বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
ফোন বাজটে সাপোর্ট ডেস্কে। এরকম সময় ল্যান্ডে ফোন করবে কে? এটা তো লিজলাইনের স্পেশাল ফোন। যাতে কেউ ট্যাপ করতে না পারে। ফোন স্বয়ং রাষ্ট্রদূতের। চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিশ্রি ফোনে বললেন, কুইক, উহান আর হুবেইতে আমাদের কত সিটিজেন আছে ইমিডিয়েট ফাইল করুন। উই মাস্ট হ্যাভ রেকর্ডস। মে বি উইল হ্যাভ টু ইভ্যাকুয়েট দেম। কুইক! তৎক্ষণাৎ দু’জন দূতাবাস কর্মী কম্পিউটারে সার্চ শুরু করলেন। আর বাকিরা তখন ভিসা, ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট ডকুমেন্ট চেক করছেন। যারা ভারত থেকে বিভিন্ন কাজে আসে, অনেকে এমব্যাসিকে জানায়, অনেকে জানায় না। আসে, কাজ করে, পড়াশোনা করে, চলে যায়। তবে নথি থাকে এমব্যাসিতে। উহানে প্রধানত ছাত্ররাই আসে। এই তৎপরতার ঠিক দু’দিন পর উহান সম্পূর্ণ লকডাউন হয়ে গেল। কেউ আর বাইরে আসতে পারছে না। এখন উপায়? এ পর্যন্ত ৬৮০ জন ইন্ডিয়ানের নাম আর ডিটেইলস পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যায়নি তো ইতিমধ্যে? তবে চায়না নিউ ইয়ারের হলিডেতে অনেকে দেশে ফিরে গিয়েছে। তাহলে কতজন রয়ে গেল? খবর আসছে, শয়ে শয়ে মৃত্যু হচ্ছে উহান শহরে। গোটা শহর এক মৃত্যুপুরী। অসংখ্য ফোন কল আসছে উহান থেকে। হুবেইয়ের অন্য শহর থেকেও। ভারতীয়দের। স্যার... আমরা আটকে পড়েছি। আমাদের বাঁচান। আমরা দেশে ফিরতে চাই স্যার। আমাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। হাহাকারগুলো বাড়ছে।
৬৮০ জনের লিস্ট ধরে ধরে এবার প্রথম কাজ হল, চীন সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলা। তারপর উহান ফরেন ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু কেউ রাজি নয়... বাইরে থেকে কাউকে যেতে দিতে। ২৫ জুন। গোটা উহান কন্টেইনমেন্ট জোন। কেউ যেন বাইরে না যায়। মোতায়েন করা হয়েছে প্রতিটি এন্ট্রি এক্সিট পয়েন্টে সিটি পুলিস। আইন ভাঙলেই গ্রেপ্তার। চীনে গ্রেপ্তার মানে কবে মুক্তি কেউ জানে না। শুধু ফরেন অফিস থেকে পারমিশন পেলে হবে না। ছাত্ররা যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, সেইসব ক্যাম্পাসে বাস ঢোকার অনুমতিও কেউ দিচ্ছে না। রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিশ্রি দু’জন এমন অফিসারকে দায়িত্ব দিলেন, যাঁরা চীন সরকার, প্রশাসন আর লোকাল অথরিটির প্রতিটি খুঁটিনাটি জানে। তাদের কাজই সেটা। দীপক পদ্মকুমার এবং এম বালাকৃষ্ণণ। ফোন আসছে নিউ দিল্লি থেকে। স্টেটাস কী? বিক্রম মিশ্রি বললেন, হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি...। নিউ দিল্লির জনপথ রোড থেকে চায়না ডেস্কের জয়েন্ট সেক্রেটারি বললেন, শ্যুড উই প্রসিড টু এয়ার ইন্ডিয়া? বিক্রম মিশ্রি বললেন, ২৪ ঘণ্টা পর জানাচ্ছি।
