কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
শারীরিক বৃদ্ধি সঙ্গত কারণেই ব্যাহত করবে এদের মানসিক বৃদ্ধিকে। জীবনের ফুটে ওঠার অবস্থায় পুষ্টির অভাবে ব্যাহত হবে এদের বুদ্ধিবৃত্তি। এ এক অদ্ভুত চক্র! স্কুলে যাওয়ার জন্য সরকারি যোজনা রয়েছে, কিন্তু অপুষ্টি তো শিশুর শেখার ক্ষমতাটাই আটকে দেয়। আবার শেখার অক্ষমতা আটকায় তার মানসিক বৃদ্ধির সুযোগ। সে কোনও পেশার জন্যই শরীর ও মনে প্রস্তুত হতে পারে না। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে জীবনভোর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলে। গ্রাম শহরে প্রতিদিনই এই মানুষগুলির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। বিপ্লবী, প্রতিবিপ্লবী, শাসক ও বিরোধী সবার খাতাতেই এরা বাতিল। এরা শুধু নামহীন কিছু সংখ্যা হয়ে জেগে থাকে পরিসংখ্যানে। আজকের ক্ষুধার্ত, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুটি উপযুক্ত সময় ও বয়সে শরীরে ও মনে বাড়ার সুযোগ না পেলে আগামী দিনে অনিবার্যভাবে ক্ষুধার্ত বেকার এবং অশিক্ষিত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়েই থাকবে।
যা লিখলাম তা কিন্তু বিরাট কিছু নতুন কথা নয়। শিশুরাই দেশের সবচেয়ে অসুরক্ষিত অংশ। এদের পুষ্টির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য লাগাতারভাবে সরকারের সমালোচনা করা হচ্ছে। বারবার বলা হচ্ছে কম বয়সের শিশুদের বেশি করে পুষ্টির ব্যবস্থা করার কথা। কিন্তু অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে অপুষ্টিতে ভরা দেশের অন্যতম হয়েই রয়েছে। পরিসংখ্যান দেখিয়ে কেউ হয়তো বলবেন, কেন ২০০৫-৬ এর তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে তো দেশে লাগাতার অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমেছে, কমেছে অ্যানিমিয়া, ওজন কম শিশুর সংখ্যাও এখন আগের তুলনায় কম। কিন্তু এই অগ্রগতি হচ্ছে খুব ধীর গতিতে। বছরে মাত্র ১ শতাংশ হারে। বৃদ্ধির হার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর এই দেরি হওয়াটাই দেশের বহু শিশুকে যাকে বলে ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দিচ্ছে। তারা জীবনটা শুরু করছে অনেক পিছিয়ে থেকে। জীবনের সূচনা থেকে তারা যেন ‘লাস্ট বয়।’
সরকার এসব কথা যে একেবারে ভাবছে না তা নয়। ন্যাশনাল নিউট্রিশন মিশন, এখন যার নাম পাল্টে হয়েছে পোষণ অভিযান, তাতে বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুদের সংখ্যা বছরে ২ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। তাদের মতে এভাবে এই শিশুদের সংখ্যা ২০২২ এর মধ্যে ২৫ শতাংশ করে ফেলা যাবে। কিন্তু এই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলেও অগ্রগতির হার এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ করতে হবে। পোষণ অভিযানের সঙ্গে জড়িত সরকারি মহলের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা শুনে কিন্তু এব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়ার বিরাট কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। পোষণ অভিযান প্রকল্প শুরু হওয়ার একবছর পরেও রাজ্য সরকার এবং দেশের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি মোট বরাদ্দের মাত্র ১৬ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। দেশের শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর জন্য প্রতিটি রাজ্যের সবচেয়ে সমস্যাসঙ্কুল একটি জেলায় গত মার্চ থেকে উৎকৃষ্ট মানের চাল এবং দুধ দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পের কর্তারা এখন স্বীকার করছেন কাজটা শুরু করা যায়নি। দেশের গণবন্টন ব্যবস্থা ছাড়া একাজ সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প রূপায়ণের কাজটি এখনও ঠিকমত করে ওঠা যায়নি। অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীরা এই প্রকল্প রূপায়ণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বিহার ও ওড়িশার মত রাজ্যে যেখানকার শিশুদের একটা বড় অংশ এই সমস্যার শিকার সেখানে অঙ্গনওয়াড়ি তৈরি করা, কর্মী নিয়োগ করা ইত্যাদি ব্যাপারে সমস্যার কোনও সমাধান করা যায়নি।
সমস্যার ব্যাপকতা নিশ্চয় আছে, রয়েছে পরিকাঠামো এবং মানুষের সচেতনতার সমস্যাও, কিন্তু দেশে খাদ্য নেই বলে যে গরিব শিশুদের পুষ্টির জন্য খাদ্য দেওয়া যাচ্ছে না তা নয়। এটাই সবচেয়ে দুঃখের, সবচেয়ে লজ্জার। গত দু’দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩৩ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে এখন আমরা বস্তুত স্বয়ম্ভর। কিন্তু সেই অনুপাতে চাল, গম এবং অন্যান্য জরুরি খাদ্যশস্য মানুষের পক্ষে ততটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অসাম্য, খাদ্য নষ্ট হওয়া, রপ্তানি বাণিজ্য সহ আরও কিছুকেই এরজন্য দায়ী করা চলে। যার পরিণতিতে এখনও দেশের দরিদ্রতম অংশের প্রায় ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খাদ্যশস্য পান। দরিদ্র শিশুদের মধ্যে এই অপ্রাপ্তির হার আরও বেশি।
আবার দেশের সব অংশে এই সমস্যা সমান নয়। খারাপ অবস্থারও রকমফের রয়েছে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মত বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার সমস্যা এতটা ব্যাপক না হলেও ন্যাশনাল ফ্যামেলি হেলথ সার্ভের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও এই সমস্যা কম নয়। এটা যে শুধু আর্থিক কারণেই ঘটছে তা নয়। বহু জায়গায় আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও একটা বড় সমস্যা। বিশেষ করে তফশিলি জাতি ও উপজাতি এবং অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবারে এই সমস্যা অনেকে বেশি। কেউ বলতে পারেন বাড়ির ছোটদের তো সবাই ভালোবাসেন। বাড়ির লোক তাদের না খাইয়ে বা কম খাইয়ে কেন রাখবেন? ঠিক কথা, কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বৃদ্ধি ব্যাহত ও অপুষ্টি কিন্তু শিশুদের নয়, শুরু হয় তাদের মায়েদের থেকে। অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভোগা একটা কমবয়সি মায়ের শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার সমস্যা সবথেকে বেশি।
আগামী পাঁচ বছরে দেশকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশে পরিণত করার কথা বলছেন সরকার। খুব ভালো কথা, কিন্তু বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুদের বিপুল বোঝা তো এ রাস্তায় দেশের এগনোর পথে বাধা সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে দুঃখের কথা হল, এই সমস্যা তৈরি হয়েছে সম্পদ নয়, সমাধানের রাস্তাটা তৈরি করতে না পারার জন্য। পরিষেবা পাওয়ার সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর অসুবিধা দূর করতে না পারলে অবস্থা বদলাবে না। বদলাতে হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও। সবার আগে প্রান্তবাসী শিশুদেরও দেশের ভাবী নাগরিক মনে করে জীবনের ফুটে ওঠার অবস্থায় তাদের সামনের সারিতে আনার প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতে এই সমস্যাটা শুধুমাত্র বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুদের বা তার বাবা মায়েদের সমস্যা নয়, সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশের সমস্যা। যে শিশুরা দেশের কর্মক্ষম, উৎপাদনশীল, সচেতন নাগরিক হতে পারতো তাদের সামনে নিয়ে না আসার ব্যবস্থা করলে গোটা দেশই পিছিয়ে থাকবে। যাদের আয় দেশের সম্পদ বাড়াতে পারতো এখন তাদের জন্যই অনুৎপাদক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে দেশকে।
দেশ, সমাজ, সময়, সভ্যতা সব কিছু এগয় কিন্তু শিশুদের নিয়ে। শিশুদের শারীরিক বিকাশ এখন উন্নয়নের একটা বড় সূচক। কিন্তু দেশের দুই-পঞ্চমাংশ গরিব পরিবারের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুদের নিয়ে আমাদের তো উন্নয়নের রাস্তায় চলাটাই সমস্যা হবে। আধুনিক অর্থনীতি তো তাদের স্পর্শই করতে পারবে না। এক থেকে পাঁচ বছরের ছোটরা চিরকাল ছোট হয়ে থাকলে দেশের বৃদ্ধিই ছোট হয়ে যাবে, ছোট হবে দেশের মুখ। এই অবস্থা বদলাতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, পিছিয়ে থাকা এই অসংখ্য শিশু কিন্তু দেশের অগ্রগতির রথকে পিছনে টানছে।