সব কর্মেই অর্থকড়ি উপার্জন বাড়বে। কর্মের পরিবেশে জটিলতা। মানসিক উত্তেজনা কমাতে চেষ্টা করুন। ... বিশদ
রানিগঞ্জ এলাকায় ব্রিটিশ পুলিসদের হাতে শ্রমিক শোষণের খবর একবার কানে গেলেই হয়েছে! হান্টার (চাবুক) হাতে ঘোড়ায় চড়ে চলে আসতেন এর নারী। চোখে তাঁর দৃপ্ত তেজ ও সাহসে পূর্ণ শারীরিক ভঙ্গি। কোমরে থাকত রিভলভার। হাতে চাবুক আর মুখে জ্বলন্ত সিগার। যেন রহস্য উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা অতিমানবী! ব্রিটিশ মালিকদের কাছে তিনি ‘চাবুক হাতে যমদূত’, শ্রমিকদের কাছে ‘আদরের মাইজি’!
তিনি বিমলপ্রতিভা দেবী। জাতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশকে ব্রিটিশ শৃঙ্খল থেকে উন্মুক্ত করাই ছিল যাঁর প্যাশন। স্বাধীনতার ইতিহাসে কটক বরাবরই সোনা ফলিয়েছে। ওড়িশার এই রাজধানী শহরের হাওয়াবাতাসে বোধ করি এমন কিছু ছিল, যা ব্রিটিশবিরোধী মননকে উস্কে দিয়েছে ক্রমাগত। তাই সেই মাটিতেই জন্ম নিয়েছেন নেতাজি। আর সেই ভূঁয়েই ১৯০১-এ জন্ম নিলেন বিমলপ্রতিভা। বাবা সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় স্বদেশিদের পছন্দের মানুষ ছিলেন। শুরু করেছিলেন প্রবর্তক সংঘ। বহু স্বদেশি আন্দোলনরত যুবককে অর্থ ও আশ্রয় দিয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ। বাবার ছত্রছায়ায় থেকেই জাতীয়তাবাদী বোধের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ছোট্ট বিমলের। ছোট থেকেই চেয়েছিলেন জীবনের বাঁক বেপথু হোক। কিন্তু সমাজ-নিয়ন্ত্রিত নিয়তি নিয়ে জন্মানো ভারতের মেয়েদের কবেই বা সে চাওয়া মসৃণভাবে এগিয়েছে? বিমলপ্রতিভারও এগল না। সবে বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত তৈরি করছেন, এমন এক সময় তাঁর বিয়ে হয়ে গেল কলকাতার পাত্র ডঃ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মেয়েদের বেশি ‘বারমুখো’ হওয়া বা রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া পছন্দ করতেন না তিনি। মতান্তর হতে থাকে পদে পদে। বউয়ের এত রাজনৈতিক মতবাদ ভালো চোখে দেখেননি চারুচন্দ্র। বরের এত আঁটসাঁট নিয়মকেও তুড়ি মেরে উড়িয়েছেন বউ। ফলে এক পুত্রসন্তানের মা হওয়ার পরেও দেশসেবার তাগিদে সংসারের বাঁধন ছিঁড়ে একা বেরিয়ে এলেন বিমলপ্রতিভা। নিজেকে আর ওড়িশার মধ্যে আটকে না রেখে ভারতের নানা প্রদেশে ছড়িয়ে দিলেন বিমলপ্রতিভা। ছোট ছোট সংগঠন তৈরির কাজে হাত পাকালেন। মেয়েটির দেশসেবায় মন ও কর্তব্যে অবিচল মতির কথা গিয়ে পৌঁছয় ভগৎ সিংয়ের কানে। একদিন ডেকে পাঠালেন তিনি। রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে প্রস্তাব দিলেন তাঁর ‘নওজওয়ান সভা’-য় যোগ দেওয়ার জন্য। বিমল তো এককথায় রাজি! কয়েক মাস ধরে সভার কাজ চালানোর পর তাঁক কর্মদক্ষতা ও সাংগঠনিক প্রতিভায় মুগ্ধ ভগৎ সিং তাঁকে বাংলা প্রদেশের চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। এদিকে সংগ্রামের কাজ আরও ছড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯২৮-এই যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসে। আহ্বান এসেছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন ঊর্মিলা দেবীর প্রতিষ্ঠিত ‘নারী কর্মমন্দির’-এ যোগ দেওয়ার জন্যও। দেশের মেয়েদের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন এই সমিতিতেও।
