কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এখন আবার ওই প্রসঙ্গ কেন? কারণ একটাই। কংগ্রেস আজ আবার ধসে যাওয়ার মুখে। নিন্দুকে চিরকাল বলে এসেছে, গান্ধী পরিবারের ট্যাগ না থাকলে কি কংগ্রেস চলতে পারে না? উত্তরটা কিন্তু দলের নবীন-প্রবীণ লোকজনই এবার দিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা কেউই আর রাহুল গান্ধীর ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলাতে নারাজ। তাই দলের মৃত্যুপথযাত্রা ঠেকাতে ভরসা সেই সোনিয়া গান্ধী। এক কঠিন সময়ে তিনি কংগ্রেসের দায়িত্ব নিয়েছেন। সামনেই তিন রাজ্যের ভোট। যার মধ্যে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে ২১ অক্টোবর, ঝাড়খণ্ডে ডিসেম্বর মাসে। যদিও ঝাড়খণ্ড নয়, অন্য দুই রাজ্যের দিকেই আপাতত দেশের নজর। তাই বানপ্রস্থ থেকে ফিরিয়ে আনা হল ৭২ বছরের ‘বিদেশিনী’কেই। অপ্রত্যাশিতভাবেই।
গত লোকসভা ভোটের ফল দেখে কংগ্রেস নিয়ে এত আলোচনা বাতুলতা মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির এই প্রান্তে আলোকপাত করাটাও প্রয়োজন। কেন? মূল কারণ হল, যদি মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার নিরিখে রাজনীতির জমি জরিপ করা হয়, তাহলে দুই রাজ্যেই বিজেপির শাসন-ইতিহাস খুব মসৃণ নয়। শুরু করা যাক মহারাষ্ট্র দিয়ে। রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি মন্তব্য করেছিলেন, গত পাঁচ বছরে গোটা দেশে যত কর্মসংস্থান হয়েছে, তার ২৫ শতাংশই নাকি হয়েছে মহারাষ্ট্রে। যদিও এর বিস্তারিত তথ্য তিনি কিছু দিতে পারেননি। সিএমআইই’র সমীক্ষা কিন্তু বলছে, গত তিন বছরে মহারাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ৪.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪.৬ শতাংশ হয়েছে। তার উপর চাপ রয়েছে কৃষক সমাজের। সব্জির দাম চড়ছে। পেঁয়াজের অবস্থা তো ভয়াবহ! কৃষিঋণ মকুবের কথা আগেই ঘোষণা করেছিলেন ফড়নবিশ। এবং ভোটের ঠেলায় আরও বেশ কিছু প্রকল্পের নিদান দিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে রয়েছে জল সংরক্ষণ এবং সেচ সংক্রান্ত কর্মসূচি। কিন্তু উদ্বেগ বাড়িয়েছে শিল্প। ধাক্কা খেয়েছে একের পর এক বিনিয়োগের সম্ভাবনা। শিল্পে বৃদ্ধির হার গত আর্থিক বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। উপরন্তু গাড়ি শিল্প ধাক্কা খাওয়ায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে পুনের কাছে চাকানে, যা কি না মহারাষ্ট্রের ‘কার হাব’।
যদিও গাড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে হরিয়ানা। গুরুগ্রাম-মানেসর-বাওয়াল এলাকায় ভারতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গাড়ি তৈরি হয়। প্রায় এক বছর হতে চলল, গাড়ি বিক্রির হার তলানিতে। উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি। চলছে কর্মী ছাঁটাই এবং পরিকাঠামোগত খরচ বাঁচাতে দু’-একদিন করে কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে মারুতি সুজুকির মতো কোম্পানিকে। বেকারত্বও বাড়ছে।
