কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
ইথিওপিয়ায় ৯০টিরও বেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো ছিল একটি অন্যটির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত। দশকের পর দশক ইথিওপিয়ার রাজনীতি যে ঘূর্ণাবর্তে ছিল, তাতে এই বিভেদ আরও বেড়েছে। সামরিক একনায়ক মেঙ্গিস্টু হাইলে মারিয়াম সেই ১৯৭৪ সাল থেকে দেশে সেনা শাসন জারি করে রেখেছিলেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন। তাঁর সময়ে দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছে। টাইগারি নৃ-গোষ্ঠী থেকে কিছু গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে দ্য টাইগারিয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। টিপিএলএফের ক্ষমতা যখন দিন দিন বাড়ছিল, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় দেশের বড় বড় নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে তাদের দলে টানতে হবে। তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। ১৯৮৯ সালে টিপিএলএফ ওরোমো এবং আমরাহার মতো সবচেয়ে বড় দু’টি নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট করে। জোটের নাম দেওয়া হয় ইথিওপিয়ান পিপলস রেভ্যুলুশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইপিআরডিএফ)। দেশের অস্থিরতা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৮-র ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হাইলে মারিয়াম পদত্যাগ করেন। ১৮ মাসের মধ্যে দেশে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। দেশজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটা সময় অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ওরোমো থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী না হলে গৃহযুদ্ধ নিশ্চিত। ইথিওপিয়ায় সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম ‘ওরোমো’। দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই এই সম্প্রদায়ের। প্রধানমন্ত্রী আবিও এই সম্প্রদায়ের।
প্রধানমন্ত্রী আবি বিস্ময়করভাবে সব নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে সমান জনপ্রিয়। তাঁর বাবা ছিলেন ওরোমো মুসলিম এবং মা ছিলেন খ্রিস্টান। তিনি ওরোমো, আমরাহা, টাইগারি ও ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী। ১৯৯০-এর দশকে আবি রুয়ান্ডায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইথিওপিয়ার সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি আইএনএসএর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন এবং দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ওরোমিয়া অঞ্চলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৩ বছর বয়সি আবি আহমেদ। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে সংবাদসংস্থা বিবিসি বলছে, ‘বারাক ওবামার জয়ের পর এমন দৃশ্য আর কখনও দেখা যায়নি। ইথিওপিয়ার মানুষ কাঁদছে, কারণ এই প্রথম তারা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। মানুষ অবশেষে তাদের মনের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, সেই খুশিতে কাঁদছে। না দেখলে আপনি ভাবতেই পারবেন না।’ চলতি বছরের জুলাইয়ে আবি আমেরিকার তিনটি অঙ্গরাজ্য সফরে যান। সবার শেষে তিনি যান মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে। সেই অঙ্গরাজ্যের টার্গেট অ্যারেনা স্টেডিয়ামে জনসভার আয়োজন করা হয়। আবিকে দেখতে সেদিন ভোর ৬টার মধ্যেই পুরো স্টেডিয়াম ভরে গিয়েছিল। প্রায় ২০ হাজার ইথিওপীয় তাদের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে সামনাসামনি দেখতে ও তাঁর কথা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন। আমেরিকায় আড়াই লাখেরও বেশি ইথিওপীয় নাগরিকের বসবাস। এদের অনেকেই জীবন বাঁচাতে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় গিয়েছেন। তাদের সবার সামনে প্রধানমন্ত্রী আবি একজন ত্রাতা, যিনি বিধ্বস্তপ্রায় ইথিওপিয়াকে পুনরায় রক্ষা করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
আবি আফ্রিকার অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কের মতো নন। জনগণের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কম। জনবহুল তল্লাটে গিয়ে তিনি মানুষ ও অন্যান্য রাজনীতিকদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন, সেলফি তোলেন, জনসভা মাতিয়ে রাখেন। ইথিওপিয়ার নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে তিনি নিজেদের মধ্যে ‘দেওয়াল তৈরি না করে সেতু তৈরি করতে’ বলেন। মিনেসোটার ওই জনসভায় আবি বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি এই প্রজন্মের গর্ব হতে চান, তাহলে ওরোমো, আমহারা, ওলেয়টাস, সিলটেসসহ সব নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। সবাইকে সমান ইথিওপীয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।’ এটা একটা বৈপ্লবিক বার্তা। ইথিওপিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যে গোষ্ঠীগত বিভেদ, সর্বমহলে জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তায় সেটি কমে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। আমেরিকার মিনেসোটার জনসভার ভাষণে সেদিন তিনি ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় তিনটি ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন। এমনকী পার্শ্ববর্তী দেশ সোমালিয়ার মানুষদের সম্মানে তিনি সোমালি ভাষায়ও কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এই রাষ্ট্রনেতা খুব দ্রুততার সঙ্গে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো দেশে-বিদেশে ইথিওপীয়দের মনে আশার সঞ্চার করেছে। ক্ষমতায় এসেই তিনি হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছেন। সেন্সরশিপের নামে বন্ধ থাকা শত শত ওয়েবসাইট চালু করেছেন। রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থা তুলে নিয়েছেন। দেশের অর্থনীতি ও ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন। প্রতিবেশী ইরিট্রিয়ার সঙ্গে ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের ইতি টেনেছেন।
