বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়: মাসটা আষাঢ়। শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি। ক’দিন ধরেই নীলাচল জুড়ে রোদ-বৃষ্টির অদ্ভুত এক খেলা চলছে। তবে, আজ সকাল থেকেই প্রকৃতির মেজাজ-মর্জি খুব একটা সুবিধের নয়। অবশ্য গরম তেমন একটা নেই। সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইছে তার শরীর ছুঁয়ে উঠে আসা নোনা গন্ধ মাখা প্রবল বাতাস। এবারও বাংলা থেকে প্রচুর মানুষ এসেছেন প্রভু জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে। সদ্য সুস্থ দেবতারা মন্দির থেকে একে একে বেরিয়ে এসে রথে আরোহণও করেছেন। ভক্তদের ‘জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে’ ধ্বনিতে মুখরিত নীলাচলের আকাশ-বাতাস।
পুরীর মহারাজা প্রতাপরুদ্রও সপার্ষদ এসে পৌঁছেছেন মন্দিরের সামনে। আর কিছুক্ষণ বাদেই মাসির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন দেবতারা। কিন্তু প্রতাপরুদ্র কাকে যেন খুঁজছেন! কাকে খুঁজছেন পুরীর সর্বময় কর্তা মহারাজা প্রতাপরুদ্র?
তিনি খুঁজছেন মহাপ্রভু শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবকে। তিনিও যে রথযাত্রা উপলক্ষে ভক্ত-সহযোগে উপস্থিত আছেন মন্দির প্রাঙ্গনে। দিব্যভাবে মাতোয়ারা হয়ে তিনি ভক্তদের নিয়ে নৃত্য করছেন।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে দর্শন করার জন্য অন্যদের মতোই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন মহারাজা প্রতাপরুদ্র। কিন্তু মহাপ্রভু কিছুতেই রাজদর্শন করতে রাজি নন। এদিকে মহারাজও ছটফট করছেন নবীন সন্ন্যাসীকে দর্শন ও তাঁর চরণ স্পর্শ করার জন্য। কিন্তু মহাপ্রভুকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। রায় রামানন্দ একদিন নিজে শ্রীচৈতন্যকে বললেন, ‘কত পাপীতাপীকে তুমি পার করলে আর ঈশ্বর সেবক তোমার ভক্ত রাজা প্রতাপরুদ্র তোমার দর্শন পাবে না এটা কেমন কথা? তাঁকে দর্শন তোমাকে দিতেই হবে।’
উত্তরে মহাপ্রভু বললেন, ‘একটা উপায় হতে পারে। শাস্ত্রে আছে— ‘আত্ম বৈ জায়তে পুত্রঃ, অর্থাৎ নিজেই পুত্র রূপে জন্মায় (পুত্রের মধ্যেই পিতার অবস্থান)। তাই রাজপুত্রকে আমি কৃপা করতে পারি।’(শ্রীচৈতন্যকথামৃত)
রায় রামানন্দের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের কাছে এলেন রাজার কিশোর পুত্র। তাকে দেখেই মহাপ্রভু লাফিয়ে উঠে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, তোমাকে দেখে আমার ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়ছে। তুমি দেখছি মহাভাগবত। এবার থেকে তুমি রোজ আমার কাছে আসবে তো?
