যে কোনও কাজকর্মে সকালের দিকে বিশেষ উন্নতির যোগ। বিকেলের দিকে অবশ্য কিছু বাধা আসতে পারে। ... বিশদ
এখন সেই হিন্দু মন্দিরের সামনে দিনভর নিরাপত্তা রক্ষীদের ব্যস্ত চাউনি। না দেখলে হয়তো আন্দাজই করতে পারবেন না, এই শান্ত আবাসিক এলাকাটি সম্প্রতি হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। ৩ নভেম্বর শিখ অ্যাক্টিভিস্ট ও জাতীয়তাবাদী বিরোধীদের মধ্যে হিংস্র সংঘর্ষে আগুন জ্বলে উঠেছিল টরেন্টোর ব্রাম্পটন শহর। কী ঘটেছিল সেদিন? ‘হিন্দু সভা মন্দিরে’ পুজো দিতে হাজির হয়েছিলেন বেশ কিছু ভক্ত। সেই সময় ওই মন্দিরের সামনে ভারতে ১৯৮৪ সালের শিখ-বিরোধী হিংসার প্রতিবাদে অবস্থানে বসেছিলেন খলিস্তানপন্থী কয়েকজন। তাঁদের হাতে ছিল খলিস্তানপন্থী সংগঠনের পতাকা, লাঠি। অভিযোগ, হিন্দু ভক্তরা মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের উপরে চড়াও হয় খলিস্তানপন্থী জনতা। মারধরের হাত থেকে মহিলা এবং শিশুরাও রেহাই পায়নি বলে অভিযোগ। ভিডিওতে দেখা যায়, একদল এলোপাথাড়ি ইট ছুড়ে মারছে, গাড়িতে লাথি মারছে এবং লাঠি বা পতাকার খুঁটির সাহায্যে একে অপরকে আঘাত করছে। এর মধ্যে কয়েকজনের হাতে ছিল ভারতীয় পতাকা এবং অন্যদের হাতে খালিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের উজ্জ্বল হলুদ রংযুক্ত পতাকা।
মুখে যাই বলুন, শুরু থেকে আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন কানাডার পুলিস ও জাস্টিন ট্রুডোর সরকার। গত ১৩ অক্টোবর কানাডা সরকারের তরফে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, খালিস্তানপন্থী হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে যাঁদের স্বার্থ জড়িত, সেই তালিকায় কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয়কুমার ভার্মা রয়েছেন। এরপরেই সঞ্জয়-সহ কয়েকজন কূটনীতিককে দেশে ফেরত আনা হয়। পাশাপাশি, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে বহিষ্কার করে কানাডার কয়েকজন কূটনীতিককে। কূটনৈতিক লড়াই এখানেই থেমে থাকেনি। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টে কানাডার মন্ত্রী ডেভিড মরিসনের মন্তব্য উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, কানাডার মন্ত্রী ডেভিড মরিসন সংশ্লিষ্ট পার্লামেন্ট কমিটিকে জানিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নির্দেশে কানাডায় খালিস্তানিদের উপর হামলা এবং ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। যার প্রেক্ষিতে জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, ‘কানাডার সার্বভৌমত্বকে ভারত লঙ্ঘন করেছে। এটা তাদের বড় ভুল।’ ট্রুডো সরকারের এই অভিযোগকে, ‘রাজনৈতিক লাভের জন্য ভারতকে অপমান করার একটি ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার’ বলে জানিয়েছিল সাউথ ব্লক। নয়াদিল্লির তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কানাডা সরকার নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পেশ করেনি।
ভারতের অভিযোগ, ১৯৯৬ সালে হরদীপ সিং নিজ্জর পাসপোর্ট জালিয়াতি করে কানাডায় গিয়েছিলেন। সেই সময়ে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। পাকিস্তানে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। পাঞ্জাবের জলন্ধরের বাসিন্দা নিজ্জর এরপরেই গুরনেক সিংয়ের ছত্রছায়ায় ক্রমশ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কুখ্যাত জগতে পরিচিতি তৈরি করেন। ১৯৮০ থেকে ’৯০-এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ২০১২ সাল থেকে খালিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান জগতার সিং