যে কোনও কাজকর্মে সকালের দিকে বিশেষ উন্নতির যোগ। বিকেলের দিকে অবশ্য কিছু বাধা আসতে পারে। ... বিশদ
প্রাক-নির্বাচন এবং নির্বাচনের পরে, বাজার সূচকগুলি নিম্নগামী হয়েছে। ৫ নভেম্বর সেনসেক্স বন্ধ হয়েছিল ৭৮,৭৮২-তে এবং ভারতীয় মুদ্রায় ডলারের বিনিময়
হার ছিল ৮৪.১১ টাকা। এই লেখা যখন লিখছি, তার আগের দিন বা বৃহস্পিতবার সেনসেক্স ৭৭,১৫৬-তে বন্ধ হয় এবং সেদিন আমাদের মুদ্রায় ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪.৫০ টাকা।
ট্রাম্প একজন ‘মার্কেন্টিলিস্ট’
আসুন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল বিশ্বাসের দিকে তাকাই। আমরা জানি, তিনি একজন ‘মার্কেন্টিলিস্ট’ এবং বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র উচ্চ হারে শুল্কই আমেরিকাবাসীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। উচ্চ হারে শুল্ক চাপাবার হুমকি দিয়েছেন তিনি, বিশেষ করে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর। বাইডেন জমানায় চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এইকরম: ২০২১ সালে ৩৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে ৩৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২৩ সালে ২৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনী লোকজনের প্রচুর পরিমাণে চীনা পণ্যদ্রব্য, পোশাক, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র এবং নানাবিধ যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। উচ্চ হারে শুল্ক চাপালে আমেরিকায় খরচ বাড়বে শিল্প এবং উপভোক্তা উভয়েরই। স্বভাবতই বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি এবং ইউএস ফেডও বাড়িয়ে দেবে সুদের হার (পলিসি ইন্টারেস্ট রেট), যা এবছর দু’বার সেখানে কমানো হয়েছে। অন্যদিকে, কর্মসংস্থান বা চাকরির বাজার ঠিক রাখতে চীনকে পণ্য উৎপাদন চালিয়েই যেতে হবে। ফলত, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীন তার পণ্যগুলি অন্যান্য দেশে ‘ডাম্প’ করতে বাধ্য হবে। ডাম্পিং ঠেকাতে ভারত ইতিমধ্যেই চীনা পণ্যের উপর সর্বোচ্চ সংখ্যক শুল্ক চাপিয়ে রেখেছে। মার্কিন শুল্কের উচ্চ হারের বদলা হিসেবে যে শুল্ক এরপর আরোপ করা হতে পারে তার পরিণাম বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য খারাপ হওয়ারই আশঙ্কা থাকছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব কম লোকই রাজকোষ ঘাটতি (ফিসকাল ডেফিসিট) নিয়ে কথা বলে, যেভাবে ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলি তাদের রাজকোষ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমেরিকা অবশ্য তার ঘাটতি মেটাবার ব্যবস্থা সহজেই করে ফেলতে পারে, কারণ চীনসহ অন্যান্য দেশগুলি মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কিনে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জাতীয় ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার মধ্যে প্রায় ১১৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার দিয়েছে চীন। এখন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজকোষ ঘাটতি বৃদ্ধি পায় তবে তা মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ফলস্বরূপ সুদের হার বাড়ানো হলে মূলধনের সংগ্রহ ধাক্কা খাবে এবং ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে পুঁজি চলে যাবে অন্য দেশে। একটি তেজি ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
ট্রাম্প একজন ‘প্রোটেকশনিস্ট’
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁদের শিল্প-কারখানাগুলিকে আমেরিকাতেই ফেরাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন শিল্প কলকারখানাগুলিকে সে-দেশের ভিতরেই নির্মাণের জন্য তিনি লোভনীয় ইনসেনটিভ ঘোষণা করতে পারেন। তাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) কমে যাবে। যদি ব্যবসাগুলি এখনও বিদেশে তাদের কারখানা তৈরি করতে চায় তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রযুক্তি রপ্তানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারেন। আমেরিকার পণ্যের উপর চড়া শুল্ক আরোপের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপর একসময় ক্ষুব্ধ ছিলেন। এমনকী ভারতকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ (বাণিজ্যিক ফায়দার স্বার্থে কোনও দেশ ‘অন্যায্য’ মুদ্রনীতি নিয়ে চললে তাকে এই নাম দেওয়া হয়) বলেও অভিযুক্ত করেছিলেন তিনি। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদির মধ্যেকার ‘দোস্তি’ ভারতের প্রতি তাঁর মনোভাবকে নরম করবে কি না এবং ব্যাপারটা ভারতের জন্য একটি ব্যতিক্রমী হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েই যায়।