মহাপ্রভুকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন রাজপুত্র।
মহাপ্রভুর কৃপায় রাজপুত্রের মধ্যে এল এক অদ্ভুত পরিবর্তন। পুত্রের মধ্যে অলৌকিক সেই পরিবর্তন দেখে রাজাও খুব খুশি। পুত্রকে আলিঙ্গন করে তিনি অন্তরে মহাপ্রভুর স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করলেন।
একদিন এসে গেল রথযাত্রার সেই ক্ষণটি। রাজা প্রতাপরুদ্র স্বর্ণমার্জনী দিয়ে পথ পরিষ্কার করলেন। দিলেন চন্দন জলের ঝারি। আর মহাপ্রভু! তাঁর ভক্তদের চারটি দলে বিভক্ত করে শুরু করলেন নৃত্যগীত।
হাজার হাজার ভক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে মহারাজ প্রতাপরুদ্র তন্ময় হয়ে শ্রীচৈতন্যদেবের অপূর্ব লীলা দর্শন করছেন। তাঁর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী হরিচন্দন।
রথের রশিতে টান পড়েছে। মহাপ্রভুর সঙ্গে ভক্তরাও ভাবে বিহ্বল। রাজাও মোহিত হয়ে দেখছেন ‘মহাভক্তের মহালীলা’। রাজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আচার্য শ্রীবাস। তিনিও মহাভাবে আপ্লুত। বারেবারে তিনি চলে আসছিলেন মহারাজার সামনে। বারবার এইরকম হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী হরিচন্দন আচার্য শ্রীবাসকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলেন। ভাবে মগ্ন শ্রীবাসের তাতে কোনও হুঁশই নেই। বিরক্ত হরিচন্দন কিন্তু বারবার তাঁকে ঠেলতে লাগলেন। একসময় আচার্য শ্রীবাস সটান একটা চড় মেরে বসলেন হরিচন্দনকে।
ক্রুদ্ধ হরিচন্দন আচার্যকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হয়তো মেরেই বসতেন। স্বয়ং রাজা তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তোমার সৌভাগ্য তুমি এঁর হাতের ছোঁয়া পেলে। তুমি কৃতার্থ হয়েছ। কিন্তু আমি এতই দুর্ভাগা যে, তাঁর হাতের স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্যটুকু আমার হল না।’
আর ঠিক সেইসময় মহাপ্রভু শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব স্বরূপ দামোদরকে বললেন, গাও স্বরূপ, তুমি গান গাও।
স্বরূপ গেয়ে উঠলেন— সেই তো পরাণনাথ পাইলুঁ।/ যাহা লাগি মদনমোহন ঝুরি গেলুঁ।।
মহাকালের মহাফেজখানায় আজও হয়তো সেদিনের সেই ক্ষণটি সেলুলয়েডে ধরা আছে। প্রকৃত ভক্ত আজও সেই দিনটিকে মানসপটে দেখে ধন্য হন।
তবে এবারের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। মারণ ভাইরাস করোনার আক্রমণে পুরো বিশ্ব বিপর্যস্ত। ফলে প্রথম থেকেই পুরীর রথযাত্রা নিয়েও আমাদের মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল। ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন স্নানযাত্রা সম্পন্ন করার অনুমতি দেওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন রথযাত্রাও হয়তো হবে। কিন্তু তা হল না। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবারের মতো বন্ধ হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী পুরীর রথযাত্রা। অর্থাৎ এই করোনা সঙ্কটকালে জগন্নাথ, বলরাম ও দেবী সুভদ্রা কোনওভাবেই আর রথে চেপে এবছর মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে যেতে পারবেন না। দেবতাদের বন্দি হয়ে থাকতে হবে মন্দিরেই। সেখানেই পরম্পরা মেনে পালিত হবে সমস্ত আচার অনুষ্ঠান।
স্নানযাত্রার কথা আগেই বলেছি। সেদিন দেবতারা স্নানবেদিতে আসতে পেরেছিলেন। ১৪৪ ধারা জারি করেই নীলাচলের দেবতাদের স্নানযাত্রা সম্পন্ন হয়েছিল। তাঁরা প্রথা মেনে একশো আট ঘড়া জলেই স্নান করেছিলেন। কিন্তু ভক্তরা রাস্তায় নামার অনুমতি পাননি। তাঁরা সেই দুর্লভ দৃশ্য দর্শন করেন টেলিভিশনের পর্দায়।
