কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
মানুষ সব ছাড়তে পারে, অহংকার ছাড়া। অহংকার নিয়েই আমরা ঘুম থেকে উঠি, ঘুমোতে যাই। অহংকার চলে গেলে মানুষ হয়তো আর মানুষ থাকবে না, অন্যকিছু হয়ে যাবে। সুতরাং অহংকারের সুযোগ কেড়ে নিতে নেই। অহংকার অনেকাংশে মোটিভেশন এবং ইনসেনটিভের কাজ করে। নিরুৎসাহ করা আর মানুষকে আচমকা পিছনের দরজা দেখিয়ে দেওয়ার মধ্যে তফাত নেই। তাই নোবেলজয়ীদের তালিকায় অভিজিৎ বিনায়কের নাম জানামাত্রই ভারতবাসী, বিশেষত বাঙালি আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছে। আমাদের কাছে গৌণ তিনি নাগরিক পরিচয়ে মার্কিন না ভারতীয়। আমাদের আনন্দের গর্বের একটাই কারণ তাঁর জন্ম ভারতে, স্কুল থেকে কলেজে পড়াশোনা কলকাতায়। ব্যস। আমরা টিভি খুলে নোবেলের খবরে ডুবে গিয়েছি। নানাবিধ অ্যাপের মাধ্যমে এই বিষয়ে আপডেট নিয়েছি। বাসে ট্রেনে হাসিমুখ আলোচনায় মগ্ন থেকেছি। বাড়িতে গিয়ে ছোট ছেলেমেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভেবেছি, আমাদের সন্তানটাও তো এমন হতে পারে কোনোদিন। হয়তো কেউ কেউ ছেলেমেয়েকে বলেও ফেলেছি, ‘‘চেষ্টা করো তুমিও একদিন এমন হবে।’’ যাঁদের ছেলেমেয়ে সাউথ পয়েন্ট বা প্রেসিডেন্সিতে ভালো রেজাল্ট করে তাঁদের কারও কারও মনে এমন স্বপ্ন কি যে জ্বলে ওঠেনি? এ নিয়ে ছেলেমেয়েকে অন্যায় প্রেশারে না ফেললে অন্যায় তো নয়।
চান্সটা গ্র্যাব করেছে সোশ্যাল মিডিয়াও। একেবারে চনমনে হয়ে উঠেছে অভিজিৎ বিনায়ককে কেন্দ্র করে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির কথা মনে করিয়ে দিয়ে কেউ একজন পোস্ট করেছে এবং বাংলাজুড়ে তা ফরওয়ার্ডও হয়েছে: অভিজিৎ বিনায়কের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘‘মেডেলটা সামলে রেখো বাবা। আমারটা কিন্তু আজও খুঁজে বের করা যায়নি!’’
অন্যদিকে, বাংলা বিজেপির দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ ... শ্রেণীর কিছু নেতা প্রশ্ন তুলেছেন: অভিজিৎ বিনায়কের বাঙালিত্বের পারসেন্টেজ, ভারতীয়ত্ব এবং দাম্পত্যজীবন নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত নিম্নরুচির কাহিনী ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ছিদ্রান্বেষীরা ভুলে যাচ্ছেন যে রাজনীতিতে সুচের চেয়ে চালনের পাল্লাই ভারী! দেশবাসীর কাছে অভিজিৎবাবুর প্রজ্ঞাটুকুই বিবেচ্য, তাঁর হেঁশেলের গন্ধ নয়।
একজন সিনিয়র সেন্ট্রাল মিনিস্টারকে দেখা গেল অভিজিৎবাবুর অর্থনৈতিক চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আক্রমণ করতে। মন্ত্রী মশায় যে ভাষায় তাঁকে কটাক্ষ করলেন তাতে সৌজন্যের অভাবটাই প্রকট হল। সঙ্গে একতরফাভাবে যোগ করলেন, এই অর্থনীতিবিদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা। মন্ত্রী মশায়ের দাবি, অভিজিৎবাবু বামপন্থায় বিশ্বাস করেন। এমনভাবে বললেন, বামপন্থায় বিশ্বাসটা যেন অন্যায়। অন্যদিকে, রাহুল গান্ধীর স্বপ্নের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের সঙ্গে অভিজিৎবাবুর যোগের প্রসঙ্গ টেনে বুঝিয়ে দিলেন—অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আমাদের লোক’ নন। তাঁর আরও বড় অপরাধ হল তিনি মোদি সরকারের নোটি বাতিল সিদ্ধান্তের সমালোচক। এমনকী, ভারতের হালফিল অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়েও তিনি অখুশি। এই সঙ্কট মোকাবিলায় নির্মলা সীতারামনের পদক্ষেপগুলিও তাঁর কাছে আশাপ্রদ নয়। গেরুয়া বাহিনীর একটা অংশ ভাবছে, এই বিরাট মাপের মানুষটির গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে, তাঁকে সংবর্ধিত করে বিজেপির কোনও রাজনৈতিক লাভ নেই। ভাবখানা এই, অতএব, কায়দা করে তাঁকে ‘ওদের লোক’ বা ‘শত্রু’ ঘোষণা করে দেওয়াই যায়। চিহ্নিত শত্রুকে বিলো দ্য বেল্ট হিট করাই বোধহয় শ্রেয়!