অন্য গুরুতর সমস্যাটি হল ‘অবৈধ’ অভিবাসন (ইললিগাল ইমিগ্রেশন)। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বেকারত্ব থেকে অপরাধ, মাদকের উৎপাতসহ যাবতীয় খারাপ ব্যাপারের জন্য এটাকেই দায়ী করেছেন। ট্রাম্প সাহেব এমনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁর তরফে দেশশাসনের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে ১০ লক্ষ পর্যন্ত ‘অবৈধ’ অভিবাসীকে গায়ের জোরে আমেরিকা থেকে খেদাবেন! ‘অল ডিপোর্টেশন অফ ইললিগাল এলিয়েনস’ কর্মসূচির দায়িত্ব দেওয়ার জন্য ট্রাম্প সাহেব একজন ‘হার্ডলাইনার’ বা কট্টরপন্থীকেই বেছে নিয়েছেন, তিনি হলেন টম হোম্যান।
কতজন ভারতীয়কে বিতাড়িত করা হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে কিছু তো হবেই। সেই ঘটনার বিরূপ প্রভাব পড়বে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উপর। ডোনাল্ড ট্রাম্প এইচ১বি১ ভিসা অর্জনের নিয়মকানুন আরও কড়া করতে পারেন। যদিও মার্কিন মুলুকের শিল্প, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্র আরও যোগ্য ভারতীয়দের সেদেশে চায়। তারা চায় ওই ভারতীয়রা সেখানে থাকুন এবং আমেরিকার নাগরিকই হয়ে উঠুন। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প
এবং মার্কিন নিয়োগকর্তারা নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকেন তবে তাতে একটি ভয়ানক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
জলবায়ু নিয়ে সংশয়বাদী ট্রাম্প
ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি খনিজ তেল এবং ওষুধ শিল্পকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর এনার্জি সেক্রেটারি হিসেবে ক্রিস রাইটকে মনোনীত করেছেন। রাইট হলেন ‘ফ্র্যাকিং এবং ড্রিলিং’-এর একজন কট্টর সমর্থক। জলবায়ু সংকট বলে কিছু যে আছে, তা তিনি মানেন না। জলবায়ু পরিবর্তনের উপর কনফারেন্স অফ পার্টিজ (সিওপি) আলোচনা হয়তো থেমে যাবে না কিন্তু একটি গুরুতর ধাক্কা তাতে লাগতে পারে। সিওপি’র প্রচেষ্টাকে সমর্থন করাই ভারতের বর্তমান অবস্থান কিন্তু তা একটু ধীরে চায় এবং সেটা হতে পারে। ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্রন্ট বা ওষুধ শিল্পের অনুমান, নিয়ন্ত্রণ কমবে এবং ওষুধের দাম বাড়ানো সম্ভব হবে। এই প্রত্যাশা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ বেড়েছে। সারা বিশ্বে ওষুধের দাম বাড়বে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আমাদের যে প্রচেষ্টা, আঘাত আসবে তার উপর।
সর্বশেষ প্রশ্ন: যে দুটি যুদ্ধ রোজ কয়েক ডজন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ নিচ্ছে এবং স্কুল ও হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোগুলিকে ধ্বংস করছে, সে সম্পর্কে ট্রাম্প সাহেবের মনোভাব কী হবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘যুদ্ধ বন্ধ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে তার জন্য তিনি কী করবেন? এখনও পর্যন্ত কিন্তু তা নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। তাঁর অতীত ইতিহাস এবং ঘোষণাপত্তর অবশ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তিনি ইজরায়েলের পাশেই থাকবেন। রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য তিনি জেলেনস্কিকে চাপ দিতে পারেন। তাতে তড়িঘড়ি পদক্ষেপের পরিণতিই হবে। যুদ্ধ শেষ হয়ে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি মিলবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। এর উল্টো দিকে, যুদ্ধের অশান্তি বেড়ে গেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান আরও ব্যাহত হবে। সেই পরিস্থিতির প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর পড়বে মারাত্মকভাবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেইন’ নীতি আমাদের এই গ্রহকে আরও ভালো, নিরাপদ কিংবা সমৃদ্ধ করেব না। তাঁর কথামতোই, এটা একেবারের আমেরিকার নিজের স্বার্থে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ
করে দিয়েছে যে, এই জনপ্রিয় ঘোষণা ট্রাম্প সাহেবের ব্যক্তিস্বার্থের জন্যও।
মতামত ব্যক্তিগত