যে কোনও কাজকর্মে সকালের দিকে বিশেষ উন্নতির যোগ। বিকেলের দিকে অবশ্য কিছু বাধা আসতে পারে। ... বিশদ
যাঁদের পুঁজির ঘাটতি রয়েছে, অথবা যাঁদের সামান্য অর্থ সঞ্চয় রয়েছে, তাঁদের তুলে আনার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক হাতিয়ার হিসেবে সমবায় আন্দোলনের সম্ভাবনা রয়েছে বিপুল। সেই ভাবনাকে সামনে রেখে ভারত দ্রুত গতিতে কাজ করে চলেছে।
সমবায়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। স্বাধীনতার আগে যেভাবে সমবায় আর্থিক বিকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কার্যকালে তাকে আরও বৃহৎ শক্তি ও উদ্যম নিয়ে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার জাতীয় স্তরে একটি পৃথক সমবায় মন্ত্রক গঠনের মাধ্যমে সমবায় ক্ষেত্রে আগে বন্ধ থাকা সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে। সমবায় ক্ষেত্রকে মজবুত করার লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মাত্র তিনবছরের মধ্যে ভারত সমবায় ক্ষেত্রে ‘বিশ্বমিত্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
তার ফলে ভারতের সমবায় আন্দোলন আজ এক ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জনের মুখে। ২০২৪-এর ২৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দিল্লিতে ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ অ্যালায়েন্স (আইসিএ) জেনারেল অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড গ্লোবাল কো-অপারেটিভ কনফারেন্সের আয়োজন করতে চলেছে ভারত। আইসিএ’র ১৩০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ভারত আয়োজকের ভূমিকা পালন করতে চলেছে। এই সম্মেলন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ২০২৫-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক সমবায় বর্ষ উদযাপনের আগেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এটি। ভারতে এই সম্মেলনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে সমবায় আন্দোলনে নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নিল আমাদের দেশ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে অনগ্রসর, অত্যন্ত পশ্চাৎপদ, বঞ্চিত এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষকে তুলে আনার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সমবায় আন্দোলনকে শক্তিশালী না করলে, এই ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। সমবায় প্রতিষ্ঠান, তাদের কাজকর্মকে সুসংহত করা এবং স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতামুখী করার লক্ষ্যে প্রশাসনিক নীতি ও আইনের সংস্কার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্র ‘সহকার সে সমৃদ্ধি’ (সমবায়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধি)-র লক্ষ্য হল, দেশের সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বনির্ভর ও চাঙ্গা করা। সমবায় নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের মাধ্যমে একটি নতুন আর্থিক মডেল গড়ে উঠছে, যার একটি হল প্রধানমন্ত্রীর ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ভারতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার ভাবনা। এই মডেল শুধুমাত্র ভারতকে অগ্রগতির পথ দেখাচ্ছে না, ওইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিকেও উন্নয়নের কাঠামো গড়তে প্রেরণা জোগাচ্ছে।
প্রাচীনকাল থেকে সমবায় ক্ষেত্রে ভারতের ঐতিহ্য রয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক চর্চা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গ্রামে মন্দির বা বাঁধ নির্মাণের মতো সম্মিলিত প্রয়াসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণ ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় প্রাচীনকালের সমবায় কাঠামোর ঝলক দেখা যায়। পশ্চিমের দেশগুলিতে শিক্ষণপ্রাপ্ত বহু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ২১ শতকের শুরুতে সমবায়ের যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা বর্তমান যুগে অচল। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ৩ কোটি, ৫ কোটি অথবা ১০ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশগুলিতে যে আর্থিক মডেল গড়ে উঠেছে, ভারতের মতো ১৪১ কোটি মানুষের দেশের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে শুধুমাত্র আর্থিক অগ্রগতির সমস্ত সূচক বৃদ্ধিই আবশ্যিক নয়, সেইসঙ্গে ১৪০ কোটি মানুষের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। একমাত্র সমবায়ের মাধ্যমেই তা সম্ভব। ইতিহাসে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমেদাবাদ জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক গত এক শতাব্দীতে ১০০ কোটি টাকা লাভ করেছে। এর অনুৎপাদক সম্পত্তির (এনপিএ) পরিমাণ শূন্য, ওইসঙ্গে সঞ্চয়ের পরিমাণ ৬,৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সমবায় আন্দোলনের আরও একটি সফল উদাহরণ হল ‘আমূল’। বর্তমানে ৩৫ লক্ষ পরিবারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে তাঁরা মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করছেন। এইসব পরিবারের মহিলারা মূল ভূমিকা পালন করছেন এবং সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ফলে বর্তমানে আমূলের বার্ষিক লেনদেন ৮০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। চমকপ্রদ হল ওই মহিলাদের প্রাথমিক লগ্নি ১০০ টাকার বেশি ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূরদৃষ্টিপূর্ণ নেতৃত্বে ভারতে সমবায় আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী করতে সরকার ৬০টির বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বছরের পর বছর ধরে অবহেলা এবং প্রশাসনিক অনিয়মের কারণে অধিকাংশ প্রাইমারি এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি (পিএসিএস) আর্থিকভাবে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার মোকাবিলায় সরকার পিএসিএস-এর সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। নতুন আইন প্রণয়নের ফলে পিএসিএস-গুলি এখন ডেয়ারি, মৎস্য, শস্য মজুত এবং জন ঔষধি কেন্দ্র চালানো সহ ৩০টির বেশি বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপে যুক্ত।
কো-অপারেটিভ পরিমণ্ডলকে সম্প্রসারিত করতে জাতীয় স্তরে তিনটি নতুন বহুমুখী-রাজ্য কো-অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে তোলা হয়েছে। ন্যাশনাল কোঅপারেটিভ এক্সপোর্ট লিমিটেড কৃষকদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সুবিধা উন্মুক্ত করেছে। ভারতীয় বীজ সহকারী সমিতি লিমিটেড কৃষকদের জন্য উন্নতমানে বীজ সুনিশ্চিত করেছে, অতিরিক্ত হিসেবে আর্থিক সহায়তা, কর ছাড় এবং ইথানল সংমিশ্রণের মতো সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সমবায় চিনি কলগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। সমবায় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির তহবিলকে সমবায় ব্যাঙ্কে স্থানান্তরের নীতির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। স্বচ্ছতা আনতে জাতীয় সমবায় ডেটা বেস-এর মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ওইসঙ্গে অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে সমবায় আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি সর্বাত্মক জাতীয় সমবায় নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে।
২০২৪-এ আইসিএ’র সাধারণ সভা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি, দারিদ্র্যদূরীকরণ, লিঙ্গ সমতা এবং ইউনাইটেড নেশনস সাসটেনেবেল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) অর্জনে ভারতের উল্লেখযোগ্য অবদান তুলে ধরার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে কাজ করবে। বিশ্বজুড়ে সমবায়গুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সকলের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে এর প্রয়োজন রয়েছে।
যেহেতু আমরা এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের আয়োজনের জন্য তৈরি হচ্ছি, আমি সমবায় নেতৃবৃন্দ, নীতি নির্ধারক এবং মানব উন্নয়নে নিযুক্ত সবাইকে খোলামেলা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আসুন, আন্তর্জাতিক সমবায় আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে আমরা একসঙ্গে শিক্ষা ও সহযোগিতার চেতনা ভাগ করে নিই। ‘সহকার সে সমৃদ্ধি’র প্রতি ভারতের অঙ্গীকার শুধুমাত্র একটি ভাবনা নয়, এটি হল, সম্মিলিত সমৃদ্ধি, স্থায়িত্ব ও অগ্রগতি ভাগ করে উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার অঙ্গীকার।
মতামত ব্যক্তি