বাস ভাড়া করা হয়েছে বেজিং থেকে। কিন্তু ড্রাইভারদের রেজিস্টার করাতে হবে। কারণ তাঁদের এমন কিছু সিটিতে যেতে হবে, যেখানে ঢোকা যাচ্ছে না। এখন তো মাল্টিপল সিটিতে ড্রাইভিংয়ের অনুমতিই নেই। ১২টি বাস। প্রতেকের চোখেমুখে শক্ত প্রতিজ্ঞার ছাপ। কাজটা করতেই হবে। কিন্তু ভয় করছে না? অবশ্যই করছে। কারণ উহান, হুবেইতে এখন ঢোকা মানে তো নিজেরই মূত্যু পরোয়ানায় সই করা। হুবেই কি ছোট জায়গা নাকি? একটি শহর থেকে অন্য শহরে যেতে ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটারও লাগবে। দেখা যাক নিউ দিল্লি কী বলে? সকলকে তুলে নিয়ে আসতে হবে উহান এয়ারপোর্টে। উহানে একটা কনস্যুলেট আছে। সেখানেই প্রথমে থাকবে তারা। প্রথমটা সফল হলে সেকেন্ড অপারেশন। কিন্তু আগে তো আটকে থাকা ভারতীয়দের কাছে পৌঁছনো দরকার! পারবে কি ১২টি বাস? সকলের অলক্ষ্যে প্রত্যেক বাসে একজন করে চীনের প্রশাসনিক অফিসার নজর রাখতে শুরু করেছেন। কেন? নামেই প্রশাসনিক অফিসার। আসলে তারা এমএসএস এজেন্ট। মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি। চীনের ইনটেলিজেন্স এজেন্সি। তারা তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে চায়, কাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চীন থেকে। আর তার থেকেও বড় কথা, উহানের অন্যত্র যেন এই বাস চক্কর না মারে। বিশেষ করে ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের ধারেকাছে!
প্রথম দুঃসংবাদ এল এনশি সিটি থেকে। বাস আটকে দিয়েছে লোকাল বাসিন্দারা। ঢুকতে দেওয়া হবে না। ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে। বাইরের কাউকে অ্যালাউ করা হবে না। বাস ঘিরে বিক্ষোভ চলছে। বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে মেরে বলা হচ্ছে ফিরে যাও... নয়তো পুলিস ডাকা হবে। চারজন ড্রাইভার ঠকঠক করে কাঁপছেন ভিতরে। দূতাবাসে চীনের কিছু কর্মী আছে। তাঁদের বলা হল, সাহায্য করো। লোকাল মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝাও। তিনজন কর্মী মোবাইলে কথা বলতে শুরু করলেন। স্পিকার অন করে। প্রায় এক ঘণ্টা বোঝানোর পর অবশেষে বলা হল, মাত্র ৩০ মিনিট আমরা টাইম দেব। তার মধ্যে তোমাদের সকলকে নিয়ে চলে যেতে হবে। তাই হবে। এভাবেই একঝাঁক লোকালিটিতে যাওয়া হচ্ছে ঝড়ের বেগে। হস্টেলে, অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করে বলা হচ্ছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা রিচ করব। তোমরা চলে এসো গেটে। সবাইকে আনা হয়েছে? লিস্ট চেক করে হঠাৎ জানা গেল, একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কে সে? কেরলের একটি ছেলে। কোথায় গেল?