১৯৯৩ সালে ইরিট্রিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইথিওপিয়া থেকে। ইরিট্রিয়া হর্ন অব আফ্রিকায় লোহিত সাগরের মুখে, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথের কাছেই অবস্থিত। এই দেশের স্বাধীনতা ছিল ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ইরিট্রিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ বছরের সংগ্রামের ফলাফল। বারবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ গিয়েছে দু’পক্ষেরই সত্তর হাজারের বেশি মানুষের। এই যুদ্ধে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। বহু পরিবার ভেঙে যায়। স্থানীয় বাণিজ্য-অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে ব্যাপক শরণার্থী সঙ্কট তৈরি হওয়ায় হাজার হাজার ইরিট্রিয়াবাসী ইউরোপে পালিয়ে যান। ক্রমেই মেরুদণ্ড ভেঙেছে দুই দেশের অর্থনীতির। ইরিট্রিয়ার স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর থেকে দু’দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সীমান্তবর্তী গুরুত্বহীন শহর বাদমের দখল নিয়ে, যে শহর আদ্দিস আবাবা এবং আসমারা দু’পক্ষের কাছেই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২০০০ সালের জুন মাসে দু’দেশ শত্রুতা নিরসনের চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে আলজেরিয়ায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে সরকারিভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং সমস্যা মেটানোর জন্য সীমান্ত কমিশন গঠিত হয়। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে কমিশন বাদমেকে ইরিট্রিয়ার অংশ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ইথিওপিয়া এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করে এবং শুরু হয় অচলাবস্থা। ইথিওপিয়া বাদমের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে অস্বীকার করলে সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়। আবার হত্যা। আবার রক্তপাত।
২০১৭ সালে ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন ইথিওপিয়ান পিপলস রেভলিউশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইপিআরডিএফ) ইরিট্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে বদল ঘটানোর ইঙ্গিত দেয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আবি আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতির বদল ঘটতে থাকে। ক্ষমতায় এসেই আবি আহমেদ আলি প্রথমেই সচেষ্ট হন ইরিট্রিয়ার সঙ্গে হিংসা অবসানে। একই সঙ্গে চলতে থাকে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে আবি আহমেদ দেখা করেন ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ইসআইআস আফওয়ের্কির সঙ্গে। শুরু হয় সীমান্ত সমস্যা নিয়ে মত বিনিময়। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই আসমারায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট আফওয়ের্কির সঙ্গে সাক্ষাতের একদিন আগে তিনি ঘোষণা করেন, ‘ইরিট্রিয়া এবং ইথিওপিয়ার মধ্যে আর কোনও সীমান্ত নেই, ভালোবাসার সেতু সীমান্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।’ শান্তি চাইছিল ইরিট্রিয়াও। সদর্থক আলোচনার শেষে দুই দেশের প্রধান ৯ জুলাই একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। আবি আহমেদ বাদমে অঞ্চলকে ইরিট্রিয়ার হাতেই সমর্পণ করেন। স্থির হয়, দুই দেশের মানুষ, পণ্য ও অন্যান্য পরিষেবার জন্যে সীমান্ত খুলে দেবে উভয় পক্ষই। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনেকটাই বদলে দিয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক। ইরিট্রিয়ার সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধের কারণে এডেন উপসাগর এবং আরব সাগরের দিকে যাবার জন্য ইথিওপিয়াকে ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হচ্ছিল বাব আল-মানদাব প্রণালীর উপর অবস্থিত জিবৌতির উপর। শান্তি চুক্তির ফলে ইরিট্রিয়ার বন্দর ইথিওপিয়ার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
গত কয়েক মাসে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার চিত্রটাই পাল্টে যায়। আগের সরকারের চাপে পিষ্ট থাকা মানুষগুলো এখন যেন একটু বুক উঁচিয়ে হাঁটতে পারছে, মন খুলে হাসার একটা উপলক্ষ এখন তাদের সামনে আছে, কয়েক দশক ধরে যা তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। আদ্দিস আবাবার রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে গাড়ির সামনে-পিছনের গ্লাসে এখন প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর ছবির স্টিকার সেঁটে রাখে সবাই। তাঁর ছবি আঁকা টি-শার্টের পিছনে মানুষ দেদার টাকা খরচ করছে। লোকজন তাদের ফেসবুক-ট্যুইটার-ইনস্টাগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও তাঁর বিভিন্ন বার্তা দিয়ে প্রোফাইল ছবি বানাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের জনপ্রিয়তা আজ আকাশ ছুঁয়েছে। আদ্দিস আবাবা থেকে ব্রিটিশ সাংবাদিক টম গার্ডনার লিখছেন, ‘রাজধানীতে রীতিমতো একটি ধর্মীয় উৎসবের আবহ। মানুষ খোলামেলাভাবেই বলাবলি করছে, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই ঈশ্বরের সন্তান বা তাঁর দূত হবেন।’ প্রধানমন্ত্রী আবিকে নিয়ে দেশটিতে এখন যা চলছে, সাংবাদিক গার্ডনার এই উন্মাদনার নাম দিয়েছেন ‘আবিম্যানিয়া’।