সব কর্মেই অর্থকড়ি উপার্জন বাড়বে। কর্মের পরিবেশে জটিলতা। মানসিক উত্তেজনা কমাতে চেষ্টা করুন। ... বিশদ
সাল তখন ১৮৭৮। সদ্য মা হয়েছে মেয়েটি। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার অভাবে ১০ দিনের মাথায় নবজাতকটির মৃত্যু হল। ছেলের মৃত্যুর জন্য মেয়েটির আত্মীয়স্বজন দায়ী করল মায়ের পূর্ব জন্মের ‘পাপ’-কে! কিন্তু ছেলের দেহ আঁকড়ে ১৩-১৪ বছরের ছোট্ট মেয়েটার বারবার মনে হচ্ছিল, একটু উন্নত চিকিৎসা পেলেই তার এ ছেলে হয়তো বেঁচে যেতে পারত! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল তেরোর কিশোরী, বড় হয়ে এই পোড়া দেশে সে ডাক্তার হবে।
মেয়েটির নাম যমুনা। বম্বে প্রেসিডেন্সি, অধুনা মহারাষ্ট্রের ঠানে জেলার কল্যাণে এক চিতপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৬৫ সালে তাঁর জন্ম। মাত্র ন’বছর বয়সে ডাক বিভাগের কর্মী বছর তিরিশের গোপালরাও জোশির সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। মারাঠি নিয়ম মেনে বিয়ের পর যমুনার নাম হল ‘আনন্দী’। বর-বউ একে অন্যকে আগে থেকেই চেনে। যমুনাদের বাড়িতে থেকেই গোপালরাও ডাকবিভাগের কাজ করতেন। ছোট্ট যমুনাকে সংস্কৃত পড়ানোর ভার ছিল তাঁরই উপর। তবে তিনি চাইতেন শুধু নামমাত্র সংস্কৃত নয়, একজন পুরুষের মতো করেই শিক্ষাদীক্ষা লাভ করুক আনন্দী। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন অকালে। দ্বিতীয় স্ত্রী আনন্দীকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের শেষ নেই। কিন্তু বউ সেটা বুঝলে তো! মেয়েমানুষের পড়াশোনা শিখলে অধর্ম হবে— এ কথা তার মা ও ঠাকুরমা মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। এদিকে নতুন বর কাছে গেলেই শুধু লেখাপড়ার কথা বলে! রান্নাঘরে ঢুকলে রেগে যায়। ভয়ে বরের কাছে যাওয়াই বন্ধ করে দিল ছোট্ট আনন্দী। গোপাল বুঝলেন, এ বাড়িতে থাকলে বউয়ের লেখাপড়া হবে না। অফিসে বদলির আবেদন করে আলিবাগে চলে এলেন। কিন্তু আনন্দী যে নেহাতই শিশু! স্বামীসঙ্গ করার বয়স তখনও হয়নি। তাই তার সঙ্গে থাকতে চললেন তার ঠাকুরমা। ফলে সমস্যার সমাধান যে খুব হল, এমন নয়। তবু হাল ছাড়লেন না গোপাল। বউকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক মননের করে তুলতেও বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। দু’জন মিলে সমুদ্রের তীরে বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু করে পুরুষদের মতো বউকে জুতো পরার অভ্যেস করানো, সবই শুরু করেছিলেন গোপালরাও।
আলিবাগের এই বাড়িতেই ঘটল সেই মারাত্মক ঘটনা। দশদিনের শিশু কোলে আনন্দী টের পেল মানুষের জীবনের দামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লেখাপড়া। যে মেয়ে পড়তে ভয় পেত, এবার সেই সাগ্রহে শুরু করল পঠনপাঠন। তবে তা আর স্বামীর মন রাখতে হয়। নিজেরই ঠিক করা অভীষ্ট পূরণে। দিন-রাত জেগে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগল সে। ডাক্তারি পড়ার জন্য যে যোগ্যতামান দরকার, তা মাত্র কয়েক বছরে অর্জন করল কিশোরী আনন্দী। স্ত্রীর