প্রণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। কারও কথায় মর্মাহত হতে হবে। ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কর্মে সুনাম ... বিশদ
রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল, থালাবাসন, ঘণ্টা বাজিয়ে হাততালি দিতে হবে এবং আর একদিন প্রদীপ জ্বালাতে হবে। কোথায়? ব্যালকনিতে অথবা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। তার মানে হল, রাষ্ট্রের ধারণা সকলের বাড়ি আছে, ব্যালকনিও আছে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ২০১৫ সালের ১ জুন প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঘোষণা করেছিলেন একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি হল, ‘হাউজিং ফর অল’। ২০২২ সালের মধ্যে সকলের জন্য বাড়ি হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজেও জানে এখন সকলের ঘর নেই। অথচ ব্যালকনিতে যেতে বলছে। রাষ্ট্র নিজের দেওয়া তথ্য নিজেই ভুলে গিয়েছে।
রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল, করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সর্বদাই ঘনঘন রানিং ওয়াটারে হাত ধুতে হবে। ‘রানিং ওয়াটার’ মানে হল, অবশ্যই সেই জলের সাপ্লাই পাইপলাইনে আসতে হবে। পাইপলাইনের জল থাকলেই একমাত্র রানিং ওয়াটারের সুবিধা পাওয়া সম্ভব। সে পাইপলাইন যেমনই হোক। টাইমকল হতে পারে, বেসিনে থাকা ট্যাপ হতে পারে। অথচ রাষ্ট্র ভুলেই গিয়েছে যে, এই বছরের বাজেটেই ভারত সরকারের ঘোষণা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিম, ‘জল জীবন মিশন’। সেই প্রকল্পের লক্ষ্য হল, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি বাড়িতে পাইপলাইনের জল পৌঁছে দেওয়া। তার মানে এখন নেই। অথচ রানিং ওয়াটারে সকলকে হাত ধুতে বলা হচ্ছে।
রাষ্ট্র বলেছিল, রাত ৯টার সময় বাড়ির সব বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দীপ জ্বালাতে হবে। কিন্তু, ‘প্রধানমন্ত্রী সহজ বিজলি, হর ঘর যোজনা সৌভাগ্য’ নামক প্রকল্পের লক্ষ্যই হল, ভারতবর্ষের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। ২০১৫ সালের ‘এনার্জি আউটলুক রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ভারতের ২৪ কোটি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই ওই প্রকল্প নেওয়া হয়। এবং দ্রুতগতিতে সেই কাজ চলছে। গত বছরই ৯৬ শতাংশ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে সরকারি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল। এখনও বাকি আছে কিছু। তাহলে যাদের ঘরে এখনও বিদ্যুৎ নেই, তারা ওই প্রদীপ জ্বালানোর রাত ৯টায় কী করেছিলেন?
‘শ্রমিক স্পেশাল’ ছাড়া যে ট্রেন চালানো শুরু হয়েছে, সেগুলির সবেতেই রাজধানী এক্সপ্রেসের ভাড়া নেওয়া হবে স্থির হয়েছে। আর এখন ট্রেনের টিকিট একমাত্র অনলাইনে কাটা যাবে। কোনও কাউন্টার টিকিট দেওয়া হবে না। অথচ ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে অ্যাকটিভ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫১ লক্ষ। অ্যাকটিভ ইন্টারনেট ইউজার মানে হল, টানা এক মাস যারা নেট ব্যবহার করেছে। তার মানে তো ভারতের সিংহভাগ মানুষের কাছে এখনও ইন্টারনেট নেই। তাহলে তারা টিকিট কাটবে কীভাবে? আর যাদের কাছে রাজধানী এক্সপ্রেসের ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তারা যেতে পারবে না স্বস্থানে।