এহেন ভারতসন্তানের নোবেল জয়ের সময়টাও অবশ্য বিজেপির কাছে খুব সুবিধের ছিল না। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভা ভোটের উত্তাপ চরমে। যাঁকে বিরোধী ক্যাম্পের লোক ঠাউরে নিয়েছে তাঁর গুরুত্ব স্বীকার করে নেওয়ার মতো মানসিক জোর বিজেপির নেই। যদিও অভিজিৎবাবু নিজেকে কোনও দল বা মতের মানুষ বলে চিহ্নিত করতে রাজি নন। একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি তাঁর কাজটাই ভালো করে করতে চান। যে সরকারই তাঁর পরামর্শ চাইবে কুণ্ঠাহীনভাবে দেবেন। সেখানে মোদি রাহুল মমতায় বৈষম্যের প্রশ্ন নেই।
কোনও এক হতভাগা আবার এর মধ্যে আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামকে টেনে এনে নামিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে বিজ্ঞানী কালাম সাহেবের এক কাল্পনিক বক্তব্য মার্কেটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্যাখ্যা করেছেন কেন তিনি নোবেলজয়ী হতে পারেননি। ওই কাল্পনিক ব্যাখ্যায় অভিজিৎবাবুর দাম্পত্য জীবন এবং ‘অনৈতিক’ মার্কিন নাগরিকত্বের প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রকাশ রয়েছে। শুধু এটাই মনে হচ্ছিল যে কালাম সাহেবের জীবদ্দশায় এই নষ্টামি হলে তিনি মরমে মরে যেতেন। অভিজিৎবাবুকে হেয় করতে গিয়ে কালাম সাহেবকে যে পাঁকে নামিয়েছে তা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। অভিজিৎবাবুকে নিয়ে আকস্মিক এই কুৎসা দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে, নোবেল পুরস্কারলাভটাই তাঁর মস্ত অপরাধ। তা না-হলে হঠাৎ সেদিন থেকে তিনি একটি বিশেষ রাজনৈতিক ভাবনার ট্রোল আর্মির লক্ষ্য হয়ে উঠবেন কেন? অভিজিৎবাবু তো সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। দেশে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তিনি প্রবাসী হয়েছেন কয়েক দশক হল। গবেষণা করছেন, বই লিখেছেন, একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এমনকী নোট বাতিল পর্বে এবং গত লোকসভার ভোটেও তাঁর পরোক্ষ উপস্থিতি ছিল। তখনও এঁরা তাঁকে কাউন্ট করেননি। কিন্তু এবার অর্গানাইজড অ্যাটাকের মুখে ফেলা হয়েছে তাঁকে। অনুমান করা যায় যে, আক্রমণকারীরা ধরে নিচ্ছে যে অভিজিৎবাবুর কথা এবার মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে। অতএব বিড়াল প্রথম রাতেই মেরে দাও। মানুষটিকে নস্যাৎ, এমনকী কলঙ্কিতও করে দাও। মহান ভারতে ‘ক্যারেক্টার’ এবং ‘দেশপ্রেম’ সবসময় ডিভিডেন্ড দেয়।
বাংলায় এবং দিল্লিতে বিজেপির একটি অংশ যেভাবে প্রকাশ্যে অভিজিৎবাবুর কুৎসায় কুণ্ঠাহীন হয়ে উঠেছেন তার সঙ্গে কালাম সাহেবের কাল্পনিক খেদের মিল স্পষ্ট হচ্ছে। সন্দেহ জোরদার হচ্ছে যে নোংরামির পুরোটাই একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরিতে ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। গত লোকসভার ভোট এবং আরও একাধিক রাজ্য বিধানসভার ভোটের আগেও এমন সংগঠিত আক্রমণ সচেতন দেশবাসীর নজরে এড়ায়নি। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট ট্রাডিশনাল মিডিয়াকে ছাপিয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাই সম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তিমাত্রই সোশ্যাল মিডিয়ায় কর্তৃত্ব করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেখানে গেরুয়া শিবির যে বিরাট দখলদারি কায়েম করেছে তা নিয়ে বাকি দলগুলি শঙ্কিত।