এদিকে গান্ধীজি ততদিনে লবণ সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছেন। ১৯৩০-এ কংগ্রেস কর্মী হিসেবে এই পদযাত্রার হাত ধরে আসা আইন অমান্য আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিলেন বিমলপ্রতিভা। তবে এতকিছুর পরেও বিমলের মনে সুখ নেই, সোয়াস্তি নেই রক্তে। তিনি বিশ্বাস করেন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়। ভিক্ষে করে নয়। তিনি গোপনে গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের সঙ্গে শুরু হয় যোগাযোগ। কংগ্রেসের নানা অধিবেশনে সশস্ত্র আন্দোলনের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে নরমপন্থীদের বিরাগভাজন হন তিনি। দলে ক্রমেই কোণঠাসা হতে শুরু করেন। ১৯৩০ সালের জুন মাসে কলকাতায় একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে ছ’মাসের জন্য জেলে যেতে হয়। তারপরেও ১৯৩১-এ ভগৎ সিং-সহ তিন বিপ্লবীর ফাঁসির প্রতিবাদে বাংলায় সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন একা হাতে। পুলিস ভয় পেয়ে যায়। একটি ডাকাতির মামলা ও কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করা দায়ে তাঁকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। তাতেও দমে যাননি এই নারী। জেলে বসেই লিখলেন তাঁর ভাবনা ও জীবন দিয়ে সাজানো উপন্যাস ‘নতুন দিনের আলো’! ছাড়া পেয়েই আরও বিপুল উদ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন বিমল। সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করলে তাতেও যোগ দেন তিনি।
১৯৪০-এ দেশজুড়ে শুরু হয় জোরদার বেগে সশস্ত্র বিপ্লব। সেসব আন্দোলনে পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন বিমলপ্রতিভা। ইংরেজ সরকারের কাছে এই নারী হয়ে ওঠেন ত্রাস। এঁকে জেলের বাইরে বেশিদিন রাখলে সব পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে বুঝে তড়িঘড়ি বানানো মামলায় গ্রেপ্তার করে ইংরেজ পুলিস। অন্যায়ভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিতে দিতে টানা পাঁচ বছর প্রেসিডেন্সি-সহ দেশের নানা জেলে ঘুরিয়ে অবশেষ ১৯৪৫-এ ছাড়া পান বিমলপ্রতিভা। ইংরেজ তখন শেষবেলার কড়ি গুছিয়ে নেওয়ায় মন দিয়েছে। তাই হাত পড়েছে কলকারখানার শ্রমিকদের অন্নের দিকে। ততদিনে বিমল যোগ দিয়েছেন বিএলপিআই সংগঠনের সঙ্গে। চলে এসেছেন রানিগঞ্জ এলাকায়। সেখানেই শ্রমিক পীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শাসকের যম হয়ে ওঠেন এই ‘হান্টারওয়ালি’! শ্রমিক-সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা, অসুখ হলে ডাক্তার ও পথ্য, সবটাই করতেন নিজের হাতে। শ্রমিকরাও সমস্যায় ছুটে আসতেন তাঁর কাছেই। শেষ বয়সটা কাটিয়েছেন বার্নপুরের সূর্যনগর থেকে আরও দক্ষিণে দামোদরের ধারে। স্বাধীনতার পর সেখানেই একতলা বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন এই বিস্ময়প্রতিভা। ১৯৭৮-এ মৃত্যু হয় কটকের এই দামাল মেয়ের।
২০০১-এ আমরা পেরিয়ে গিয়েছি তাঁর জন্মশতবর্ষ। ‘আজাদি কি অমৃত মহোৎসব’-ও সদ্য পেরিয়ে গিয়েছি আমরা। শুধু সেই মহোৎসবের ছিটেফোঁটা আলো ঢোকেনি বিমলপ্রতিভা দেবীর বাসভবনের ধ্বংসাবশেষে। মানুষ বিস্মৃতির দাস। তাই তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তাটিও আজ স্থানীয়দের কাছে শুধুই ‘ঢাকেশ্বরী রোড’! ভাগ্যিস, আমাদের চেতনার দ্বারে ও বিস্মৃতির সম্মুখে কোনও হান্টারওয়ালি নারী দাঁড়িয়ে থাকেন না!