তারার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জগতারের সূত্রেই নিজ্জরের পাক-যোগ গভীর হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে মাদক ও চোরাচালানে প্রাপ্ত অর্থ সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে শুরু করেন। জগতারের সঙ্গে যুক্ত হয়েই পাঞ্জাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ছক কষেছিলেন হরদীপ। কানাডায় নিজস্ব সংগঠন তৈরি করেন। ওই দলেরই সদস্য ছিলেন মনজিৎ সিং ধালিওয়াল, সর্বজিৎ সিং, অনুপবীর সিং, দর্শন সিংয়েরা। ২০১৫ সালে হরদীপের দলের এই সদস্যরা কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে হরিয়ানার সিরসায় ডেরা সাচ্চা সউদায় হামলার ছক কষেছিলেন। নিজে ভারতে ঢুকতে না পারায় তার সংগঠনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন ডিজিপি মহম্মদ ইজহার আলমকে নিশানা করার জন্য। এহেন কট্টর খালিস্তানি নেতা নিজ্জরকে ২০২০ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিল ভারত। তিন বছর পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের একটি গুরুদ্বারের সামনে খুন হন নিজ্জর। এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘ভূমিকা’ রয়েছে বলে অভিযোগ তোলা শুরু করে কানাডার ট্রুডো সরকার।
ট্রুডোকে একটিই প্রশ্ন করার— বিভিন্ন রাজনৈতিক ‘লবি’র চাপে অপ্রমাণিত সংবাদের ভিত্তিতে এত বড় অভিযোগ কী করে তুলল কানাডা সরকার? বুঝতে কি অসুবিধা আছে যে, সাততাড়াতাড়ি কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে এই আক্রমণাত্মক বার্তা আসলে নিজের দেশে খালিস্তানি ভাবাপন্ন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী সমাজের রাজনৈতিক তাড়নার ফল? সরাসরি ভারতের কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিশানা করে যে কূটনৈতিক সীমারেখা লঙ্ঘন করেছিল কানাডা, তার ফলেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রাম্পটন শহরে। শিখস ফর জাস্টিস-এর (এসএফজে) নেতা ইন্দ্রজিৎ সিং গোসাল স্বীকার করেছিলেন, প্রতিবাদ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ছিল এবং হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। ৩৫ বছরের ওই ব্যক্তি ব্রাম্পটনেরই বাসিন্দা। সংঘর্ষের ফুটেজ দেখে ঘটনার পাঁচদিন পর তাঁকেই গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিস। অভিযোগ, বিক্ষোভের উদ্যোক্তা এই ইন্দ্রজিৎ সিং গোসাল।
এও এক যুদ্ধ। কূটনৈতিক যুদ্ধ। এমন যুদ্ধ ভারত কোনও পশ্চিমি দেশের সঙ্গে সচরাচর লড়ে না। এই মুহূর্তে কানাডা-ভারত যে উত্তপ্ত দ্বৈরথে অবতীর্ণ, আজ নয়, প্রায় এক বছর ধরে তার বীজ ছড়ানো চলছিল। এখন ক্ষেত্র কেবল প্রস্তুত নয়— অতি উর্বর, তপ্তশিখানলে পুড়ে চলেছে দুই দেশের সম্পর্ক। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক থেকে বার্তা গিয়েছে: এই অত্যন্ত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির দায় সর্বতোভাবে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকেই নিতে হবে। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক গবেষক পরিতোষ কুমারের কথায়, ‘মোদি সরকারের কারণে বিশ্বব্যাপী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আরও সাহসী হয়েছে। যা কানাডায় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ণবৈষম্যের শিকার কিছু প্রবাসী জনগণ এই মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।’
