প্রণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। কারও কথায় মর্মাহত হতে হবে। ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কর্মে সুনাম ... বিশদ
সেদিন হন্তদন্ত হয়ে হবুর রাজপ্রসাদে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা খেলেন গবু। রক্ষীরা বললেন, ‘সরাসরি মহারাজার সঙ্গে দেখা করা যাবে না।’ গবু মুখের মাস্কটা ঠিক করতে করতে বললেন, ‘কেন হে, আমার তো সব ছাড়পত্র নেওয়াই আছে।’ তবু রক্ষীরা ছাড়ল না। কপালের উপর বন্দুকের মতো যন্ত্রটা ধরে থার্মাল স্ক্রিনিং করল। তারপর একটা যন্ত্রের ভিতর ঢুকিয়ে সব জীবাণু মারার কাজ হল। এরপর একটা পিপিই পরিয়ে একেবারে বাইরের একটা ভিজিটর রুমের ভিতরে কাচের ঘরে ঢুকিয়ে দিল রক্ষীরা। উফফ, প্রটোকলের কী ধকল রে বাবা! সেখানে বসে সামনের ভিডিও স্ক্রিনের মধ্য দিয়ে গবু কথা বললেন হবুর সঙ্গে।
প্রথম চোটেই গবুকে মুখঝামটা খেতে হল। ‘কোথায় থাকো?’
গবু একটু নরম হয়ে বললেন, ‘আমি তো কাজের মধ্যেই আছি মহারাজ।’
হবু বললেন, ‘তুমি কেমন কাজ করছ, তা সারা দেশের লোক জানে।’ মহামারীর ভয়ে ঘরে ঢুকে ডরপোকের মতো বসে আছো, আর ছেলের সঙ্গে লুডো খেলছ।’ গবু বিনীত হয়ে বললেন, ‘কী যে বলেন মহারাজ!’
হবু বললেন, ‘তুমি কিছুই জানো না। শুনেছি, কোন দেশের এক রাজা বাইরে বেরতেনই না, তিনি নাকি মারা গিয়েছেন বলে প্রচার হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে আছেন প্রমাণ করার জন্য তাঁকে বেরতে হয়েছে। এখন দেখছি, তুমি যে সুস্থ আছো, সেটা প্রমাণ করার জন্যই তোমাকে মানুষের কাছে মুখ দেখাতে হবে। রাজ্যের মানুষ মরছে। প্রজারা মনে করছে, রাজা ও মন্ত্রীর দিশাহারা অবস্থা। চারিদিকে প্রজারা আমাদের নামে কেমন সব আলঙ্কারিক স্ল্যাং ব্যবহার করছে একবার দেখে এসো।’
গবু একটু বাহাদুরি পাওয়ার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, ‘সব মিটে যেতে দিন, আবার আমাদের শান্তিবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেব। দেখবেন, ওরা সব ঠিক করে দেবে।’
হবু বলেন, ‘গবু, চিরকালই তুমি উগ্রচণ্ড। তোমাকে সামলাতেই আমার সময় নষ্ট হয়। তুমি শুধু বিরলকেশ ব্যক্তি নও, বিরল বুদ্ধি সম্পন্নও বটে। তা বল, আজ হঠাৎ তোমার আগমনের হেতু কী?’
গবু বললেন, ‘মহারাজ, আমাদের গুপ্তচর খবর এনেছে, মহামারীর সময় সারা দেশে বহু মানুষ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। ওদের জন্য কেন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি, তা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলছে। বহু মানুষ মারাও গিয়েছে। কেউ গাড়ি চাপা পড়ে, কেউ ট্রেনে কাটা পড়ে।’
হবু বললেন, ‘আমি জানি। আমি একদিন হেলিকপ্টারে চড়ে দেখে এসেছি মানুষের ঘরে ফেরা। আচ্ছা, যারা মারা গিয়েছে, তারা কারা?’