তবে, এই প্রসঙ্গে একটি কথা অবশ্যই বলতে হবে। পুরীর মতো প্রতিবছর অশোকাষ্টমীর দিন ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরেও রথ উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা রথযাত্রা নামেই পরিচিত। সেদিন সুসজ্জিত রথে আরোহণ করে ভগবান লিঙ্গরাজ ও তাঁর ভগিনী রুক্মিণী দেবী রামকেলি মন্দিরে যান। প্রশাসনের নির্দেশে দেবতারা এবার রামকেলি মন্দিরে যেতে পারেননি। অত্যন্ত নমো নমো করেই সম্পন্ন হয়েছিল সেদিনের সমস্ত অনুষ্ঠান। মন্দিরের প্রায় পাশেই থাকেন ভক্ত উমা গুহ। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। রথযাত্রা বন্ধ হওয়াতে তিনিও খুব কষ্ট পেয়েছেন। বললেন, ‘ত্রিশ বছর ধরে পুরীতে আছি। কোনওবছর আমি রথের সময় পুরীর বাইরে কোথাও যাইনি। এবছর করোনার কারণে রথযাত্রা বন্ধ হয়ে গেল। তবে অতীতেও কিন্তু রথযাত্রা ও স্নানযাত্রা বন্ধ হয়েছে। মাদলা পাঁজি এবং চকড়া পুঁথি থেকে জানা যায় ১৬৯২ সালে মুঘলরা যখন মন্দির আক্রমণ করেছিল সেইসময় রাজার আদেশে সেবায়েতরা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ মা বিমলা দেবীর মন্দিরের পিছনে লুকিয়ে রাখেন। সেটা ছিল বৈশাখ মাস। সেবছর চন্দন যাত্রা, রুক্মিণী হরণ ও বিবাহ উৎসবও সম্পন্ন করা যায়নি। স্নানযাত্রা ও রথযাত্রার সময় দেবতারা ভক্তদের সামনে আসেননি। সমস্ত আচার-আচরণ সারা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে।
তাছাড়া বিদেশি আক্রমণ ও নানা কারণের জন্য স্বয়ং দেবতাদেরও দীর্ঘদিন বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। এর থেকেই বোঝা যায় অতীতেও একাধিকবার স্থগিত হয়েছিল স্নান যাত্রা ও রথযাত্রার মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠান।’
রথযাত্রা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেলিব্রিটি দয়িতাপতি জগন্নাথজি মহারাজের সঙ্গে। গত নবকলেবরের সময় তিনিই ব্রহ্মপ্রতিস্থাপন করেছিলেন। জগন্নাথ দয়িতাপতি বললেন, ‘আমাদের প্রভু বারো মাসে তেরোবার যাত্রা করেন। কিন্তু স্নানযাত্রা ও রথের সময়েই কেবল তাঁরা মন্দিরের বাইরে সশরীরে ভক্তদের সামনে এসে দর্শন দেন। অন্য সময় আসেন তাঁদের প্রতিনিধিরা। লকডাউনের জন্য ভক্তরা এতদিন দেবতাদের দর্শন করতে পারেননি। করোনার আক্রমণে সারা বিশ্বে প্রতিদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছেন। আমরা চাইছিলাম প্রভু বাইরে বেরিয়ে রথে আরোহণ করে তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ করুন। করোনার হাত থেকে বাঁচুক বিশ্ব। কিন্তু এবছর তো রথযাত্রা বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ভক্তরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। আমাদের মতো তাঁদেরও মন ভেঙে গিয়েছে। তাঁরাও বিহ্বল হয়ে পড়েছেন।’
রথযাত্রা এবারের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখনও অনসর পিণ্ডিতে (অসুস্থ হওয়ার পর যে গর্ভগৃহে তাঁরা বসবাস করেন) দেবতাদের গুপ্তসেবা চলছে। তাঁরা সবে সুস্থ হয়েছেন। তাঁরা মাসির বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর রত্ন সিংহাসনে আরোহণ করেন। এবার কী হবে? জগন্নাথ দয়িতাপতি বললেন, ‘সব কিছু নিয়েই আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। পাঁজি, পুঁথি দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। দেখা যাক কী হয়!’