অর্থাৎ, দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটেই মসৃণ জয় বিজেপির জন্য অপেক্ষা করে থাকার কথা নয়। তা সত্ত্বেও কেন অ্যাডভান্টেজ নরেন্দ্র মোদি বাহিনী? উত্তর একটাই, দুর্বল বিরোধী। বিশেষত কংগ্রেস। দলত্যাগ করেছেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অশোক তনওয়ার। দলের মধ্যে ক্ষোভের হাওয়া, রাহুল গান্ধী যে তরুণ প্রজন্মের কাঁধে কংগ্রেসের দায়িত্ব সঁপেছিলেন, কোপ পড়ছে তাঁদের উপর। সোনিয়া গান্ধী কার্যকরী সভানেত্রী হয়ে ফিরে আসার পর প্রবীণরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। কুমারী সেলজাকে প্রদেশ সভাপতি করার পর হরিয়ানায় যে তিক্ততা আরও বেড়েছে। পাশাপাশি উঠছে নির্বাচনী টিকিট বিলি নিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও। মহারাষ্ট্রেও সঞ্জয় নিরুপমের মতো কংগ্রেস নেতা দলের বিরুদ্ধে চাপা বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছেন। শচীন পাইলট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, বা আর এক রাহুল-ঘনিষ্ঠ মিলিন্দ দেওরাও ক্ষোভ চেপে রাখেননি। ত্রিপুরার প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি প্রদ্যোৎ দেববর্মন তো সরাসরি দাবি করেছেন, রাহুল গান্ধীর হাত ধরে উঠে আসা তরুণ নেতৃত্বকে নানাভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে দলে।
এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। সোনিয়া গান্ধীর হাতে কোনও জাদুকাঠি নেই। একের পর এক ভোটে বিপর্যয়ের কাহিনী কংগ্রেসের মনোবলে বড়সড় আঘাত হেনেছে। মাঝে রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন ছাড়া গত এক দশকে রাহুল গান্ধী এবং তাঁর নব্য ব্রিগেডের ঝুলিতে তেমন কোনও সাফল্য নেই। মোদি হাওয়া আর নেই বলে গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেস যে প্রচার চালিয়েছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। নোট বাতিল এবং জিএসটি সমস্যাও বিশল্যকরণী হয়ে কংগ্রেসের কাছে দেখা দেয়নি। দেশের মানুষই নরেন্দ্র মোদিকে আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। ভোটার ভরসা রাখেননি কংগ্রেসে। আর এখন দলও হয়তো রাখছে না। কংগ্রেসে সোনিয়া গান্ধীর দাপট এবং জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও যে স্তিমিত হয়েছে, একের পর এক রাজ্যে ‘বিদ্রোহ’ই তার প্রমাণ। সোনিয়া গান্ধীও কিন্তু এবার আর হাল ফেরাতে পারছেন না। তাঁর কাছে এতটা প্রত্যাশা করাটাও অবশ্য অমানবিক। তাঁর বয়স এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও পালিয়ে না গিয়ে সোনিয়া দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন... এটাই অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু দলীয় কোন্দল মিটিয়ে দেশবাসীর মনে কংগ্রেসের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরানোর কাজটা একা সোনিয়া করতে পারবেন না। কারণ এক হাতে তালি বাজে না। দলের প্রত্যেক সদস্যকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেই সমর্থন জোগাতে হতো। যার লেশমাত্র হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে না।
অর্থাৎ বিজেপির সামনে এই দুই রাজ্যে ফাঁকা মাঠই পড়ে রয়েছে। শুধু ঠিকঠাক পাস বাড়িয়ে গোল দেওয়ার অপেক্ষা। পাস বাড়ানো মানে শরিকদের সামলে এগিয়ে যাওয়া। মহারাষ্ট্রে শরিক বলতে শিবসেনা। গত কয়েকটি ভোটের ঠিক আগে শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির একটা দড়ি টানাটানির সমীকরণ দেখা যাচ্ছে। পরে অবশ্য সবই মিটে যায়। আগামী ২১ তারিখের ভোটের জন্য অবশ্য নতুন চমক উদ্ধব থ্যাকারের ছেলে আদিত্য। এই প্রথম থ্যাকারে পরিবারের কেউ নির্বাচনী লড়াইতে আসছেন। আর মনোনয়ন জমা করার