এই যে এতগুলো উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা হল, এর মাধ্যমে একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট। রাষ্ট্র ক্রমে নিজের অজান্তেই ‘দেশবাসী’ হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে অনলাইন, ডিজিটাল, স্মার্ট সিটি, ব্যালকনি, রাজধানী এক্সপ্রেস, এয়ারপোর্ট ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত শ্রেণীটিকে। অর্থাৎ প্রিভিলেজড ক্লাস। অন্য শ্রেণীগুলির কথা মাঝেমধ্যেই মনে থাকছে না। রাত আটটায় লকডাউন ঘোষণা করে বলা হয়েছিল, আজ রাত ১২টা থেকে সব বন্ধ। লকডাউন ঘোষণার পর দিল্লির করোলবাগ থেকে বিহারের দানাপুরের দিকে হেঁটে রওনা হওয়া একটি শ্রমিক পরিবার আমাকে একটা কথা বলেছিলেন... ‘আমাদের মনে হয় সরকার ভুলে গিয়েছে। তাই সময় দিল না।’ কথাটি আপাত সরল হলেও ভয়ঙ্কর সত্যি হিসেবে পরবর্তী দু’মাসে উপস্থিত হয়েছে। করোনার সংক্রমণের সময় সবথেকে বড় যে উদ্বেগটি সামনে এসেছে সেটি হল, আমরা জানতে পারছি, আমাদের রাষ্ট্র দেশকে সেভাবে চেনে না। তাই একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং তার পরদিনই সেই সিদ্ধান্ত সংশোধন করা হয়। এটা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। কারণ, সমুদ্রে ঝড় উঠেছে এবং তখন যদি জানতে পারি জাহাজের ক্যাপ্টেন সমুদ্রের নেভিগেশনে দক্ষ নয়, প্রাণভয় আরও বেড়ে যায়। আর আঘাত লাগে বিশ্বাসে।
রাষ্ট্র নিজের দেশকে যদি কম জানে, তাহলে যেমন দেশবাসীর কাছে সেটা বেশ ভয়ের কারণ হয়, ঠিক ততটাই রাষ্ট্রের পক্ষে আবার সুবিধাজনক হয়ে যায়, যখন জানা যায় যে, দেশবাসীর একটা বড় অংশও রাষ্ট্র সম্পর্কে কম জানে। প্রশাসন পরিচালনা, সরকারের সিস্টেম, সংবিধানের নিয়মকানুন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মধ্যে সিংহভাগ মানুষের সম্যক জ্ঞান নেই। অথচ আমরা নিরন্তর রাজনীতি এবং প্রশাসন নিয়ে চর্চা করে যাই। অবিরত আলোচনা করে চলেছি কোন দল, কোন নেতা, কোন নেত্রী কী কী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। অথচ আরবান, এলিট, এডুকেটেড এই শহুরে শ্রেণীর আমরা অনেকেই জানি না, একটা পঞ্চায়েত সমিতি কীভাবে চলে। কর্মাধ্যক্ষ, স্থায়ী সমিতি, জেলা পরিকল্পনা বোর্ডের কী কী দায়িত্ব ও অধিকার থাকে। ব্লক উন্নয়ন সমষ্টি অফিসে ঠিক কোন ধরনের সরকারি পরিষেবা পাওয়া যায়। দেশের বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটা ঘোষণা করলেন। সেই ঘোষণার বরাদ্দ প্রকল্প অথবা টাকা ক্রমে নিচুতলায় এসে পৌঁছনোর ঠিক প্রক্রিয়াটা কী? কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে কেন্দ্রকে আমরা অনেকেই মনে করি প্রধান শিক্ষক অথবা উপরওয়ালা। আসলে কী তাই? সংবিধান কী বলছে? কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ঠিক কী কী প্রকল্প আছে, যা আমাদের আশপাশেই সারা বছর ধরে রূপায়ণ করা হচ্ছে অথবা হচ্ছে না? এসব বেসিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিষয়ে আমরা অনেকেই অজ্ঞ। জানার চেষ্টাও করি না। অথচ সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি, দল, নেতা, নেত্রী নিয়ে দিনভর মতামত দিয়ে চলেছি। এই যে জানি না, এটাই রাষ্ট্রের কাছে শক্তি। তারাও খুব খুশি, যাতে না জানি। তাদের শাসন করতে সুবিধা হয়।
২০ লক্ষ কোটি টাকা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই প্যাকেজ ভালো নাকি খারাপ এটা নিয়ে আমাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে। থাকাই স্বাভাবিক। কেউ বলবে, ভালো প্যাকেজ। কেউ বলবে, খারাপ। কিন্তু আমাদের আসল কর্তব্য কী হওয়া উচিত? আমাদের আগামী দিনগুলিতে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করা দরকার, এই প্যাকেজে ঘোষিত প্রকল্প বা অর্থবরাদ্দ সরাসরি আমার কাছে, আমার পরিচিত কারও কাছে কিংবা আমাদের পারিপার্শ্বিকে চেনা অচেনা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট, ব্যবসায়ীদের কাছে, বিভিন্ন অন্য পেশার মানুষের কাছে সত্যিই এসে