প্রণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। কারও কথায় মর্মাহত হতে হবে। ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কর্মে সুনাম ... বিশদ
শ্রুতি সিং ডাক্তার। টানা কয়েকদিন বেশ টেনশনে ছিলেন... পিপিই পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু হাসপাতালটা যে কোভিড! প্রতি মুহূর্তে ভাবনা... হয়ে গেল না তো? শনিবার ট্যুইটারে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। পিপিই পরা অবস্থায়। অবশেষে মিলেছে। লিখেছেন, ‘ব্যাগটার মধ্যে শূয়োরের মতো ঘামছি। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’ তাও থাম্বস আপ... আর টেনশন নেই তাঁর। অক্লান্ত পরিশ্রমেও না...। তিনি কি জানেন, দিল্লি পুরসভার ডাক্তাররা গত তিন মাস বেতন পাননি!
২০ লক্ষ কোটি। জিডিপির ১০ শতাংশ। অনেকগুলো টাকা। ভীষণ ভারী একটা অঙ্ক। আর তার থেকেও জটিল নির্মলা সীতারামনের পাঁচ দিনের ঘোষণা। ঘণ্টাখানেক টিভির সামনে বসে যদি ঊষা এই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা পাঁচদিন ধরে শুনতেন, তাহলে কিন্তু তাঁর সংসার চলত না! আর তাঁর আশায় সেই সময়টা বসে থাকতে হতো বহু মানুষকে... বিনা বিদ্যুতে। শ্রুতিরও কি রোগী ছেড়ে টিভির সামনে বসে থাকলে চলবে? তাই তিনিও পারেন না। তাঁর জীবিকা যে মানুষকে জীবনের প্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনে মূল স্রোতে! কিন্তু ঊষা, শ্রুতিরা হয়তো আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী রাত ৮টার সময় জাতির উদ্দেশে ভাষণে যখন এত কথা বলেছেন, তার মানে এবার কিছু একটা পাওয়া যাবে।
নির্মলা বললেন। একদিন, দু’দিন...পাঁচদিন। তাঁরা ভাবলেন, আজ হল না... কাল নিশ্চয়ই মিলবে। যে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তাকে মোকাবিলা করার মতো শক্তি। সামান্যই হোক না! শুধু কথায় যে পেট ভরছে না! বেশি কিছু নয়, লকডাউনে স্তব্ধ দেশের মাটিতে বেঁচে থাকার মতো কিছু সংস্থান। অনেক ঘোষণা করলেন নির্মলা। মানুষ শুনল, তারপর ভাবল... প্রধানমন্ত্রীর কাজকর্মের ঢালাও ফিরিস্তির বাইরে আর কী পেলাম? সরকার বাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিল... আরে পেলে তো! কোটি কোটি টাকা ঋণের সংস্থান। বাঁচতে হলে লোন করো। সুদ আমরা দেব। আমরা ভাবলাম, এ তো বেশ ভালো ব্যাপার! কত টাকা লোন পাওয়া যাবে? নির্মলা জানিয়েছেন, মুদ্রা শিশু প্রকল্পে লোন করলে ১২ মাস ধরে ২ শতাংশ সুদ সরকার দেবে। অর্থাৎ, বসে না থেকে ব্যবসা করুন। তার জন্য ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে। ওই টাকায় ঠিক কেমন ‘বাণিজ্য’ হবে, বলা মুশকিল। তাও ধরা যাক, আপনি ৫০ হাজার টাকারই লোন করলেন স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে। ন্যূনতম সুদ ১০.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ হিসেব কষে দেখলে মাসের শুরুতে সরকার খুব বেশি হলে আপনার জন্য দেবে সাড়ে ৮ টাকারও কম (২ শতাংশ)। রান্নাঘরে বাজার নেই, পেটে খাবার নেই... এমন একটা অবস্থায় ঘাড়ের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে খুব লাভ হবে কি?
