়াত করাতে পারবে তারা।
নাসার আর্থিক টানাপোড়েনের মাঝেই বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা মহাকাশ নিয়ে নিজেদের আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিল। তার মধ্যেই স্পেস এক্সের উত্থান বেশ নজরকাড়া। আরও একাধিক কোম্পানি সেই দৌড়ে শামিল হওয়ার লড়াই চালাচ্ছে। তবে আমেরিকায় মহাকাশ গবেষণা বা ব্যবসায় বেসরকারি সংস্থার অন্তর্ভুক্তি এই প্রথম নয়। ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক উৎক্ষেপণের পরপরই, বেসরকারি সংস্থার অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গকে সামনে রেখে মহাকাশ যাত্রার একটি আন্তর্জাতিক আইন ঠিক করার দাবি উঠতে শুরু করে। আলোচনার টেবিলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই দাবি তুলতে থাকে, মহাকাশে কাজ করার এক্তিয়ার একমাত্র দেশের সরকারি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রেরই থাকবে। উল্টোদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার বোঝাতে থাকে বেসরকারি সংস্থারও এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত দুই যুযুধান পক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, বেসরকারি সংস্থাও মহাকাশ যাত্রায় আসতে পারবে, তবে তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব সেই সংস্থার দেশকেই বহন করতে হবে। এছাড়াও, মহাকাশে কোনও দেশের কৃত্রিম উপগ্রহ বেসরকারি সংস্থা প্রেরিত কৃত্রিম উপগ্রহের কারণে নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে গেলে, সংস্থাটি যে দেশের সেই দেশকে দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। ১৯৫৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই আলোচনা শেষ পর্যন্ত রূপ পায় ১৯৬৭ সালে। তৈরি হয়, আউটার স্পেস ট্রিটি বা বহির্বিশ্ব চুক্তি। অনেকেই একে মহাকাশ যাত্রার সংবিধান বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। যদিও পরবর্তী সময়ে এই চুক্তিতে বহু রদবদল করার কথা চলছে।
এরপর থেকে ধীর গতিতে হলেও মহাকাশ গবেষণা এবং যাত্রায় বেসরকারি সংস্থার অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল। ২০০০ সালের পর তা গতি পায়। এই মুহূর্তে যে সংখ্যক বেসরকারি সংস্থা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তা প্রথমে ভাবেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রেই আপত্তি উঠেছে। ঠিক যেমনটা জানিয়েছিলেন চাঁদে পদার্পণকারী প্রথম মানুষ নিল আর্মস্ট্রং। ২০১০ সালে মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতার সময় বলেছিলেন, ‘মহাকাশ বাণিজ্যে লাভের মুখ দেখে অনেক বেসরকারি সংস্থা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা একেবারেই কাম্য নয়। মহাকাশ যাত্রা এবং গবেষণায় নাসারইএকমাত্র থাকা উচিত।’ তবে এখন বোধহয় অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মহাকাশ যাত্রায় বেসরকারি সংস্থার প্রবেশ এখন আর কোনওভাবেই রোখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে স্পেস এক্সের সাফল্য এবং আর্থিক সমৃদ্ধি আরও অনেক সংস্থাকে এই ব্যবসায় টেনে আনবে। তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে গোটা বিশ্বে মহাকাশ অর্থনীতির মূল্য ছিল ৩৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে মাত্র এক চতুর্থাংশ সরকারি অবদান, বাকি পুরোটাই বেসরকারি।