পৌঁছল কি না। ছ’মাস পর আমাদের ভাবা উচিত, দেখা যাক তো, ওই যে মে মাসে প্রধানমন্ত্রী যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন, তার কী কী সুফল আমার চেনা চৌহদ্দির মানুষরা পেল! কিংবা কারা পেল না। আমার কী সুবিধা হল? প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাঙ্ক অথবা আর্থিক সংস্থাগুলি কি নির্বিঘ্নে লোন দিচ্ছে? নাকি দিচ্ছে না! সেসব তথ্য কি আমরা খুঁটিয়ে যাচাই করব? যদি করি, সেটা রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক হবে। রাষ্ট্র বা সরকার চাইবে না, আমরা ওসব করি। তাই এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা রাষ্ট্র, যে কোনও সরকার, যে কোনও দলকে প্রতিনিয়ত যাচাই করব কি না? তীক্ষ্ণভাবে বিচার করব কি না? নাকি ওইসব দল ও রাষ্ট্রের নিছক ক্রীতদাস হব? তারা যখন যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তাদের ‘আনপেইড আর্মি’ হিসেবে তাদের পক্ষের যোদ্ধা হিসেবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ব? নাকি নিজেদের বিবেচনা, বিচারবুদ্ধি দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব? একথা কেন উঠছে? কারণ, করোনা ভাইরাসের এই লকডাউন পর্ব আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে, প্রত্যেক মানুষের লড়াইটা আসলে একান্তই তাঁর নিজের। সেখানে কারও সহায়তা পাওয়া যায় না। কারও আয় কমছে, কারও চাকরি চলে যাচ্ছে, কারও জীবিকা স্তব্ধ, কারও পেশা অনিশ্চিত, কারও শিক্ষা পিছিয়ে গেল, কারও কেরিয়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন। এমতাবস্থায় কাকে পাচ্ছি পাশে সহায়তার জন্য? যাচাই করতে হবে না? সত্যিই কি সেই সাহায্য কার্যকরী হচ্ছে আমার জীবনে? জানতে হবে না নিরপেক্ষভাবে?
প্রধানমন্ত্রী ‘আত্মনির্ভরশীল’ শব্দটি যেদিন ব্যবহার করেছিলেন, তার কয়েকদিন আগেই শকুন্তলা নামে এক ৩০ বছরের গরিব মহিলা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কাকে বলে আত্মনির্ভরশীলতা। মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার উচ্ছারা গ্রামে ফিরছিলেন শকুন্তলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে। হেঁটে হেঁটে। মোট ১৭ জনের দল ছিল। সেই দলে শকুন্তলা ছিলেন ৯ মাসের গর্ভবতী। তাঁরা সকলেই নাসিকে কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে গিয়েছিলেন। হ্যাঁ, শকুন্তলাও। লকডাউন হয়ে যাওয়ায় টাকা শেষ, খাবার নেই। এমতাবস্থায় প্রায় ৮১ কিলোমিটার হাঁটার পর আগ্রা-মুম্বই হাইওয়েতে প্রসব যন্ত্রণা ওঠে শকুন্তলার। তিনি রাস্তার পাশে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ২ ঘণ্টা শুয়ে থাকেন একটি গাছের নীচে। তারপর ফের হাঁটা শুরু করেন। সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে। খালি পা। সন্তান প্রসবের ২ ঘণ্টা পর থেকে আবার ১৬০ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন তিনি। মহারাষ্ট্র-মধ্যপ্রদেশ বর্ডার বিজাসন চেক পোস্টে পৌঁছনোর পর পুলিস ইনসপেক্টর কবিতা কানেশ দৃশ্যটি দেখে ও ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান! পুলিস এরপর গাড়িতে করে তাঁদের গ্রামে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। শকুন্তলা আর তাঁর স্বামী রাকেশ কাউলের সঙ্গে ছিল তাঁদের ১১ বছরের মেয়ে। পরে পুলিস অফিসাররা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যখন এই দলটিকে জল ও খাবার দিয়েছিলেন তাঁরা, তখন সেগুলির থেকেও অনেক বেশি খুশি হয়েছিল ওই ১১ বছরের মেয়েটি... অন্য একটি উপহার পেয়ে। হাওয়াই চটি! সে নাকি চটিটা পরে প্রথমেই আনন্দে লাফিয়ে উঠে একটা জাম্প দিয়েছিল! এদের কথা আগামীদিনে রাষ্ট্রের মনে থাকবে তো?