* * *
মুম্বই, ২৯ জানুয়ারি, দুপুর ১টা
এয়ার ইন্ডিয়া সিকিউরিটি উইংয়ের ডেপুটি ম্যানেজার দেবদাস পিল্লাইয়ের ডিউটি শেষ। তাই বাড়ি ফিরে এসেছেন। দীর্ঘদিন একটানা এয়ারপোর্টেও কাটাতে হয়। আমেদাবাদ, দিল্লি, হায়দরাবাদ ঘুরে গতকাল একটু সময় পাওয়া গিয়েছে। আজ দুপুরে টানা বিশ্রাম করে বাইরে ডিনারে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সেরকমই কথা হয়েছে মিনির সঙ্গে। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার আধঘণ্টার মধ্যে বাজল ফোনটা। রিজিওনাল হেড অফিস থেকে ফোন। ওপ্রান্ত থেকে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে পিল্লাইয়ের মুখের অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছিল। স্ত্রী মিনি পিল্লাই ছিলেন সামনে। তিনি ভাবছেন, কী এমন হল? ফোন রেখে একটা শ্বাস ফেলে দেবদাস পিল্লাই থেমে থেমে বললেন, আমাদের একবাব উহান যেতে হবে। হোয়াট! মিনি পিল্লাই বিস্ময়ে যেন কথা বলতে পারবেন না। দেবদাস হেসে বললেন, যোগেশের ফোন। অমিতাভ স্যার মিশনটা অপারেট করবেন। আমাদের ৩৪ জনের টিম। চিন্তা কোরো না। মিনি শুধু বললেন, বাট উহানে কী একটা যেন ভাইরাস অ্যাটাক হয়েছে না? আর কোনও জায়গা পেল না পাঠানোর? উহান! দেবদাস হাসলেন। কাউকে না কাউকে যেতেই হবে মিনি। হোয়াই নট মি? তুমি তো জানো আমাদের, একটা টিমওয়ার্ক কাজ করে এসব উদ্ধারে। দেবদাস পিল্লাই রেডি হয়ে নিলেন।
ঠিক তখন দিল্লিতে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে একটা ফোন এসেছে নার্সিং অফিসার অ্যাজো জোসের কাছে। ৩৩ বছরের অ্যাজো শুনলেন, হ্যালো, মিস্টার জোস! মিনিস্ট্রি অব হেলথ থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারি স্যার একটু কথা বলবেন। লাইনে থাকুন। জোস ভাবছেন, এরকম তো কখনও হয় না। সুপারের সঙ্গেই তো যোগাযোগ করে সবাই। আমার সঙ্গে কেন? জয়েন্ট সেক্রেটারি বললেন, আপনি নেপাল ভূমিকম্প, কেরল ফ্লাডে কাজ করেছেন। আমরা চাই এবার একটা বিগ অপারেশনে আপনি থাকুন। আমরা উহান যাচ্ছি! আপনি আপনার একজন কলিগকে বেছে নিন। গেট রেডি! ৩৩ বছরের অ্যাজো জোস এক নিমেষে ভাবলেন, সারাথ প্রেমের কথা। প্রেমের সঙ্গেই তাঁর ওরিয়েন্টেশন ভালো। দু’জনে মিলে একটানা আট ঘণ্টা রিসার্চ করে একটা লিস্ট তৈরি করে ফেললেন। কী কী লাগবে। ওই লিস্ট পাঠাতে হবে হেলথ মিনিস্ট্রিতে। পিপিই কিটস, এন ৯৫ মাস্ক, ট্রিপল লেয়ারড মাস্ক, ডিসপোজেবল গ্লাভস, স্যানিটাইজার, ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, স্টেথোস্কোপস, ওষুধ, হাইপোক্লোরাইট সলিউশন, বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট বক্স, সেগুলো বাঁধার জন্য ট্যাগ। অকস্মাৎ জোসের মনে পড়ল, এই রোগে নাকি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অনেকের। চীন থেকে পাওয়া খবর, আর ইতালির কিছু কেসে দেখা যাচ্ছে। তাহলে কিছু অক্সিমিটার নেওয়া দরকার। ভারত তখনও এসবের সঙ্গে বেশি পরিচিত নয়। এসব পাওয়া যাবে কোথায়? হেলথ মিনিস্ট্রি চিন্তায় পড়ল। বহু কষ্টে জোগাড় হল।