আসলে কানাডা আর এক পাকিস্তান হয়ে উঠছে। বড় সংখ্যক শিখ জঙ্গি এখন কানাডা সরকারের আশ্রয়ে। সেখান থেকে অর্থ এবং আরও নানা ভাবে ভারতে খালিস্তানিদের মদত জুগিয়ে যাচ্ছে। বারবার ট্রুডো সরকারকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওই জঙ্গিদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক দেশ কানাডায় যে কোনও ব্যক্তি তাঁর নিজের মত ও পথ প্রচার করতে পারেন। এমনকি অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও হয়তো তা করতে পারেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নীতি লঙ্ঘন করে এই ধারাকে থামানো হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কের জন্য ভারত-বিরোধী অপপ্রচারে সরকারি স্বীকৃতির সিলমোহর দেওয়া যায়? ট্রুডোর মনে রাখা উচিত, তিনি কোনও ক্লাবের নেতা নন। একটি বৃহৎ, অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান তিনি— যিনি কথা বলছেন অন্য একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থে সে দেশের বিস্তীর্ণ অভিবাসী শিখ সমাজের সমর্থন আদায় করতে চান ট্রুডো। সেই সমাজের মধ্যে তীব্র ভাবে প্রবহমান খালিস্তানি প্রভাবকে উস্কানি দিতে চান। কিন্তু তাঁর ক্রমশ উচ্চগ্রামে যাওয়া ঝাঁঝালো ভারত-বিরোধী আক্রমণ এবং আমেরিকা-সহ নিরাপত্তা জোট ‘ফাইভ আইজ’কেও নিজের পক্ষে টানার কূটনৈতিক প্রয়াস কী ভাবে প্রতিহত করা যায়, তা নিয়ে উদ্বেগে সাউথ ব্লক। বাস্তবিক, পরিস্থিতি এখন যেমন, তাতে ভারত বলতেই পারে, অভিযোগ প্রমাণের মতো নথিপত্র না দেখাতে পারলে কানাডার আন্তর্জাতিক মঞ্চে জবাবদিহি করা উচিত।
আসলে কানাডায় নির্বাচন আগামী বছর। পাঞ্জাবের পরে কানাডাতেই সবচেয়ে বেশি শিখের বাস। যদিও সংখ্যায় তাঁরা কানাডার জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ, বা সাত লাখ সত্তর হাজারের কাছাকাছি। তবে দুই শতাংশ ভোটই কানাডার ঘরোয়া রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই অঙ্ক মাথায় রেখেই ট্রুডো অত্যন্ত বড় ঝুঁকি নিয়ে এক জুয়াখেলায় মেতেছেন। ট্রুডো জানেন, কানাডাবাসীর কাছে তাঁর আবেদন ক্রমাগত কমছে। বিগত দু’বছরে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানোর বিপদও টের পেয়েছেন। কানাডার কিছু সংগঠন ট্রুডোকেই অভিযুক্ত করে বলেছেন, নাগরিকদের মধ্যে ক্রমশ কমে যাওয়া রেটিংয়ের থেকে নজর ঘোরানোর জন্যে তিনি কিছু ‘অপ্রমাণিত গোয়েন্দা তথ্য’ সর্বসমক্ষে এনেছেন। কানাডার প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী নেতা পিয়ের পয়লেভ্রে যেমন বারবার বলছেন, ‘কানাডা ভেঙে গিয়েছে’। এই বার্তার প্রতি কানাডার মানুষের সমর্থন ক্রমশ বাড়ছে। পশ্চিমি দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরাও একমত, জি-২০ দলের মধ্যে কানাডার প্রভাব দ্রুত কমছে।
ট্রুডো যতই চেঁচান না কেন, এই দুনিয়ায় এমন হত্যাকাণ্ড ক্রমশ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। উদাহরণ— ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাতে একের পর এক ইরানের পারমাণবিক গবেষকদের হত্যা, কিংবা পাকিস্তানের মাটিতে নেমে আমেরিকার ওসামা বিন-লাদেন হত্যা। আলেকজান্ডার লিটভিনেকো-র মতো এক ভিন্নমত পোষণকারীকে বিদেশের মাটিতে হত্যা করেছে রাশিয়াও। হয়তো ভারতও এখন মোসাদ কিংবা সিআইএ-র মতো সন্দেহভাজন উগ্রপন্থীদের খতম করবার পদ্ধতি গ্রহণ করছে। অনেকেই বলবেন, এসবই আন্তর্জাতিক আইন বিরুদ্ধ কাজ! কিন্তু যে আন্তর্জাতিক আইন দুনিয়ার কোনও দেশই মানে না, সেই আইনের বই ভারতের মুখে ছুড়ে মারলে সাউথ ব্লক কি চুপ করে থাকবে?
পশ্চিমি দুনিয়ার বহুদেশীয় গুপ্তচর-জোট ‘ফাইভ আইজ’ ভারতের বিরুদ্ধে যত ইচ্ছে প্রমাণ জড়ো করুক না কেন, বছরের পর বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে সেই দেশগুলি যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারও তো ব্যাখ্যা চাইতে পারে নয়াদিল্লি। আন্তর্জাতিক আদালত তার জন্য তৈরি তো?