আর একটা ঘোষণায় আসা যাক। বেসরকারি ক্ষেত্রে যাঁদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ড ফান্ড কাটা হয়, তাঁদের জন্য সুবিধা। বলা হচ্ছে, ১২ শতাংশ নয়, কয়েক মাস ১০ শতাংশ টাকা পিএফের জন্য কাটা হবে। অর্থাৎ বাকি ২ শতাংশ টাকা কর্মীরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। এবার প্রশ্ন, টাকাটা কার? সরকারের তো নয়! সেটা আপনার-আমার টাকা। যা ভবিষ্যতে অবসরপ্রাপ্ত জীবনের জন্য সরকারের ঘরে জমা থাকত, সেটাই আজ আমরা বাড়ি নিয়ে যাব। সরকার কিন্তু কিছু দিল না! বরং এই দুই শতাংশের প্রভাবটা পড়বে আমাদের পিএফ অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ, সঞ্চয়ে ধাক্কা।
সঞ্চয় বলে কিছুই নেই তো সেই ক্ষুদ্র চাষিদেরও। যাঁদের জন্য রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অনেক কিছু করার কথা ঘোষণা করল মোদি সরকার। নাবার্ডের ৯০ হাজার কোটির পাশাপাশি কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন নির্মলা। এই অঙ্কটাও নাবার্ড দেবে গ্রামীণ কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক বা রুরাল রিজিওনাল ব্যাঙ্ককে (আরআরবি)। সেখান থেকে কৃষকরা ঋণ নেবেন। গুজরাতের সেই কৃষক... পেঁয়াজ নিয়ে গিয়েছিলেন এপিএমসি মার্কেটে। আশা ছিল, বিক্রি করে যা দাম পাবেন, তাতে লকডাউনের এই সঙ্কটে না খেতে পেয়ে অন্তত মরতে হবে না। কিন্তু যা পেলেন, তাতে ক’বেলা খাবার জুটবে সেটাই প্রশ্ন। তাই তিনি কাঁদছিলেন... মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সরকার কি আশা করে, তিনি এবার গিয়ে লোনের জন্য লাইন দেবেন? দিলেই বা... শোধ করবেন কীভাবে? আর না পারলে?
এর থেকেও বড় আর একটা প্রশ্ন আছে... লোন কি তিনি সত্যিই পাবেন? এই ঋণের টোপ কিন্তু রাজার বাড়ির খাওয়ার মতো, না আঁচানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। চেনাজানার ফোন বা চিঠি এক্ষেত্রেও ফোড়নের কাজ করে। আর প্রভাবশালী কানেকশন থাকলে কী হয়, তার প্রমাণ তো রয়েইছে... নীরব মোদি! এই প্যাকেজে আবার সেই প্রবণতাই খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টাচরিত্র করেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার। একদিকে কোম্পানিস অ্যাক্টে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে, যাতে গোলমাল পাকালেও ফৌজদারি কেস হবে না। পাশাপাশি টাকা ধার নিয়ে কেউ যদি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন, কিংবা নীরব মোদি-মেহুল চোকসি হয়ে যান... তাহলেও আগামী এক বছর তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনও মামলা-মোকদ্দমা হবে না।
ভদ্দরলোকে বলবে, এই সরকার কর্পোরেট ফ্রেন্ডলি। কিন্তু মানুষ বলবে... বেওসায়ীদের সরকার। এই প্যাকেজের মোড়কে আসলে দেশীয় সব শিল্পক্ষেত্র বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা চওড়া করে দিয়েছে মোদি সরকার। প্রতিরক্ষা হোক কিংবা পরমাণু ক্ষেত্র... বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য সর্বত্র দরজা হাট করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ডিআরডিওতে লগ্নি করে কোনও কোম্পানির সর্বময় কর্তা বলতেই পারেন, দেখি তো আপনারা কী নিয়ে এত গবেষণা করছেন? আমার টাকাটা উঠছে তো?
