কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
বাংলাদেশ কেবল ভৌগোলিক দিক থেকে ভারতের পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বারই নয়, বরং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হৃদয় নৈকট্যের কারণ সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে এই সম্পর্কের রসায়ন ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সড়ক, জলপথে যোগাযোগ, রেলপথ ছাড়াও জয়েন্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্ট, জল সম্পদ বণ্টন, এনার্জি সিকিউরিটি—এই সবদিক থেকে বাংলাদেশের যেমন বিশেষ প্রত্যাশা রয়েছে, তেমনি ভারতও চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলিকে আরও প্রসারিত করতে। সুতরাং উভয়ের সম্পর্কের এই পারস্পরিক উত্তাপ ও পরিপূরকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দরুন বাংলাদেশ হয়তো ভারতের থেকে যা প্রত্যাশা করে তা নৈকট্যের কারণে লেনদেন করা সুবিধাজনক ও লাভজনক হলেও, তারা অন্য কোনও রাষ্ট্রের থেকেও অনুরূপ সাহায্য হয়তো পেতেই পারে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বেশ কিছু ইউনিক সুবিধে রয়েছে, বেশ কিছু ধাপ রয়েছে যাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন। নবীন ও ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বলে তাকে উপেক্ষা করা একেবারেই অনুচিত। তবে বাংলাদেশকে আমরা কতটা তাৎপর্যের সঙ্গে গ্রহণ করব, তার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার মূল নীতি কী হবে বা বৃহত্তর কোনও ইস্যুভিত্তিক ফর্মুলা আমরা নেব কি না, তার সুচিন্তিত ফ্রেম-ওয়ার্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রথমত, ভারত মনে করে বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রত্যক্ষ সমীকরণ থাকাই বাঞ্ছনীয়। তার মধ্যে তৃতীয় শক্তির অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। যেমন ফারাক্কা ব্যারেজের জলধারণ বাড়াতে গিয়ে ভারত যখন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ফিডার খাল বানানোর কথা বলে তখন তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে নেপালকেও এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করে জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেয়, ভারত যাতে প্রাথমিকভাবে গররাজি ছিল। এখান থেকে স্পষ্ট বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত কোনও তৃতীয় শক্তি বা বহুপাক্ষিক ফ্রেমওয়ার্ক, আন্তর্জাতিক কোনও ফোরামের মধ্য দিয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না। অবশ্য বর্তমানে আমরা দেখছি ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার আঞ্চলিক নেতৃত্বের স্বার্থে বিমস্টেক ও বিবিআইএন-কে সক্রিয় করতে চাইছে। বলা বাহুল্য, এর জন্য বাংলাদেশের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর মোদি হাসিনার হাত ধরেই দুপক্ষই ঐতিহাসিক ছিটমহল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যাতে ভারতীয় পার্লামেন্ট শততম সংবিধান সংশোধন হিসেবে সিলমোহর দেয়। তবে এখনও নিউম্যুর দ্বীপ, কয়েকটি চর নিয়ে উভয়ের মধ্যে দাবি ও পাল্টা দাবির অমীমাংসিত বিতর্ক রয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত জমি ও জলাভূমি অধ্যুষিত যে সীমানা রয়েছে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এই নিয়ে অতীতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ স্থিতাবস্থা রক্ষার পক্ষপাতী। তবে ভারতে বেশ কতকগুলি মারাত্মক নাশকতার ছক যেমন ২০০২ সালে কলকাতার মার্কিন সেন্টারে জঙ্গি হামলা, ২০১৪ বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জঙ্গি নাশকতামূলক কার্যকলাপের যে ছক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে উঠে আসে তাতে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের হুজি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে পাক জয়েশ ও লস্করের গোপন আঁতাঁত রয়েছে। ফলে ভারত বাংলাদেশকে এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি ভারতের কিছু অংশে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিংসার কিছু ঘটনা বাংলাদেশের জনমানসে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তবে এই উদ্বেগ যে অমূলক তা বলাই যায়, কারণ অতীতে আমরা যেমন দেখেছি তেমনি বর্তমানেও আমরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি ভারত শক্তিশালী, ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাছাড়া মোদি সরকার যেহেতু সুদৃঢ় রাজনৈতিক সমর্থনের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা রোধে সরকার যে পিছপা হবে না তা বলাই যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রে এনডিএ সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের শততম দিন উদ্যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর ভারতের 'Neighbourhood First'—নীতির যে দুটি উপাদানের কথা বলেন তার মধ্যে একটি হল বাংলাদেশের মতো প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে একতরফা সুবিধে দেওয়া। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ভারতের থেকে একগুচ্ছ বাণিজ্যিক ছাড় পেয়ে থাকে, যা চটজাত দ্রব্য, ইলেকট্রনিক পণ্য, খাদ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ছোট প্রতিবেশী বলে বাংলাদেশের যে আবদার তাও যতটা সম্ভব মেটানোর নৈতিক দায় ভারতের উপর বর্তায়। দুঁদে কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবের মতে, সামঞ্জস্যের প্রত্যাশা না করেও যদি এক্ষেত্রে ভারতকে তার স্বার্থ সামান্য বিসর্জন দিতেও হয় তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ স্থিরতা ভারতের সুরক্ষা তথা শক্তিকেই সুনিশ্চিত করবে। সুতরাং ভারতের উচিত অর্থনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যথাসম্ভব তালমিল রেখে কাজ করা। এই তালমিল যে নেই তার বড় প্রমাণ সম্প্রতি ভারতে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশ সঙ্কটে পড়ে, যা নিয়ে হাসিনা ভারত বাংলাদেশ বাণিজ্য ফোরামে ক্ষোভ গোপন করেননি।
কিন্তু সামগ্রিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে দশ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য হয়েছে। তথাপি একথা বলা যাবে না যে উভয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পূর্ণমাত্রায় পৌঁছেছে। কারণ উভয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখনও বাজারের চাহিদামতো গড়ে উঠেছে। উভয় তরফে আর্থিক যোগসূত্র যদিও ঘোষণা ও চুক্তির পর্যায়ে রয়েছে, তথাপি বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের পক্ষে ক্রমশ শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে। যদিও কেবলমাত্র ভারত নয়, এমনকী চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের বড় রকমের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
তথাপি এক্ষেত্রে একটা মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে, তা হল বাংলাদেশে প্রচুর চীনা পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে। সেই তুলনায় ভারতের বিনিয়োগ আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। তাই এবারের সফরে শেখ হাসিনার মুখে আমরা বাংলাদেশে ভারতীয় পুঁজি বিনিয়োগের আহ্বানের কথা শুনেছি। বিশ্বায়নের ডাকে সাড়া দিয়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি গতি লাভ করলেও, একথা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তিগতভাবে বিদেশি বিনিয়োগের নিরিখে ক্রয়ক্ষমতা ও মুদ্রার বিনিময় মূল্যের মতো সূচকের দিক থেকে ভারতের তুলনায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে একতরফা ছাড় দিলেও ভারতের উপরে তার বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেমন বাংলাদেশে জামদানি শাড়ির উপর ভারত শুল্ক ও কোটা আরোপ করায় রপ্তানি যখন আশানুরূপ বাড়েনি, তখন সেইসব বাধানিষেধ ভারতের তরফ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, যদিও ক্রমঅভিজ্ঞতায় ভারত বুঝেছে যে, প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে সবসময় স্নেহপরবশ হয়ে হাত উপুড় করাটাও অনুচিত।
তাই পরের দিকে ভারত মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির ফ্রেমওয়ার্কে থেকে রফা করতে চেয়েছে। অন্যদিকে কয়েকবছর যাবৎ বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহণের সুবিধা পাচ্ছে ভারতীয় যানবাহন। তাহলে কি ধরে নেব ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কাঙ্ক্ষিত বিন্দুতে আমরা পৌঁছে গিয়েছি? এর উত্তর নিহিত রয়েছে উভয়ের ঐতিহাসিক যোগসূত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। যেমন বাংলাদেশ মনে করে ভারতের থেকে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
অন্যদিকে চীনের উপর নজরদারি চালাতে এবং ভারত-ভুটানের বাণিজ্যের সুবিধার্থে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেতে চলেছে ভারত। সেই সঙ্গে সিসেলস, মালদ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপপুঞ্জে ভারতের যে রেডার প্রযুক্তি রয়েছে অনুরূপ প্রযুক্তি ভারত বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলেও ইনস্টল করতে পারবে—এমন ছাড়পত্র মিলেছে। তবে অস্বস্তির কারণ তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি। সেইসঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ইচ্ছামতো ভারত সরকার এখনই মায়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় না। তাছাড়া নাগরিক পঞ্জির বিষয়েও ভারত কোনও সুনির্দিষ্ট আশ্বাস বাংলাদেশকে দিতে চায়নি কারণ এটি তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবু নয় নয় করে শেখ হাসিনার এই সফরে দিল্লি-ঢাকা উড়ান পথে যোগাযোগ বাড়ানো, পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সাইবার-নিরাপত্তার মতো বহুবিধ বিষয়ে সম্পর্কের যে নাড়াবাঁধা হল, তাও এককথায় কম কী?
লেখক অধিকর্তা, অতীশ দীপঙ্কর, শ্রীজ্ঞান সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়