প্রণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। কারও কথায় মর্মাহত হতে হবে। ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কর্মে সুনাম ... বিশদ
করোনা মানুষের চাহিদাটাকেও আমূল বদলে দিয়েছে। গত দু’মাস ধরে চাল-গম-আটা-আলু-তেল-সব্জি ছাড়া আর কিছু কেনার জন্য মানুষ কি খুব একটা বাজারে গিয়েছে, মনে হয় না। তাহলে অন্য যেসব সামগ্রীর ব্যবসা করে হাজার হাজার মানুষ পেট ভরায় তাদের কী হবে? রাস্তায় সামান্য কাচের চুড়ি বেচেও সংসার চালায় অনেকে। আইসক্রিমের কাঠের গাড়ি ঠেলে নিয়ে যেতে কাউকে কি দেখা গিয়েছে গত দু’মাসে। কিংবা শেষ বিকেলের সেই শীর্ণ বেলুনওয়ালা, যার অপেক্ষায় জানলায় ঠায় বসে থাকত পাশের বাড়ির ছোট্ট শিশুটি। জানে না আবার কবে জমবে তাদের সেই পসরা। প্রথম সারির এক গাড়ি কোম্পানি বলেছে, এপ্রিল মাসে তাদের একটি গাড়িও বিক্রি হয়নি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর মাসে একটিও গাড়ি বিক্রি না-হওয়ার ঘটনা নাকি এই প্রথম। সব ব্যবসারই এক হাল। আপাতত গ্রাসাচ্ছাদন ছাড়া কেউ কিছু ভাবছে না। বাড়ি, গাড়ি কেনা তো দূর স্বপ্ন! এ জিনিস কতদিন চলবে কেউ জানে না। মানুষের মন থেকে ভয় আর অনিশ্চিয়তা উধাও না হলে যে অন্য কোনও বেচাকেনা শুরুই হবে না, তা বিলক্ষণ জানে ব্যবসায়ীরা।
সবাই দেখছে, এরই মধ্যে টানা তিনদিন ধরে মোদিজির আত্মনির্ভর ভারত গড়ার প্যাকেজ প্রহসন চলছে। কেউ কিচ্ছু পাচ্ছেন না, অথচ নিয়ম করে সাত মণ তেল রোজ বিকেলে পুড়ছে। শুধুই ঋণের দু’শো ফিরিস্তি। প্রথমে ইংরেজিতে বলছেন নির্মলা দেবী। পরক্ষণেই আবার তার হিন্দি অনুবাদ রাষ্ট্রমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের গলায়। কিন্তু চিঁড়ে ভিজছে কি? জনগণের লাভ হচ্ছে কোনও? ব্যবসাই যেখানে নেই, জিডিপি যেখানে শূন্যের দিকে দৌড়চ্ছে সেখানে এত ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা করবে কী? জিএসটি মকুব নিয়ে কোনও কথা নেই। ব্যক্তিগত আয়কর কমানোর কোনও ঘোষণা নেই। পরিযায়ী শ্রমিকদের হাতে নগদ টাকা কোথায়? আর পিএফের কাটা অর্থের পরিমাণ কমিয়ে সাময়িক টেক হোম বাড়লেও আয়করও যে অতিরিক্ত চাপবে, তা কে না জানে? তাহলে এই কঠিন সময়ে ২০ লক্ষ কোটি টাকার এই তিন কিস্তির ফিরিস্তি কেন?
কিন্তু এত সবের মধ্যেও একটা ভাইরাস যে আমাদের মনটাকে গত প্রায় তিন মাসে কেমন অসহায় একাকীত্বে ভরে দিয়েছে, তার খোঁজ কে রাখে? একটা ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা আজ গ্রাস করেছে ধনী দরিদ্র সব অংশের মানুষকে। আজ লকডাউনের প্রায় দু’মাসের মাথায় একটা জিনিস সবার কাছে খুব পরিষ্কার যে, এই মারণ ভাইরাস সহজে যাওয়ার নয়। ভ্যাকসিন আসতে আসতেও বছর ঘুরে যাবে। তাই ক্রমে ক্রমে আমাদের জীবনযাপনের ধারাটাকেই অনেকটা বদলে ফেলতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে। পৃথিবীজুড়ে সেই জীবনধারা বদলেরই প্রক্রিয়া চলছে। হঠাৎ সামনে আসা এই বিপদকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচাই এবার আমাদের সবাইকে শিখতে হবে। কতদিন অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে থাকবে। বাইরে তো এবার বেরতেই হবে। কাজকর্ম আর কতদিন শিকেয় তোলা থাকবে? আর বেশিদিন এমন চললে তো এবার সবার পেটেই টান পড়বে। সবকিছু স্তব্ধ হয়ে থাকলে, রোজগার না হলে বেতন হবে কী করে? সরকার বাহাদুরই যেখানে ডিএ দেড় বছরের জন্য ছেঁটে দিয়েছে, সেখানে সাধারণ আর পাঁচটা সংস্থার কথা না বলাই ভালো।
সীমান্তে যে জওয়ান শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় তাকে তার জীবনধারাটাকেই বদলে ফেলতে হয়। ২৪ ঘণ্টা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, পিঠে ভারী মেশিন গান, মাথায় আধুনিক হেলমেট আরও কত কী। এবার করোনাও আমাদের শেখাল, রাস্তায় মানে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার আগে মাস্ক, ফেস শিল্ড, ভালো গ্লাভস, বারবার বাইরে হাত ধোয়ার জন্য সাবান, স্যানিটাইজার সব সময় কাছে রাখতে হবে। আর ঘনিষ্ঠ হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে রাস্তায় চলা যাবে না। পার্কেও গোল হয়ে জড়াজড়ি করে এর নিঃশ্বাস ওর গায়ে লাগে, এমন করে আর বসা যাবে