কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
বর্ধমান শহরে প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিসের তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। বলেছিলেন, শুনছি, কলকাতায় দিতে হয় বলে অনেকে নাকি টাকা নিচ্ছে। একটা কথা জেনে রাখুন, পার্টির কাউকে টাকা দিতে হয় না। আপনারা কাউকে টাকা দেবেন না। এখন প্রশ্নটা হল, মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ এমন কথা বলতে গেলেন কেন?
অনেকেই বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী ঠাট্টার ছলে ‘তোলা আদায়ে’র প্রসঙ্গ তুলে পুলিস ও জনগণকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন। যেভাবে কাটমানির প্রসঙ্গ তুলে দলের দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবে পুলিসের বিরুদ্ধেও। কারণ লোকসভা ভোটে এরাজ্যে শাসক দলের ভরাডুবির পিছনে পুলিসের ভূমিকাও একটা ফ্যাক্টর। সম্ভবত ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি সূত্রে তিনি জানতে পেরেছেন, পুলিসের জন্যই বহু মানুষ, বিশেষ করে পরিবহণ ব্যবসায় যুক্ত অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে চালু করা হল ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’। দুর্ঘটনায় আঘাতের জেরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার পরিণতি মৃত্যু। অকাল মৃত্যু ঠেকাতে হেলমেট পরায় কড়াকড়ি। অসাধারণ উদ্যোগ। কিন্তু, এমন একটা উদ্যোগকে সামনে রেখে শুরু হয়ে গেল ‘তোলা’ আদায়। একটা অসাধারণ উদ্যোগ পুলিসের সৌজন্যে হয়ে গেল মানুষের বিরক্তির কারণ। জোরজবরদস্তির ফলে যেভাবে প্রয়াত সঞ্জয় গান্ধীর ‘পরিবার পরিকল্পনা’ কর্মসূচি কংগ্রেসের ব্যুমেরাং হয়েছিল, অনেকটা তেমনই।
বিষয়টা একটু খোলসা করে বলা যাক। মালদহ জেলার পুরাতন মালদহ থানায় সাহাপুরে পিচ রাস্তার ধারে গোপেন মণ্ডলের চায়ের দোকানে সন্ধ্যার পর জোরদার আড্ডা বসে। যাঁরা আড্ডা দেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই পেশা দুধ ও ছানা বিক্রি। এই সাহাপুরের চককাদিপুরে অনেকে মৌমাছির ব্যবসাও করেন। মৌমাছি বাক্সয় ভরে কলকাতার আশপাশের জেলায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। গোপেনবাবুর দোকানে তাঁদেরও আড্ডা। সেখানে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতেই উপস্থিত প্রায় সকলেরই টার্গেট পুলিস।
মনোজ সাহা বলেন, এখানে প্রচুর মৌমাছির চাষ হয়। মৌমাছির বাক্স কলকাতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিসকে গাড়ি পিছু প্রচুর টাকা দিতে হয়। তাতে লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে নেয়। শুনলে অবাক হবেন, একটা গাড়ির জন্য পুলিসকে দিতে হাজার চারেক টাকা চলে যায়। টাকা না দিলে গাড়ি আটকে দেবে। গাড়ি আটকালেই সর্বনাশ। কারণ দিনের আলো ফুটলেই মৌমাছি পালাবে। তখন সবটাই লোকসান।
বৃদ্ধ মণ্টু ঘোষের গলার ঝাঁজ শুনে বোঝা যাবে না বয়স ৭০ পেরিয়েছে অনেক আগেই। বলেন, মশাই, আমরা দুধ, ছানা বিক্রি করে সংসার চালাই। সেটাও পুলিসের জন্য ভালোভাবে করতে পারছি না। ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফে’র চক্করে পড়ে আমাদের লাইফটাই ‘হেল’ হতে বসেছে। সামনে বাইপাস ব্রিজের কাছে পুলিস ক্যাম্প করে বসে থাকে। চোর, মস্তান সামনে দিয়ে গেলেও তাদের হেলদোল থাকে না, কিন্তু দুধ-ছানা নিয়ে গেলেই বাইক দাঁড় করাবেই। প্রথমেই চাইবে, ধোঁয়ার কাগজ। মানে পলিউশন সার্টিফিকেট। কারণ গ্রামে বেশিরভাগই পলিউশন টেস্ট করান না। ধোঁয়ার কাগজ না থাকলেই ফাইন। তবে, ২০০ টাকা হাতে গুঁজে দিলে ছাড়। আর হেলমেট না থাকলে তো পোয়া বারো। তখন কাগজপত্র না দেখেই হাত বাড়িয়ে দেবে। যা অবস্থা, এবার হয়তো হেলমেট পরে গোরু দুইতে যেতে হবে। পুলিসি জুলুমবাজি চললে মানুষ কেন খেপবে না?
গোপেনবাবু চা তৈরি করলেও কানটা ছিল মণ্টুবাবুর দিকে। চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলেন, এ তো মানুষের উপর সরাসরি আঘাত! মানুষের ভালোর জন্যই তো আইন। কিন্তু, পুলিস সেই আইনকে হাতিয়ার করে মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। আর পুলিস কিছু করলেই মানুষের রাগ গিয়ে পড়ে সরকারের ঘাড়ে। হচ্ছেও তাই।
বাম জমানায় বালি আর কয়লা ছিল ‘ওপেন ট্রেজারি’। যত খুশি তোলো আর বিক্রি করো। নামমাত্র লিজে দেদার বালি উঠত। লিজে স্বচ্ছতা আনতে বর্তমান রাজ্য সরকার ‘অনলাইন’ ব্যবস্থা চালু করায় বালি এখন অতীব মহার্ঘ বস্তু। সরকারের আয় বহু বেড়েছে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পাচারের ও কালোবাজারির সম্পর্ক তো ‘মাসতুতো ভাই’ এর মতো। কোনও জিনিসের দাম বাড়লেই বৃদ্ধি পায় পাচারের প্রবণতা। বালির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। বালির গাড়ি দেখলেই জিভ লক লক করে। থামানো হয় ট্রাক, ট্রাক্টর। বালির কাগজ না থাকলে তো পোয়া বারো। আর কাগজ থাকলে ওভারলোডিংয়ের চক্কর। আদায় হচ্ছে মোটা টাকা। কারণ সোনালি বালি দিন দিন সোনা হয়ে উঠছে।
একটা সময় কয়লা ছিল ‘কালো হীরে’। এখন পুলিসের কাছে ‘কালো হীরে’ পাথর। বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার পাথর খাদান থেকে ওঠা আইনি এবং বেআইনি পাথর বিভিন্ন এলাকায় যায়। তা থেকে পুলিসের মোটা টাকা মাসোহারা ওঠে। কোথাও কোথাও পুলিস ও দাপুটে নেতার মধ্যেও ভাগাভাগি হয়।
সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত রাস্তার ধারে পুলিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যদি কেউ মনে করেন, মানুষের নিরাপত্তার জন্য ওরা দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে ভুল ভাববেন। মালবাহী গাড়ির উপর কড়া নজরদারি চালানোর জন্যই থাকে ‘ডাকবাবু’র গাড়ি। থানা এলাকার চোলাই, গাঁজা ও জুয়ার ঠেক, বেআইনি বালি, পাথর, কয়লা, লোহা, গোরু প্রভৃতি পাচারে ও বহনে যুক্ত গাড়ি থেকে টাকা আদায়ের ‘লাইসেন্স’ যিনি পান, তিনিই হলেন ডাকবাবু। তার জন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্টি পরিমাণ টাকা ডাকবাবু থানায় জমা দেন। পুলিসকর্মী হলেও ডাকবাবুকে থানার চেয়ে রাস্তাতেই বেশি দেখা যায়। কারণ থানায় দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতির বেশি পরিমাণ টাকা তুলতে না পারলে পকেট থেকে দিতে হয়। আর বেশি টাকা তুলতে পারলে তা যায় ডাকবাবু ও তাঁর সঙ্গীদের পকেটে। এ এক অতীব প্রাচীন ব্যবস্থা। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, সব জমানাতেই ‘ডাকবাবু’ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও। এঁরাই থানার মূল চালিকাশক্তি। বহু বড় বড় সাহেবের সন্তুষ্টি বিধান এই অর্থেই হয়ে থাকে।
পুলিস, পাচারকারী এবং ‘প্রোটিন প্রিয়’ নেতাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৌলতে চলছিল বেশ ভালোই। কিন্তু, বিপদ হলো দুম করে রেট বাড়িয়ে দেওয়ায়। বছর তিনেক আগে আচমকাই গাড়ি প্রতি ‘তোলা’র রেট দ্বিগুণ করে দেওয়া হল। জানিয়ে দেওয়া হল, কলকাতায় টাকা দিতে হচ্ছে। যাঁরা প্রতিবাদ করলেন তাঁদের বলা হলো, দেখ, কাদের ভোট দিয়েছে। আমাদের কিছু করার নেই।
কলকাতায় টাকা পাঠানোর দাবি সত্যি হোক বা মিথ্যে, তা যাচাই করার জায়গা নেই। তাই ‘তোলা’ উঠতে শুরু করল দ্বিগুণ হারে। পাশাপাশি সমহারে বাড়তে লাগল শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। শাসক দলের কেউ কেউ অবশ্য এখন দাবি করছেন, সরকার ডিএ আটকে রাখায় ক্ষুব্ধ পুলিসকর্মীদের একটা বড় অংশ পরিকল্পিতভাবে এই প্রচারটা চালিয়েছে। কারণ তাঁরা মনে করেন, গাড্ডায় না পড়লে সরকার হাত খুলবে না। মানে প্রাপ্য ডিএ দেবে না।
তবে পুলিসের মধ্যে অনেক সৎ কর্মী এবং অফিসার আছেন। এমন অনেকে আছেন যাঁরা কাদার মধ্যে থেকে গায়ে কাদা লাগতে দেন না। কিন্তু, তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য। শুধু তাই নয়, তাঁরা সেই অর্থে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেননি। যাঁরা বাম জমানায় দাপুটে ছিলেন, তাঁরা এখনও যথেষ্ট প্রভাবশালী। কারণ তাঁদের ম্যানেজ এবং খুশি করার একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা আছে। এঁরা পাল্টি খেতে এবং গুরুঠাকুর ধরতে ওস্তাদ। এঁরা খুব ভালো করেই জানেন, গতিশীল জীবনে অতীত রেকর্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় তেমন কারও নেই। যদি না নতুন করে ফাউল হয়। তাই নন্দীগ্রামের ‘হ্যান্ডিক্যাম’ ওসি কিংবা কাটোয়ার অধ্যাপক তুহিন সামন্ত খুনে অভিযুক্ত অফিসার ‘মা মাটি মানুষ’ এর আমলেও পুলিস কর্তাদের ‘ব্লু আইড বয়’।
বাম জমানায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানার ওসি, আইসি থেকে এসপি পোস্টিংয়ে পার্টিই ছিল শেষ কথা। তাই পুলিসেরও নেতাদের কথার বাইরে যাওয়ার উপায় থাকত না। থানার ওসি পোস্টিংয়ের আগে জেলা সম্পাদকের কাছ থেকে তালিকা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া ছিল অধিকাংশ এসপির আবশ্যক কর্তব্য। অমান্য করলে পদ খোয়ানো ছিল সময়ের অপেক্ষা। তবে তা হতো অত্যন্ত নিঃশব্দে। যিনি শাস্তি পেতেন এবং যাঁরা শাস্তি দিতেন, তাঁদের মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকত। এখনকার মতো অত হইচই হতো না। তবে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পুলিস এবং প্রশাসনের উপর স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আলগা হয়েছিল।
বাম জমানার তুলনায় এখন পুলিস এবং প্রশাসন অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। এখন বেশিরভাগ জেলার শাসক দলের নেতাই পুলিস সুপার এবং জেলাশাসকদের সমঝে চলেন। কারণ জেলার নেতাদের কামকর্মের ‘ফিড ব্যাক’ নাকি তাঁদের মাধ্যমেই যায়। তাই বাম জমানায় প্রশাসনকে ধমকে চমকে রাখার যে রেওয়াজ চালু ছিল তা এখন উল্টো ধারায় প্রবাহিত। প্রশাসকের গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি দায়িত্বও বেড়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত পুলিস নির্ভরতা যে কোনও রাজনৈতিক দলের দৈন্যতার লক্ষণ। জনবিচ্ছিন্নতার জেরে তৈরি ফাঁকফোকর মেরামতির জন্য পুলিসকে কাজে লাগানোর কৌশল নতুন কিছু নয়। বাম জমানায় পুলিসের গায়ে সেঁটে যাওয়া ‘শাসক দলের লেঠেল বাহিনী’র তকমাটা আজও অমিলন। বাম জমানায় জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমনের নামে হার্মাদদের সঙ্গে পুলিসের যৌথ ক্যাম্প, বুদ্ধদেববাবুর কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের পর লালগড়ে ছিতাবনি মুর্মু সহ আদিবাসী মানুষের উপর অমানবিক অত্যাচার, নন্দীগ্রামে গণহত্যার মতো একের পর এক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পুলিস আর সিপিএম সমার্থক। পুলিস যত শাসক দলের অনুগত হয়, ‘আইনের রক্ষক’ ততই হারায় মানুষের আস্থা।
সংবিধান পুলিসের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে। সুনাগরিকের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এতকিছু। কিন্তু সেই ক্ষমতা যদি মানুষের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। আসলে ক্ষমতা অনেকটা শানিত ছুরির মতো। শল্য চিকিৎসকের ছুরি মানুষের প্রাণ বাঁচায়, দুষ্কৃতীর হাতের সেই ছুরিতেই মানুষের প্রাণ যায়। তাই অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতার আস্ফালনে নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।