বর্তমানে মহাকাশ বাণিজ্যে সবথেকে এগিয়ে রয়েছে স্পেস এক্স। ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল এই সংস্থা। প্রচারের আলোয় আসে শুধুমাত্র একটা বিজ্ঞাপনেই। স্পেস শাটল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০১২ সালে স্পেস এক্স বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, তারা ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে মহাকাশে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে সক্ষম। সেই সময় বাণিজ্যিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণে অগ্রণী সংস্থা ছিল এরিয়ান স্পেস। তারা ১৩৭ মিলিয়ন ডলার নিত মহাকাশে পাঠাতে। তার থেকে অনেক কম খরচে মহাকাশ যাওয়ার লোভনীয় অফার দিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয় স্পেস এক্স। ‘এত কম খরচে স্পেস এক্সের রকেট মহাকাশে আদৌ মহাকাশে পৌঁছবে তো?’ এই প্রশ্ন উঠলেও, কয়েকজন স্পেস এক্সের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দেয়। তাদের যাত্রাও শুরু হয়ে যায়। একের পর এক সাফল্য স্পেস এক্সের লোভনীয় বিজ্ঞাপনকে শক্তিশালী করে তোলে। সকলে জানতে পারে, স্পেস এক্স পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তিতে রকেট তৈরি করছে। তাই তারা এত কম খরচে উৎক্ষেপণ করতে পারছে। এরপর থেকে এরিয়ান স্পেস সহ বিভিন্ন দেশীয় উৎক্ষেপণ সংস্থাগুলি (রাশিয়া সহ) উৎক্ষেপণের খরচ কমাতে থাকে। তবে স্পেস এক্সের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি কেউ। মহাকাশ যাত্রার বাণিজ্যকরণে স্পেস এক্সকে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইংল্যান্ডের ওয়ান ওয়েব।তবে কয়েকবছরের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে একাধিক সংস্থা ওয়ান ওয়েবকে কিনে নিয়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তবে তা আদৌ কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলবে।
স্পেস এক্স আর একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, নাম ‘স্টারলিঙ্ক’। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আগামী কয়েকবছরে আরও বড় বিপ্লব ঘটাতে ৪০ হাজারের বেশি কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাকাশে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৪০০ কৃত্রিম উপগ্রহ ইতিমধ্যে পাঠানো হয়ে গিয়েছে। যদিও এই পরিমাণ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠালে সেখানকার অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই এখন আলোচনা তুঙ্গে।
মহাকাশ যাত্রার দৌড়ে যেহেতু প্রথম থেকেই বেসরকারি সংস্থাগুলির পাশে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাই সংস্থাগুলিও সর্বদা হাত তুলে আমেরিকাকে সমর্থন দিচ্ছে। সেই সমর্থনের জোরেই এবার আমেরিকার নজরে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ, গ্রহাণুতে থাকা খনিজ সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার। তা খনন করে পৃথিবীতে আনার প্রযুক্তি পৃথিবীর কোনও দেশের কাছে এখনও নেই। কিন্তু চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতেক্যেই। তাই ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশে একটা আইন পাশ করে এরকম একাধিক সংস্থাকে এই কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে আমেরিকায় এই সংক্রান্ত আরও একটা আইন পাশ হয়। তাতে বলা হয়েছে, বহির্বিশ্ব থেকে খনিজ বস্তু আনা সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ। এর পরপরই ইউরোপের ছোট্ট দেশ লুক্সেমবার্গ, ধনকুবের আরব আমিরশাহী সহ একাধিক দেশ এবিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মুন এক্সপ্রেস, আইএস স্পেস, প্ল্যানেটারি রিসোর্স নামক একাধিক কোম্পানি যোগ দিয়েছে এই পরিকল্পনায়। এখানে বলে রাখা ভালো, এই কার্যকলাপ ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ অনুযায়ী কতটা সঠিক, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ফলে একাধিক দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে।