না উৎসবের দিনেও। মাস্ক আর গ্লাভসের আড়ালে লিপস্টিক আর নেলপলিশ শিল্পের কী হবে, তা নিয়েও সংশয় বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় না হলেও ওই শিল্পের উপরও তো বহু মানুষের জীবন-জীবিকা দাঁড়িয়ে। তাদের কী হবে? এখন থেকে উৎসবে পার্বণেও রাস্তায় ভিড় না করে দূরে দূরে থাকার ফরমান আসবে। টহল দেবে পুলিস। আমুদে বাঙালির আড্ডাশিল্পও ফলে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এককথায় মানুষকে আরও একা হতে হবে। পরিবার, সংসার থেকেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। খসে যাবে অনেক শখ আহ্লাদের ঘেরাটোপ। সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিযোগ ছিল, মোবাইল, টিভি, ইন্টানেট মানুষকে একা করে দিচ্ছে। এবার এক অদৃশ্য ভাইরাস মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অছিলায়, সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিল। কে ঠেকাবে এই বিপর্যয়! বাবার মৃতদেহের সঙ্গে ছেলে যেতে পারবে না! মা হাসপাতালে করোনা নিয়ে ভর্তি হলে গোটা পরিবার বিচ্ছিন্ন। গালভরা কোয়ারেন্টাইনে কার্যত নির্বাসিত। পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও যোগ রাখতে পারবে না কেউ। পাশের বাড়ির বিপদেও দু’টো কথা, সমবেদনা জানানো যাবে না। এতবড় সামাজিক সঙ্কট কেউ কোনওদিন দেখেছে? করোনার ছোবল যেমন জীবন কেড়ে নিয়েছে, তেমনি জীবন থেকে গত কয়েক মাসে যাবতীয় রূপ রস গন্ধও কেড়ে নিয়েছে। আবারও বলি, এক ভয়ঙ্কর একাকীত্ব আর হতাশা মনটাকে ভারাক্রান্ত করে দিয়েছে। এই একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া থেকেই যে অ্যালজাইমার, ডিমেনশিয়া, তীব্র হতাশা রোগের জন্ম হয়। কারও পাঁচ টাকা আছে না পাঁচ কোটি, তা দেখে তো হতাশা আসে না। ওখানেও ধনী দরিদ্র সব একাকার। যে পরিযায়ী শ্রমিক দু’হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে এসে নিজের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেখছে সবাইকে দু’মুঠো খাওয়ানোর পয়সা নেই, আর যার অনেক আছে অথচ এই লকডাউনে ব্যবসায় ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে মনটা টালমাটাল, দু’জনের মানসিক অবস্থার মধ্যে ফারাক কিন্তু খুব বেশি নেই। দু’জনেই অসহায়। দু’জনের সামনেই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। আর কে না জানে, গরিবের জন্য ত্রাণ আছে। আর ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, কিন্তু মধ্যবিত্ত এই দুয়ের মাঝে পড়ে শেষ। কারণ সহজ শর্তে ঋণ দিতে গিয়ে ফিক্সড ডিপোজিটে সুদ যে ক্রমশ কমছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রবীণরা আরও বেশি করে আতঙ্কিত। কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে করোনার বিপদ যেমন তাঁদের বেশি তেমনি এদেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য কোনও প্যাকেজ হয় না। বোধহয় দেশকে যতটুকু আত্মনির্ভর বানানোর ছিল সেই দায়িত্ব তারা অনেক আগেই সম্পন্ন করেছেন। আর কিছু পাওয়ার নেই তাঁদের কাছ থেকে। তাই প্যাকেজে প্রবীণদের জন্য কোনও সময়ই বিশেষ কিছু থাকে না। উল্টে, শিল্পে সহজ শর্তে ঋণ দিতে ক্রমাগত সুদ কমানোই আজ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিরাপদ দাওয়াই। ফলে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীনও এই অবসরপ্রাপ্তরাই। একের পর এক সরকারি ব্যাঙ্ক পাল্লা দিয়ে সুদ কমাচ্ছে, আর এই কঠিন সময়েও তাই মাসে দু’বার আয় কমছে সুদনির্ভর মানুষদের। বৃদ্ধ বয়সে কারও ছেলেমেয়ে ভিনরাজ্যে তো কারও বিদেশে। দেখার কেউ নেই। সামান্য কটা টাকা আর ফিক্সড ডিপোজিটই সম্বল। বুড়োদের জন্য তো আর প্যাকেজ হয় না। কারণ সবাই জানে স্টিমুলাস দিয়েও ওদের আর জাগানো যাবে না। তাই ক্রমশ আয় কমার দুঃখ বুকে নিয়েই প্রবীণদের চোখের দীপ্তি কমে আসে। আর কিছু হোক ছাই না হোক সরকার বাহাদুরের কাছে একটাই আবেদন, ব্যাঙ্কে সুদ কমলেও আগামী এক-দেড় বছর প্রবীণদের সুদ আর কমবে না বলে অবিলম্বে ঘোষণা করা হোক। তা হলেই ভয়ঙ্কর একা হয়ে যাওয়া অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অন্তত একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন।