কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে দল ও সরকারে যুগলবন্দির প্রথা শুরু হয় স্বাধীনতার ক্ষণ থেকেই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সবথেকে খ্যাতনামা ও সফল তিনটি রাজনৈতিক জুটি হল জওহরলাল নেহরু-বল্লভভাই প্যাটেল। লালকৃষ্ণ আদবানি-অটলবিহারী বাজপেয়ি। এবং নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ। তিনটি জুটিই প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দলে এক নম্বর-দু’নম্বর। সব ক্ষেত্রেই ইতিহাসের এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। এই যুগলবন্দির একটি চরিত্র হয় সাধারণত জনপ্রিয় এবং ক্যারিশমাটিক এক ক্রাউডপুলার। যাঁর সাপোর্ট বেস দলমতনির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ে জনতার মধ্যে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর দ্বিতীয়জন অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে প্রবল শক্তিশালী তথা দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, দলীয় সমর্থনের সম্প্রসারণ করা এবং দল তথা সরকারের আগ্রাসী নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগে পটু। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরু ছিলেন প্রথমজন। তিনি ছিলেন ক্যারিশমাটিক এক জনপ্রিয় নেতা। তাঁর ইমেজ এবং বক্তৃতায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মুগ্ধ। অন্য দিকে, প্যাটেল ছিলেন দ্বিতীয় জন। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ছিল প্রবল এবং সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রয়োগে তিনি ছিলেন কঠোর। ১৯৯৯ সাল থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ি ছিলেন প্রথম জন। অর্থাৎ তিনি দলের অ্যাজেণ্ডায় সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছিলেন এক সর্বজনমান্য জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মুখ। আর লালকৃষ্ণ আদবানি তখন আবার দ্বিতীয় জনের ভূমিকায় ছিলেন। তিনি একাই রামমন্দির আন্দোলনের স্রষ্টা। বস্তুত ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূত্রপাত হয় তাঁর হাত ধরে। সরকারে আসার পরও তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে কঠোর নীতিগুলি বলবৎ করার পক্ষে ছিলেন। এবং কড়া ঘোষণাগুলিও তিনিই করতেন।
সেই সময় বলা হতো আদবানি বিজেপির মুখ, বাজপেয়ি মুখোশ। ওই ট্র্যাডিশন বজায় রেখেই নতুন প্রজন্মের নতুন ভারতে এখন নরেন্দ্র মোদি জনপ্রিয় এক প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির মুখ। ভোট সংগ্রহের জন্য মোদির তুমুল ক্যারিশমা আর ম্যাজিকই বিজেপির সবথেকে বড় হাতিয়ার। আর অন্য দিকে অমিত শাহ হলেন দ্বিতীয় সেই মুখ, যিনি প্রশাসনিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় এবং দলের সংগঠন পরিচালনায় প্রায় একচ্ছত্র অধিকারী। সুতরাং, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে, এ রকম তিনটি জুটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, যাঁদের মধ্যে দলে এবং সরকারে এক নম্বর স্থান পেয়ে এসেছেন তিনি, যে ব্যক্তি বেশি জনপ্রিয় ভোটের ময়দানে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তিটি সর্বদা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন।
এই প্রবণতায় কি কোনও পার্থক্য নেই? অবশ্যই আছে। পার্থক্য হল, এই তিন জুটির মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় জুটির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রবল মতান্তর হয়েছে বারংবার। ছিল গোপন ইগোর লড়াইও। স্বাধীনতার আগেই যখন নতুন কংগ্রেস সভাপতি মনোনয়নের বাছাই পর্ব শুরু হয়েছিল, তখন সিংহভাগ প্রদেশ সভাপতি ছিল প্যাটেলের সভাপতি হওয়ার পক্ষে। গান্ধীজি কিন্তু নেহরুকেই সভাপতি করেছিলেন। প্যাটেল, গান্ধীজির মনোভাব জেনে নিজের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন। গান্ধী জানতেন, স্বাধীনতার পর তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন, যিনি কংগ্রেসের সভাপতি। তাই তিনি চাইতেন, নেহরুই প্রধানমন্ত্রী হবেন। অতএব নেহরুই সভাপতি হন। পরবর্তীকালে নানা ইস্যুতে মতান্তর হয়েছে নেহরু প্যাটেলের।
আদবানি এবং বাজপেয়ির মধ্যেও বহু ইস্যুতেই মতবিরোধ হয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান অপহরণ কিংবা গুজরাত দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে বাজপেয়ির অসন্তোষ। দাঙ্গার পর গুজরাতে আয়োজিত বিজেপি ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভে যোগ দিতে গুজরাত যাওয়ার সময় একই বিমানে বাজপেয়িকে বিষণ্ণ ও অন্যমনস্ক দেখে আদবানি বলেছিলেন, বাজপেয়িজি কী ভাবছেন? বাজপেয়ি শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, কমসে কম ইস্তিফা দেনে কী বাত তো কর স্যাকতে থে! অর্থাৎ মোদি অন্তত প্রকাশ্যে দাঙ্গার দায় নিয়ে বলতেই পারতেন তিনি ইস্তফা দিতে চান। তা হলেও একটা বার্তা যেত। আদবানি বরাবরই মোদির পক্ষে। বস্তুত তিনিই মোদির মেন্টর। বলেছিলেন, আপনি চাইলে আমি বলব সে কথা মোদিকে। কিন্তু সেটা সমাধান নয়। বস্তুত আদবানি যে বাজপেয়ির থেকে কোনও অংশে কম নয়, এটা বোঝাতে তিনি শুধুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে সন্তুষ্ট হননি। উপ-প্রধানমন্ত্রীও করতে হয়েছে তাঁকে।
এখানেই অমিত শাহ ও মোদির সমীকরণে তাঁদের পূর্বসূরি দু’টি রাজনৈতিক জুটির তুলনায় বিরাট একটা পার্থক্য। অমিত শাহ নিজেকে নরেন্দ্র মোদির সমকক্ষ হিসাবে প্রদর্শন করতে চান না। তিনি সর্বদাই মোদিকে ‘ইমিডিয়েট বস’ হিসাবেই প্রাধান্য দেন এবং প্রকাশ্যে বিবেচনা করেন, মোদিই দলে সব, তিনি নেহাত মোদির অনুগামী। তাই তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও উপপ্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে একটি বিশেষ প্রবণতা। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে একের পর এক তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত তথা কঠোর পদক্ষেপগুলির সবই হ্যান্ডেল করছেন অমিত শাহ। ৩৭০ নং ধারা বিলোপ করা, বারংবার গোটা দেশে এনআরসি চালু করার ঘোষণা, হিন্দিকেই দেশের একমাত্র সমন্বয়ের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা, কোন রাজ্যে কোন দলের সঙ্গে জোট করা হবে, ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর কার সঙ্গে যৌথ সরকার গঠন করা যায়, আরও কোন দলকে এনডিএ জোটে নিয়ে আসা হবে, কোন কোন বিরোধী নেতাকে টার্গেট করা হবে আইনগত ভাবে, ইত্যাদি তাবৎ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমিত শাহের নাম। এই বিষয়গুলি নিয়ে আমরা কখনওই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনও বক্তব্য শুনতে পাই না। অর্থাৎ সরকারের এক কঠোর প্রশাসক এবং দলের এক সুকৌশলী সংগঠক, এই দুই ভাবমূর্তি ক্রমেই প্রবলভাবে জোরদার হয়ে উঠছে অমিত শাহ সম্পর্কে।
পক্ষান্তরে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সচরাচর দেখা যাচ্ছে কী করতে? তিনি আমেরিকায় মেগা শো করেন। প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হওয়া কেন দরকার, সেই সামাজিক উন্নয়নের আহ্বান করেন, স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপন করেন, সেই লক্ষ্যে সমুদ্রতটের আবর্জনা পরিষ্কারের ভিডিও শেয়ার করেন, বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ফোটো সেশন হয়, ক্লাইমেট চেঞ্জ, মেক ইন ইন্ডিয়া, বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও সম্পর্কে মন কী বাতে রেডিওর ভাষণ দেন। আর যে কোনও রাজ্যে ভোট এলে তিনি সভাসমাবেশ করেন। একই ভাবে হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে অনেক বেশি প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। এটা অন্য দেশের ক্ষেত্রে হয় না। কিংবা ভারতেও হয়নি। কাশ্মীর ৩৭০ ধারার বিলোপসাধনের পর স্বাভাবিকতায় ফিরছে কিনা সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে কোনও মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতার ভিডিও অথবা সংবাদ প্রচারিত হওয়ার স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দেখা গেল অজিত দোভালের ভিডিও, ছবি প্রচারিত হচ্ছে। তার পরও বিভিন্ন ইভেন্টে, সেমিনারে, পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিতে অজিত দোভাল প্রকাশ্যে অনেক বেশি সক্রিয়। ক্রমেই প্রশাসন পরিচালনায় অমিত শাহের কঠোর পদক্ষেপ ও কড়া সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং দেশের সুরক্ষা, সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি, স্ট্র্যাটেজিক বিষয়ে অজিত দোভালের নামই বেশি বেশি সামনে আসছে।
সুতরাং একটি ভাবমূর্তি নির্মিত হয়ে চলেছে যে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগ্রহণে অমিত শাহ-অজিত দোভাল জুটি এখন একটা নতুন রকমের ইমেজ গঠন করতে জনমানসে সমর্থ হয়েছেন। ভারতের নিরাপত্তা রক্ষায় তাঁরা যে কোনও আপস করছেন না, এই প্রকট বার্তা তাঁরা দিতে চাইছেন একের পর এক অতি তৎপর সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং ঘোষণা করে। দেখা যাচ্ছে দলের সভাপতি হিসাবে তো বটেই, সরকারের অন্যতম প্রধান নীতি নির্ধারক হিসাবেও আম জনতার চর্চায় অমিত শাহের নাম আগের তুলনায় অনেক বেশি বেশি আসছে এখন। আবার নিজের দলকে প্রবল শক্তিশালী হিসাবে ধরে রাখতে তাবৎ অঙ্ক ও রসায়নও করে থাকেন অমিত শাহ। সেখানেও দ্বিতীয় কোনও নেতা কিন্তু উঠে আসতে পারেননি, যাঁকে বলা যেতে পারে বিজেপির সভাপতি হওয়ার যোগ্য। সেই কারণেই জগৎপ্রকাশ নাড্ডা কার্যকরী সভাপতি হয়েই রয়েছেন। সভাপতি এখনও অমিত শাহ।
এই গোটা প্রেক্ষাপটে সবথেকে ইন্টারেস্টিং হল নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা। তিনি এখন ক্রমেই বিজেপির সিম্বলিক এক ক্রাউডপুলার, ভোট সংগ্রহের সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবেই বিবেচিত হয়ে চলেছেন। কারণ স্বাভাবিক, নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা এখনও প্রশ্নাতীত। যে কোনও রাজ্যে তাঁর নামেই বিজেপিকে মানুষ ভোট দিয়ে চলেছে আজও। মোদির সমকক্ষ জনপ্রিয় নেতা এখনও, এত ব্যর্থতার অভিযোগ সত্ত্বেও উঠে আসছে না রাজনীতিতে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন। সরকার পরিচালনায় মোদির ভূমিকা নিয়ে আর বিশেষ জোরদার চর্চা হয় না।
তিনি কী ধীরে ধীরে প্রতীকী এক অন্তহীন জনপ্রিয় থাকার কৃৎকৌশলের অঙ্গ হয়ে স্রেফ ভোটে জেতার যন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছেন? তিনি শুধুই জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে ভালো ভালো কথা বলবেন! স্বচ্ছ ভারত, ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা বর্ষ, ভারত ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হবে, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে, এ রকম ঘোষণাগুলিই করে যাবেন? আর ভোট এলে সভা সমাবেশে নেহরু, কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ করে চলবেন আগের মতোই। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, মোদি নতুন ভিশনের আর সন্ধান দিচ্ছেন না, যা তিনি প্রথম পাঁচ বছরে সমর্থ হয়েছিলেন দিতে। তিনি যেন ক্রমেই হয়ে পড়ছেন বিজেপির ইমেজ বিল্ডিং আর ভোটে জেতানোর শুধুই এক অফুরন্ত ভোট মেশিন! ৬ বছর আগেও তিনি ছিলেন আমজনতার কাছে স্বপ্নের সওদাগর। স্বপ্নের ভাঁড়ার কি কমছে? প্রত্যক্ষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে আর ঘোষণা করতে দেখা যাচ্ছে না কেন?