প্রাইভেটাইজেশন নয়, কর্পোরেটাইজেশন। ধাপ্পাবাজির নতুন গালভরা নাম। আন্তর্জাতিক মহল ভারত সরকারের নামে ধন্য ধন্য করছে। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে দেশের বাজারটাই তো উন্মুক্ত হয়ে গেল। আর ভারতের বাজার সবথেকে বেশি ‘প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন’। আমেরিকা হোক বা চীন, প্রত্যেকেই চায় আমাদের দেশের মাটিতে ব্যবসার ভিত শক্ত করতে। তাই সব শালিকের এক রা... দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান, অসাধারণ দূরদর্শিতা। এর উপর ভর করেই ভবিষ্যতে ভারত উন্নতির শিখরে চড়ে বসবে। সে তো গেল দূরের কথা। ভারতের অর্থনীতি কবে এভারেস্টে উঠতে পারবে, সে নিয়ে গবেষণা করার সময় আজ নেই। এই সময় হিসেবের... কত লক্ষ মানুষ চাকরি হারালেন, কত কোটি মানুষের শেষ সঞ্চয়টুকু ‘বিনা প্রস্তুতির’ এই লকডাউনে শেষ হয়ে গেল, কত পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফেরার তাগিদে হাঁটতে শুরু করে পথেই প্রাণ দিলেন। হাতে টাকা কিন্তু তাঁরাও পেলেন না। বরং হাতে পাচ্ছেন এমন একটা রেশন কার্ড, যা ভাঙিয়ে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তাঁরা খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে পারবেন। মানেটা স্পষ্ট, কীভাবে কার্যকর হবে, তার দায় রাজ্যের। কিন্তু রাজ্য কী পাবে? আছে তো! ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা ৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করে দিয়েছে কেন্দ্র। সেখানেও কিন্তু শর্ত আছে... বেসরকারিকরণের শরিক হতে হবে। যাই হোক, রেশন মিলল। কিন্তু রান্না করবে কোথায়? পরিযায়ী শ্রমিকদের মাথায় তো আর স্থায়ী ছাদ থাকে না! তাই কেন্দ্রের আর্জি, পরিযায়ীদের সুলভে বাড়ি ভাড়া দিন। সে আর এক বিষম বস্তু। বাড়িওলা সবার আগে ভাববেন, ভাড়া তো দেব, ওঠাতে পারব তো?
পরিযায়ী শ্রমিকরা কখনও এই গ্রামে, তো কখনও ওই শহরে। এভাবেই চলে তাঁদের জীবন। কখনও ধানের মরশুমে ফসল তুলছেন, তো কখনও শহরে গিয়ে আবাসন প্রকল্পে কাজ করছেন জোগানদারের। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রকে নথিভুক্ত করে যতই পরিসংখ্যানে বাঁধার চেষ্টা করা হোক না কেন, একটা বড় অংশ তালিকার বাইরেই থেকে যায়। এই লকডাউন পর্বে হয়তো সেই অংশটার খোঁজ মিলবে। তবে কথায় বলে, মানুষ অভ্যাসের দাস। কাজটাও একটা অভ্যাস। তিন-চার মাস কম সময় নয়! এই পরিযায়ী শ্রমিকরা বিভিন্ন উৎপাদন এবং নির্মাণক্ষেত্রে যত পরিষেবা দেন, তা আচমকা বন্ধ হয়ে গেলে লকডাউনের পর অর্থনীতির চাকা গড়াবে তো? বিনামূল্যে রেশন এবং ১০০ দিনের কাজ কিন্তু তাতে ইন্ধন জোগাতে পারে। ছেড়ে যেতে পারে কাজের অভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস। যা বন্ধ করা অসম্ভব বলে জানিয়ে দিয়েছে খোদ সুপ্রিম কোর্টও। কিন্তু সেটাই সম্ভব হয়ে যাবে না তো? অদূর অভিষ্যতে? তখন কিন্তু আর কোনও সুদূরমেয়াদি পরিকল্পনা খাটবে না। মানুষ বেঁচে থাকে আজ, কাল এবং প্রতিদিন। বর্তমানকে সুনিশ্চিত না করে ভবিষ্যতের ইমারত গড়া যায় না।
হয় সেটা অবাস্তববোধ, না হলে দেশের সঙ্গে প্রতারণা।