আবার নোবেল প্রসঙ্গ। আমরা আজও স্বপ্ন দেখি, আবার কোনও একজন ভারতীয় সাহিত্যিকের হাতে নোবেল প্রাইজ উঠেছে। তিনি বাঙালি হলে সবচেয়ে খুশি হব। সাহিত্যে নোবেলের জন্য ফের যে ভারতীয়ের নাম ভেসে উঠেছিল তিনিও এক বঙ্গসন্তান। ঋষি অরবিন্দ। ১৯৪৩ ও ১৯৫০ সাল, দু’-দু’বার মনোনয়ন পেয়েও পুরস্কৃত হননি। ১৯১৩ থেকে প্রতীক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। অবশেষে ২০০১-এ সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ উঠল বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নইপালের হাতে। ইংরেজি ভাষার এই সাহিত্যিককে পৃথিবী ভি এস নইপাল নামে চেনে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। জন্ম তাঁর ত্রিনিদাদে। আমরা, ভারতের সাহিত্যপ্রেমীরা তাঁকে নিয়েও আহ্লাদিত হলাম। কিন্তু কেন? কারণ তাঁর নামটা শুনলে একটা আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি ভারত বংশোদ্ভব। একইসঙ্গে আমরা আক্ষেপ করি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের মধ্যে কেউই নোবেল পুরস্কার পাননি বলে। আমাদের আক্ষেপ গান্ধীজির মতো ব্যক্তিত্বের হাতে নোবেল শান্তি ওঠেনি। অথচ, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি মোট পাঁচ বার তিনি নমিনেশন পেয়েছিলেন। সি ভি রমন (১৯৩০) এবং মাদার টেরেসার (১৯৭৯) নোবেল নিয়েও বাঙালি গর্বিত—তাঁদের সঙ্গে কলকাতার কানেকশন খুঁজে নিয়ে। হরগোবিন্দ খোরানা (১৯৬৮), সুব্রামনিয়ান চন্দ্রশেখর (১৯৮৩), বেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন (২০০৯), কৈলাস সত্যার্থী (২০১৪) আমাদের আত্মশ্লাঘার কারণ হয়ে ওঠেন এই জন্য যে, তাঁরা ভারতীয় অথবা ভারত বংশোদ্ভব।
সর্বক্ষণ লতায় পাতায় অহং খুঁজে বেড়াচ্ছে যে জাতি সেই বাঙালি অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গর্ব করবে না তো কি? তাঁদের যারা হেয় করছে তাদের সম্পর্কেই বাঙালির মনোভাব খারাপ হচ্ছে। ভারত আজও মানে, বিদ্বানই সর্বত্র পূজনীয়, কোনও রাজা (আজকের দিনে রাষ্ট্রনেতা) নন, তিনি যত বড়ই হোন। বরং রাজভক্তি আজ দেশের গণ্ডিতেও প্রশ্নের মুখে। গেরুয়া শিবিরের পক্ষে সুখের কথা এই, অন্তত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সত্যটি উপলব্ধি করেছেন। মঙ্গলবার দিল্লিতে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন নোবেলজয়ী অভিজিৎবাবুর সঙ্গে। তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ২০২১-এর যুদ্ধটাকে সিরিয়াসলি নিলে এত বড় ব্লান্ডার রিপেয়ার করা ছাড়া গেরুয়া শিবিরের উপায়ও হয়তো ছিল না।