* * *
৩০ জানুয়ারি, সকাল ১০টা, সাউথ ব্লক, নিউ দিল্লি
ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং এয়ার ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর অফ অপারেশন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন না। তাঁর সামনে ৩৪ জনের টিম। রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালের দু’জন মেডিক্যাল অফিসার বললেন, প্রোটেকটিভ স্যুট, ফেস মাস্ক এবং আই গ্লাস... এই তিনটে ইউজ করার প্রটোকলই কিন্তু সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট। প্রোটেকটিভ স্যুট একটানা ৬ ঘণ্টার বেশি পরে থাকলে খেয়াল রাখবেন যে ঘাম হয়েছে, সেটা কন্টামিনেশন ছড়াতে পারে। তাই টাইম ফ্রেম আমাদের মনে রাখতে হবে। ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং মুখ খুললেন এবার। বললেন, জেন্টলমেন, উই হ্যাভ এইট্রিন আওয়ারস। ১৮ ঘণ্টা। তার মধ্যে আমাদের অপারেশন কমপ্লিট করে ফিরতে হবে। তাই কোনও সময় নষ্ট করা চলবে না। মিনিট বাই মিনিট আমাদের কোঅর্ডিনেট করতে হচ্ছে এমব্যাসির সঙ্গে। এত প্যাসেঞ্জারকে একসঙ্গে উহান এয়ারপোর্ট রাখতে রাজি হচ্ছে না। কেবিন ক্রুদের বলছি, যাদের আমরা ফেরত নিয়ে আসব, সেই প্যাসেঞ্জাররা বসবে ইকনমিতে। প্রথম চারটে সিটিং রো ফাঁকা থাকবে। ডক্টরস, হেলথ স্টাফস আর ইঞ্জিনিয়ারসরা থাকবে ফার্স্ট ক্লাসে। আর বাকি ক্রু থাকবে আপার ডেকে। আমরা যাচ্ছি সেভেন ফোর সেভেনে। জাম্বো। উঠেই প্রথমে ইকনমি ক্লাসের সিটে ফুড প্যাক আর ওয়াটার বটল রেখে দেবেন। তারপর আর কোনও ক্রু ওই সিটের ধারেকাছে যাবে না। যদি না তারা অ্যালার্ট বেল দেয়। যাওয়ার পথে আপনারা ঘুমিয়ে নেবেন। কারণ আমরা জানি না উহানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। আদৌ আমরা ইভ্যাকুয়েশনের কাজ শুরু করতে পারব কি না।
ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং বললেন, আমরা এর আগে উহানে যাইনি। তাই আমাদের এই এয়ারক্র্যাফট সম্পর্কে কোনও আইডিয়াই নেই চীনের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের। আমরা চাই না তারা আমাদের এয়ারক্র্যাফটে হাত দিক। তাই আমাদের সঙ্গে রাখা হচ্ছে নিজেদের মেনটেন্যান্স, টেকনিশিয়ানস আর ইঞ্জিনিয়ারস। আমরা যারা এয়ারপোর্টে নামব, কেউ একটাও কথা বলব না। একটাও না। নট আ সিঙ্গল ওয়ার্ড। এটাই আমাদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর হবে। এনি কোয়েশ্চেন?
ইয়েস ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন তাকালেন। বললেন, হ্যাঁ বলুন। আমাদের ইনফেকশনের চান্স কতটা... একজন কেবিন ক্রু জানতে চাইছেন। নার্সিং অফিসার অ্যাজো জোস বললেন, আননোন! আমরা জানি না। বাট, আপনাদের যে প্রোটোকল আর প্রোটেকশন দেওয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট সিকিওরড। স্টিল উই হ্যাভ রিস্কস। সেই ঝুঁকি নিতেই হবে। ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং এবার একটু জোরেই জানতে চাইলেন, ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!
ইয়েস ক্যাপ্টেন! ৩৪ জন চিৎকার করলেন।
* * *
৩১ জানুয়ারি, ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, দুপুর ১টা
এখন একটু স্বস্তি। সকাল পর্যন্ত ছিল প্রচন্ড টেনশন। কারণ, শেষ মুহূর্তে চীনা দূতাবাস ভিসা ইস্যু করছে। আজ ফ্লাইট টেক অফ করবে। অথচ ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং নিজেই গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ভিসা পাননি। রাত সাড়ে ১১টায় ফোন কল। আর ইমেল। ভিসা ইজ রেডি। কিন্তু সকলের নয়। মানে? আর কখন দেবে? চীনের ফরেন অফিস জানাল, দেখছি। দেখছি? এখন? অমিতাভ সিং ছটফট করছেন। পরদিন সকাল ৭টায় এল বাকিদের ভিসা। এবার নিশ্চিন্ত। দেবদাস পিল্লাই গোটা ফ্লাইটের সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট নিশ্চিত করে সবুজ সঙ্কেত দিলেন। টেক অফ করল এয়ার ইন্ডিয়া বোয়িং ৭৪৭। প্রথমেই ক্যাপ্টেন অমিতাভ যেটা করলেন সেটা হল, এয়ারক্র্যাফটের মধ্যে এয়ার সার্কুলেশন সিস্টেমকে করে দিলেন সার্কুলার থেকে ল্যামিনার। এর অর্থ, সামনে থেকে বাতাসের ফ্লো চলে যাবে পিছনের দিকে। সামান্য হলেও এই ব্যবস্থায় সংক্রমণের সম্ভাবনা কমবে। সাধারণত টেক অফের পর সকলেই একটু রিলাক্সড হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন কেউ কথা বলছে না। উহান, নামটাই আতঙ্ক!
সন্ধ্যা ৭টা। নীচেই উহান তিয়ান হে এয়ারপোর্ট। লেকের শহর উহান। এয়ার ইন্ডিয়া যখন অরবিটে, তখন সকলেই জানালা থেকে দেখতে পাচ্ছে ওই আশ্চর্য সুন্দর শহরকে। ফ্লাইওভার, নদীতীর, হাইওয়ে সবই নেকলেসের মতো আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো। কিন্তু একটিও গাড়ি নেই। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সচরাচর ল্যান্ডিংয়ের আগে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সঙ্গে সিগন্যালিং ছাড়াও নানাবিধ রেডিও চ্যাটের শব্দ ককপিটে বসে পাওয়া যায়। আশ্চর্যরকম নৈঃশব্দ। যন্ত্রের মতো কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করে চুপ করে গেল উহানের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। যেন রোবট। ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিংয়ের মনে হল, এক ভুতুড়ে মৃত শহরে যেন নামছেন তাঁরা। রানওয়েতে আগে থেকেই সিগন্যালিং সিস্টেম রাখা। কোনও মানুষ নেই। চতুর্দিক অন্ধকার।
এরোব্রিজের থেকে প্রথম বেরোলেন দেবদাস পিল্লাই। আর বেরিয়েই তাঁর সারা শরীরে যেন কাঁপুনি শুরু হল। এত মারাত্মক ঠান্ডা... এটা তো আন্দাজ করা যায়নি! হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। বিরাট এক এয়ারপোর্ট। একটিও মানুষ নেই। কোনও অ্যানাউন্সমেন্ট নেই। প্রায় ১০ মিনিট পর হঠাৎ একটা ট্রলি দেখা গেল। প্রোটেকটিভ গিয়ার পরে চারজন এয়ারপোর্ট স্টাফ এসে দূর থেকে একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। তাকালেন সেদিকে দেবদাস। তিনি একটা রেলিংয়ে হাত দিতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বেজে উঠল। চমকে উঠলেন। কী ব্যাপার! সামনে থাকা সাপোর্ট স্টাফ হাতের ইশারায় বোঝালেন, কোথাও টাচ করা বারণ। ততক্ষণে মেডিক্যাল টিমের তিনজন, আর ছ’জন ইঞ্জিনিয়ার বেরিয়ে এসেছেন। সেই টেবিলে একটা কাগজ রাখলেন দেবদাস। প্যাসেঞ্জারদের লিস্ট। আর চাইনিজ ফরেন অফিসের ডিক্লারেশন পেপার। আচমকা টেবিলটা চলতে শুরু করল। স্বয়ংক্রিয়। সেটি সোজা গেল একটু দূরে রাখা আর একটি ডেস্কে। সেখানে একটি কম্পিউটার। কাগজ স্ক্যান করা হল। সবুজ আলো জ্বলল এরপর। হাত তুলে জানানো হল, সব ঠিক আছে।