মহাকাশ দৌড়ে বেসরকারি সংস্থাগুলির আরও একটা বিষয় নজরে এসেছে। তা হল কিউবস্যাট প্রকল্প। একটা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠাতে বিভিন্ন কোম্পানি বা দেশকে দু’-তিন বছরেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়। রীতিমতো লাইন দিয়ে অপেক্ষা করা যাকে বলে। কারণ কৃত্রিম উপগ্রহ বানাতে কয়েকবছর সময় লেগে যায়। ‘প্ল্যানেট’ নামক একটি সংস্থা এই সমস্যার সমাধান করতে চাইছে। তাদের পরিকল্পনা, তারা একটা বড় কৃত্রিম উপগ্রহের ছোট সংস্করণ বানাবে। যা খুব কম সময়ে তৈরি সম্ভব। আর তা অনায়াসে অন্য কোনও দেশের বড় উপগ্রহের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে বিশ্বের ছোট ছোট কোম্পানিগুলোও নিজেদের কাজের মতো করে কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করে মহাকাশে পাঠাতে পারবে।
এছাড়া মহাকাশ ভ্রমণেরও একটা দিগন্ত খুলতে চলেছে আগামীদিনে। যেমন অনেকে দার্জিলিং, সিমলাঘুরতে যাচ্ছেন। আর্থিকভাবে আরও সবলরা বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছেন। তার বদলে, তাঁরাই এবার মহাকাশে ঘুরতে যাবেন। তবে তা হবে মহাকাশের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে সাধারণ মহাকাশ মিশনের সঙ্গে এর সংঘাত হওয়ার কোনও রাস্তা নেই এবং তুলনামূলকভাবে সস্তাও বটে। কিন্তু সস্তা মানে কতটা, সেটা এখনই চর্চা করার সময় আসেনি। তবে ব্লু অরিজিন, ভার্জিন গ্যালাকটিকের মতো একাধিক বেসরকারি সংস্থা এই মহাকাশ ভ্রমণ প্রকল্পকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তাই আগামীদিনে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে বলাই যায়। তাই অদূর ভবিষ্যতে না হলেও, একটা সময়ের পর এই কম খরচে মহাকাশ ভ্রমণের বিভিন্ন ‘অফার’ নিয়ে ঘুরবে সংস্থাগুলি।
এবার প্রশ্ন উঠছে, মহাকাশ নিয়ে যখন এত কিছু হচ্ছে তাহলে মঙ্গলগ্রহ বা চাঁদে ঘর-বাড়ি বানানোর কাজ এখনও কেন সফল হচ্ছে না? এর পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত কোনও দেশ বা কোম্পানির কাছে এই মুহূর্তে ভিন গ্রহে বসতি গড়ে তোলার প্রযুক্তি নেই। দ্বিতীয়ত, আউটার স্পেস ট্রিটি। ওই ট্রিটি অনুযায়ী, একটা দেশ বা কোম্পানি অথবা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ভিন গ্রহে আধিপত্য খাটাতে পারবে না। তবে ‘মার্স-ওয়ান’-এর মতো ডাচ কোম্পানি এই কাজ করবে বলে অনেকদিন আগে বিজ্ঞাপন করেছিল। এমনকী এর আগেও বহু কোম্পানি চাঁদের জমি বিক্রি বা বাড়ি তৈরির ‘অফার’ও দিয়েছিল। তা কতটা আইনসম্মত, তা নিয়ে চর্চা চলতেই পারে। কিন্তু জানিয়ে রাখা ভালো, এগুলি একটাও আইনসম্মত নয়।
ভারতেও মহাকাশ নিয়ে বেসরকারি সংস্থার কার্যকলাপ শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্পেস এক্সে করে ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ বেসরকারি কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সসিড স্যাট-১ পাঠায় স্যাটেলাইজ (তখন নাম ছিল এক্সসিড স্পেস) নামক একটি কোম্পানি। এরপরে ওই কোম্পানি আরও উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। ভারতও ইদানিংকালে বেসরকারি সংস্থাকে উৎসাহ দিচ্ছে। এদের কার্যকারিতাকে আরও উৎসাহিত করতেই ২০১৭ সালে তৈরি হওয়া ‘স্পেস অ্যাক্টিভিটিস বিল’-এর খসড়া ইতিমধ্যে ভারতের সংসদে পেশ হয়েছে। তবে তা এখনও পাশ হয়নি। তবে যেভাবে বিভিন্ন দেশের বেসরকারি কোম্পানি এই দৌড়ে নেমে পড়েছে, তাতে ভারতও যে খুব বেশিদিন হাত গুটিয়ে থাকবে না, তা বলাই যায়।
তবে সর্বশেষে আরও একবার বলতে চাই কলম্বিয়া মহাকাশযানের পরিণতির পুনরাবৃত্তি আমরা কেউ চাই না। তাই বেসরকারি সংস্থার মহাকাশ যাত্রা নতুন দিগন্ত যেমন খুলে দেবে, সেই সঙ্গেবিপদের সংকেত ভুললেও চলবে না। তাই প্রত্যেকটি দেশের সরকারকে এবিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তবেই সফল হবে মহাকাশে পৌঁছনোর জন্য আমআদমির স্বপ্ন।