আপনাদেরই এক দয়িতাপতি বলছিলেন, যেহেতু রথযাত্রা হল না, তাই দেবতারা আগামী একবছর অনসর পিণ্ডিতেই বসবাস করবেন? এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? এর জবাবে তিনি বললেন, ‘তাই তো হওয়া উচিত।’
যোগেন্দর মহাপাত্র বললেন, ‘মন খারাপ হলেও আদালতের নির্দেশ আমাদের মানতেই হবে। প্রভুর ইচ্ছা ছাড়া তো কিছুই করা সম্ভব নয়। তাঁর ইচ্ছাতেই হয়তো এবারের রথযাত্রা বন্ধ হল।’
দয়িতাপতি সুদর্শন মহাপাত্রকে ফোন করা মাত্রই তিনি বললেন, ‘বন্ধ হয়ে গেল রথযাত্রা। জানেন খবরটা শুনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রভুর রথযাত্রা হবে না, তা ভাবতেই পারছি না। আমাদের প্রভু জগন্নাথদেবের রথযাত্রা তো শুধুমাত্র ওড়িশার উৎসব নয়, এ তো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রভুর অসংখ্য ভক্তের প্রাণের অনুষ্ঠান। তাঁদের অনেকেই এইসময় পুরীতে আসেন। আমার মতো তাঁরাও এই খবরটা শুনে ভীষণই ভেঙে পড়েছেন। এবছর রথযাত্রা যদি হতো তাহলে ভক্তরা তো বাইরে থেকে আসতে পারতেন না। তাছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদেরও রাস্তায় নামার অনুমতি দেওয়া হতো না। সেবায়েতরাই শুধুমাত্র রথ টানতেন। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম, রথে অন্যবারের তুলনায় অনেক কম লোক উঠবেন। তাহলে তিনটে রথ টানতে মাত্র দু’হাজার লোক লাগত। আরামে তিনটে রথ তাঁরা টেনে নিয়ে যেতে পারতেন। সেবায়েতরাও রাজি ছিলেন রথ টানতে। তাঁদের কোভিড-১৯ টেস্ট করানো হয়েছিল, হোমিওপ্যাথি ওষুধটাও তাঁরা তিনদিন ধরে খেয়েছেন। ভেবেছিলাম, স্নানযাত্রার মতো ১৪৪ ধারা জারি করেই এবার রথযাত্রা হবে। ’
আগে কি দেবতাদের রথ হাতিরা টানত? সুদর্শনবাবু বললেন, ‘হাতি দিয়ে কোনওকালে রথ টানা হয়নি। আগে তো পিচের রাস্তা ছিল না। রথের সময় বৃষ্টি হতো। কখনও রথের চাকা বালিতে আটকে গেলে হাতি পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে রথকে সামনে এগিয়ে দিত। সেইজন্যই সঙ্গে হাতি রাখা হতো।’
শাস্ত্রেই বলা আছে— ‘ রথে তু বামনং দৃষ্ট্বা/ পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।’ রথের ওপর খর্বাকৃতি বামন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করলে ভক্তের আর পুনর্জন্ম হয় না। এবছর আমরা না হয় সেই দুঃখ বুকে নিয়েই মানসচক্ষে দেবতাদের দর্শন করে ধন্য হব। আর মনে মনে বলব— ‘জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে’।
তবে এখনও আশার আলো একেবারে নিভে যায় নি। ওড়িশার এক যুবক রথযাত্রা যাতে হয় সেই আবেদন উচ্চ আদালতে পেশ করেছেন। আজ তার শুনানি হবে। এখন সবকিছুই প্রভুর হাতে!!