অধ্যবসায় ও জেদের সঙ্গে সমানতালে তাল ঠুকে গেলেন স্বামী গোপালরাও। বিজ্ঞাপন দিলেন ‘মিশনারি রিভিউ’ পত্রিকায়। লিখলেন, তাঁর স্ত্রী মেধাবী। স্ত্রীর শিক্ষা নিয়ে নিজেরও খুব আগ্রহ। তাই তাঁরও খুব ইচ্ছা, তাঁর স্ত্রী যেন উচ্চশিক্ষা পান, কিন্তু ভারতে সে সুযোগ নেই। তাঁর আবেদন, আমেরিকায় কি কেউ গোপালরাওদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন, যাতে তাঁর স্ত্রী ওখান থেকে ডাক্তারির পাঠ নিতে পারেন? এই পত্রিকায় সাধারণত খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কথাই থাকে। এই চিঠিটা তার মধ্যে ভিন্ন হওয়ায় নজরে আসে নিউ জার্সির সমাজসেবী থিওডোসিয়া কার্পেন্টারের। তিনি ও তাঁর স্বামী বেঞ্জামিন তাঁদের সাহায্য করতে চাইলেন। থিওডোসিয়ার সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ শুরু হল আনন্দীর। এদিকে ততদিনে শ্রীরামপুরে বদলি হয়ে গিয়েছেন স্বামী গোপালরাও। তাঁর আর স্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকা যাওয়া হল না। সেদিনের ছোট্ট আনন্দী আজ উনিশ বছরের। জেদ ধরলেন, একাই যাবেন। তবু যাবেনই। জাহাজে পাড়ি দিলেন আমেরিকায়।
কিন্তু এত টাকা কোথা থেকে এল? বাংলার পোস্টমাস্টার জেনারেল এইচ ই এম জেমস অভিনন্দন জানিয়ে একশত টাকা পাঠালেন। আনন্দীর জন্য তিনি একটি ফান্ডও খুলে দিলেন তিনি। ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিপন, বাংলার গভর্নর টম্পসন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও সেখানে সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। চাঁদা উঠল মোট সাড়ে সাতশো টাকা। খরচ তো এর চেয়েও ঢের বেশি! বাবা-মায়ের দেওয়া সোনার গয়নাগুলো বিক্রি করে দিলেন আনন্দী। কষ্টেসৃষ্টে বাকি খরচ উঠল।
এবার সুদূর প্রবাসে শুরু হল আনন্দীর একার সংগ্রাম। পাশ্চাত্যের আদবকায়দা শেখানো থেকে নতুন করে বিদেশের পথঘাট, বাজার দোকান চেনানো সব দায়িত্বই নিলেন মিসেস কার্পেন্টার। আনন্দী ভর্তির সুযোগ পেলেন পেনসিলভেনিয়া মেডিক্যাল কলেজে। গোপালরাও তো আনন্দে আত্মহারা। আনন্দীও আশাপূরণের পথে খুশি। তবে অলক্ষ্যে নিয়তি বোধহয় মুচকি হাসলেন। অচিরেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন আনন্দী। তাতেও দমে গেলেন না। অসুস্থ শরীরে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে ১৮৮৬ সালে মিলল ডাক্তারি ডিগ্রি। একেবারে হাতেগরম বিদেশি সার্টিফিকেট। নামের আগে বসল ‘ডাঃ’।
ডাঃ আনন্দীবাই গোপালরাও জোশি। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার। অভিনন্দন জানালেন ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া। দেশে ফিরে কোলাপুরের অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে চাকরি পেলেন আনন্দী। কিন্তু যক্ষ্মার প্রকোপে এক বছরের মধ্যেই নিভে গেল এই আপসহীন মেধাবিনীর জীবনদীপ। ভারত হারাল স্টেথো ধরা প্রথম নারীকে। কিন্তু সেই হারানোতেও যেন রয়ে গেল অমরত্বের জ্যোতি। আনন্দী, যেন স্বল্প জীবন ভাঙিয়ে এক মহাজীবন খুঁজে নেওয়া হার না মানা মেয়ে।