ততক্ষণে ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিং ফোন করেছেন ইন্ডিয়ান এমব্যাসি অফিসে। তারা কনস্যুলেট থেকে চলে এলেন দ্রুত বাসে। সঙ্গে ৩২৪ জন প্যাসেঞ্জার। আটজনের মেডিক্যাল টিম টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের নীচে নেমে এলেন। নেতৃত্বে জোস। হ্যাঁ। এটাই সেই গ্রাউন্ড জিরো। উহান। তখনও দেবদাস পিল্লাইরা জানেন না যে এই সেই মাটি, যেখান থেকে করোনা নামক এক কালান্তক ভাইরাস গোটা বিশ্বকে এক ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে আর কিছুদিনের মধ্যে। অ্যাজো জোস তাঁর টিম নিয়ে এসক্যালেটরের সামনে। পাশেই রাখা বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগ। একজন একজন করে প্যাসেঞ্জার বোর্ডিং পাস নিচ্ছে। তার আগে থার্মাল স্ক্যানিং। দমবন্ধ অবস্থা। যদি তাপমাত্রা বেশি হয়, ক্যান্সেল হয়ে যাবে। প্রত্যেকের মুখে আতঙ্ক? দেখা যাচ্ছে না। কারণ প্রোটেকটিভ স্যুট পরা, হেডগিয়ার সহ। তাই সকলেকে দেখতে এখন একরকম। তাদের দেওয়া হল নতুন করে একটি করে পিপিই সেট। দেবদাস পিল্লাইয়ের সঙ্গে দু’জন মেডিকেল স্টাফ। আজ ৩২৪ জনের লিস্ট। বাকিদের আবার একদিন পর নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান।
এত বড় একটা এয়ারপোর্ট। ৩২৪ জন প্যাসেঞ্জার। ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের টিম ডিপারচারের আগে মেনটেনেন্সের কাজ করছে। উহান এয়ারপোর্ট স্টাফেরা হাজির। অথচ এখনও পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বলেনি। সম্পূর্ণ নীরব। কোনওপক্ষই কথা বলছে না। শব্দ নেই। মোবাইল বের করা বারণ।
সব প্রোটোকল সম্পূর্ণ হল। এবার ফ্লাইটে বোর্ডিং। অনেকটা সময় লাগছে। কারণ দূরত্ব মেনটেন করাই প্রধান। অবশেষে শেষতম ব্যক্তিটি যখন উহানের মাটি থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার কেবিনে ঢুকে গেল, স্বস্তির শ্বাস। আচমকা কান্নার শব্দ। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে অনেকেই শব্দ করে কাঁদছে। তারা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, মৃত্যুর দেশ থেকে বেঁচে ফিরছে।
ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিংয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এভরিবডি ওয়েলকাম টু এয়ার ইন্ডিয়া। একটাই অনুরোধ, আমাদের এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইটে কেউ একটাও কথা বলবেন না। সিট ছেড়ে উঠবেন না। একমাত্র রেস্টরুম ছাড়া।
ঠিক তখন উহান এয়ারপোর্টে ছ’জন ভারতীয় মাটিতে বসে পড়েছেন হাঁটু মুড়ে। আগাগোড়া শরীর মোড়া প্রোটেকটিভ স্যুটের মধ্যেই যে তাঁরা হাউ হাউ করে যে কাঁদছেন তা বোঝা যায়। কেন? থার্মাল স্ক্যানারে ধরা পড়েছে তাঁদের টেম্পারেচার বেশি। তাই শেষ মুহূর্তে তাঁদের উঠতে দেওয়া হল না ফ্লাইটে। এই রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের ট্র্যাজিক অংশ এটাই।
১ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৭টা। লোককল্যাণ মার্গ, নিউ দিল্লি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি ফোন এল। অপারেশন উহান সাকসেসফুল!