সময় আদিত্য নিজেই ঘোষণা করেছেন, এবার হয়তো মহারাষ্ট্র থ্যাকারে পরিবারের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখবে। তারপরও কিন্তু মহারাষ্ট্রে এনডিএ সরকারই হবে। সেই লিখন বদলাতে পারার মতো পরিস্থিতি বিরোধীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব থ্যাকারে নিজে সক্রিয় ভোট রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন কিংমেকার। মারাঠা জাত্যাভিমানকে সামনে রেখে যে আবেগের রাজনীতি তিনি মহারাষ্ট্রে আমদানি করেছিলেন, তাকে রীতিমতো সফলই বলতে হয়। তাঁর দল দীর্ঘকাল যাবৎ মহারাষ্ট্রে এনডিএর সিনিয়র অংশীদার হিসেবেই ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে। বদলটা দেখা যায় ২০১৪ সালে। প্রবল মোদি ঝড়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর মহারাষ্ট্রেও বিধানসভা নির্বাচনে বেশি আসন দাবি করে বিজেপি। শিবসেনা রাজি হয়নি। তাই শেষমেশ দুই পার্টি আলাদা লড়াই করে এবং বিজেপিই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। তখন থেকেই জুনিয়রের মর্যাদায় রাজ্যে বাস করছে শিবসেনা। গত লোকসভা নির্বাচনেও সেই অবস্থানের বদল হয়নি। উপরন্তু যেটা হয়েছে, জাত-ধর্ম-স্থানীয় সত্ত্বার বাধা ভেঙে প্রায় সব ধরনের ভোটারেরই আশীর্বাদ কুড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। উচ্চবর্ণ এবং আদিবাসী, অ-মারাঠি ভোট আগেই বিজেপির ব্যাঙ্কে ছিল। গত ভোটে এই সবের সঙ্গে সঙ্গে মারাঠি এবং মুসলিম ভোটও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। সেই প্রবণতা যদি বজায় থাকে, ভালো মার্জিন নিয়েই এবার ক্ষমতায় ফেরার কথা বিজেপির। যদি না থ্যাকারে ম্যাজিকে সত্যিই কিছু ওলট পালট হয়ে যায়। ওই রাজ্যে থ্যাকারে শব্দটি সত্যিই একটা আলাদা আবেগ। সেক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র বাল থ্যাকারের উত্তরসূরিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখা যেতেই পারে।
আবার হরিয়ানায় গত লোকসভা ভোটে ১০টি আসনই জিতে নিয়েছে বিজেপি। চোখে পড়ার মতো বেড়েছে জাঠ ভোট। যা ২০১৪ সালে মাত্র ১৯ শতাংশ ছিল, সেটাই হয়ে গিয়েছে ৫২ শতাংশ। পাশাপাশি দলিত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষও ঢেলে ভোট দিয়েছেন মোদি বাহিনীকে। তাই পূর্ববর্তী বিধানসভা ভোটে ৯০টির মধ্যে ৪৩ আসন দখল করা বিজেপি নানা দুর্বলতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিরোধীদের দশ গোল দিয়ে এগিয়ে রয়েছে। এবার যদি তারা ৭০টির বেশি আসন মনোহরলাল খট্টরের নেতৃত্বে জিতে নেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কংগ্রেস তো নয়ই, অন্য স্থানীয় দলগুলিও এখানে আপাতত বিজেপিকে বেগ দেওয়ার মতো জায়গায় নেই।
অর্থাৎ, বিষয়টা জলের মতো স্পষ্ট—দু’টি রাজ্যেই বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা প্রবল। কংগ্রেস হয়তো একটা লড়াই দিতে পারত... কিন্তু অর্ন্তদ্বন্দ্বের ঠেলায় তা দূরঅস্ত। সোনিয়া গান্ধী দায়িত্ব নিয়েছেন ঠিকই। তাতে আসন্ন ভোটের সংখ্যাতত্ত্বে বদল আসবে না। তাঁকে এই দল ঢেলে সাজতে হবে। মানুষকে আবার বিশ্বাসের, আস্থার সেই জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বোঝাতে হবে, কংগ্রেস শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু আগামী সপ্তাহের দুই রাজ্যের নির্বাচনে?
কংগ্রেস যদি কিছু করতে পারে, সেটা অপ্রত্যাশিতই হবে।