গবু বললেন, ‘ওরা শূদ্র বর্ণের। তেমন কেউকেটা নয়। এখন কিছু অর্থমূল্য ধরে দিলেই হবে।’
হবু বললেন, ‘রাজনীতিটা তোমাকে আরও শিখতে হবে গবু। যাদের জীবনের মূল্য অল্প, তাদের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের মূল্য একটু বেশি ধরতে হয়। না হলে তার পরিবারের আনুগত্য নষ্ট হয়ে যাবে যে। ওদের ভোটটাকে অহেতুক নষ্ট করে লাভ আছে? তুমি ওদের পরিবারকে ত্রাণ তহবিলের টাকা থেকে বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। বেঁচে থাকার সময় পাশে নাও থাকতে পারি। মৃত্যুর পরে ওই ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা যেন মৃত্যুর থেকেও ভারী হয়, সেটা দেখা দরকার। ওই টাকাটাই তো শোক মোক্ষণের অস্ত্র।’
গবু গদগদ হয়ে বললেন, ‘ঠিক, ঠিক।’
হবু বললেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে হেলিকপ্টরে চড়ে দেখতে গিয়েছিলাম। কী সুন্দর দৃশ্য! আগে বন্যার দৃশ্য হেলিকপ্টারে চড়ে দেখেছি। দারুণ লাগে দেখতে। একটা রোমান্টিক ফিলিং হয়। এবারও হল। সারবদ্ধভাবে মানুষ যাচ্ছে। কখনও রাজপথের উপর দিয়ে, কখনও রেল লাইনের উপর দিয়ে, কখনও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। রঙিন শুঁয়োপোকার মতো দেখতে লাগছিল। মনে হচ্ছিল ওরা বুঝি উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছে। আমার কপ্টার যখন ওদের মাথার উপর ঘুরছে, তখন ওরা মাথার উপর হাত তুলে ‘রুটি রুটি’ করে চেঁচাচ্ছিল। উফফ, কী দারুণ দৃশ্য সেটা! আমি ভাবলাম ওরা তো আমাদের ভোটদেবতা। দেবতাকে মানুষ তো ফুলই দেয়। আমি তাই হেলিকপ্টার থেকে অনেক ফুল ওদের উপর ছড়িয়ে দিলাম। ওরা বীর। ওদের সংবর্ধনা দেওয়া দরকার। আর ফিরে আসার পর লিখে ফেললাম একটা কবিতাও। একদিন আমার কথায় বাজিয়েছিলে থালা, আজ নাওগো ভোটদেবতা রঙিন ফুলের মালা।’
গবু হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘অসাধারণ। আপনার রাজকবিদের ওই চচ্চড়ি মার্কা কবিতার থেকে এটা অনেক সুন্দর। আর কয়েকটা লাইন জুড়ে দিন। আপনার লেখা কবিতা আমরা দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ব্যবহার করব। কিন্তু মহারাজ, আপনার তো কবিতা লেখার অসুখ ছিল না। আপনি তো একজন যোদ্দা। চারিদিকে যুদ্দুর গন্ধ ছড়ালে তবেই আপনার বীরত্ব প্রকাশ পায়। আপনি কবিতা লিখে ফেললেন!’
হবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি যুদ্দুটাকেও একটা কবিতার মতো করে ব্যবহার করি। এমন যুদ্দু যুদ্দু করি, যে দেশের মানুষও সেই যুদ্দুবাজির মধ্যেও কবিতার ছন্দ খুঁজে পায়। দেশপ্রেমের ছন্দ। এসব শেখা তোমার এ জন্মে হবে না গবু। আমার ছায়ায় আছো বলে, রাজভোগ খেতে পাচ্ছো। নাহলে, মুটে মজুরিও জুটত না।’ গবু হেঁ হেঁ করে উঠলেন। হবু বললেন, ‘যাকগে, এবার একটু রাজ্যশাসন আর প্রজাপালন নিয়ে কথা হোক।’
গবু বললেন, ‘মহারাজ, অনেকেই বলছেন, দেশের এই মহামারীর সঙ্কটকালে আপনি নাকি ব্যর্থ। বলতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে, তবু বললাম। কেননা আমাদের একটা নীতি প্রণয়ন করা দরকার।’
হবু বললেন, ‘আমার নীতি-প্রণয়ন হয়ে গিয়েছে। তুমি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে সুকৌশলে চারিদিকে ছড়িয়ে দাও এক বার্তা। সেটা হল, এই যে মহামারী বাড়ছে, এর জন্য দায়ী আমাদের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, উপরাজ্যগুলি। ওইসব অঙ্গরাজ্যের শাসকদের ব্যর্থতার জন্যই মহামারী বাড়ছে। বারবার এই বার্তা শুনিয়ে যেতে হবে।’
গবু বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ, ওরা তো আমাদের নির্দেশিকা মেনেই কাজ করছে। তারপরেও মহামারী ক্রমেই ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।’
হবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘শীর্ষাসনে বসলে শুধু কাজ করলেই হয় না। কাজে ভুল থাকলে সেটাকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলাটাও একটা রাজনীতি গবু।’
গবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘তার মানে আমাদের নিজেকে সব সময় স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার হয়ে সমালোচনার জীবাণু সাফ করে ফেলতে হবে।’
হবু বললেন, ‘ঠিক।’ গবু বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ যেভাবে নানা বিষয়ে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে, তাতে একটা বিকল্প ভাবনা ভেবে রাখতেই হবে। মহামারী ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতি প্রায় ডুবন্ত, দেশের মানুষ ঘরবন্দি, তাদের পেটে খাবার নেই। পকেটে পয়সা নেই। ক্ষুধার্ত মানুষ সব থেকে ভয়ঙ্কর। যে কোনও সময় ওরা রাজবাড়ি আক্রমণ করতে পারে। আমাদের গুপ্তচররা সেরকম খবর এনেছে। আমাদের তাই কিছু একটা ভাবতেই হবে।’
হবু বললেন, ‘আমি ভেবেছি, থালা বাটি বাজানো নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা করলে দেশের মানুষের মন ভালো হতে পারে। ওটাকে তবলা, ঢোলের মর্যাদা দিয়ে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যাক।’
গবু বললেন, ‘মহারাজা, একদিন যাঁরা থালা বাজিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই মহামারীতে আজ মৃত। তাই ওসব ভাবনা ছাড়ুন।’
হবু বললেন, ‘তাহলে আমার শেষ একটা পরিকল্পনা রয়েছে। রামচন্দ্রকে অনুসরণ করে বনেই চলে যাব। প্রভুর মতো ১৪ বছরের বনবাস। ওঁদের ছিল পিতৃসত্য রক্ষার্থে। আমাদের হবে আত্মরক্ষার্থে। শাস্ত্রেই তো লেখা আছে, পঞ্চাশোর্ধ্ব বনং ব্রজেৎ।’
গবু বললেন, ‘আমার কী হবে মহারাজ?’
হবু বললেন, ‘তুমি তো আমার অনুজ লক্ষ্মণ। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।’
গবু বললেন, ‘মহারাজ, সীতার কী হবে?’
হবু বললেন, ‘আমাদের রামায়ণ সীতাহীন রে ভাই! ভালোই হবে। সীতা না থাকায় রাবণের উৎপাতও থাকবে না।’
গবু বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ, জঙ্গলে অনেক শূর্পনখার দেখা মিলতে পারে।’
হবু বললেন, ‘তা মিলুক। তুমি যেন আবার বোকামি করে তাদের নাক কেটে দিও না।’
গবু বললেন, ‘না মহারাজ, আমি অত বোকা নই।’
দুজনেই হেসে উঠলেন, ‘হেঁ হেঁ হেঁ।’