সেবার নৈমিষারণ্যে দুর্গা পূজোয় শ্রীশ্রীমার কাছে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার সময় মাকে বললাম—মা সংযম সপ্তাহে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু শারীরিক ও সাংসারিক কারণে বোধ হয় যাওয়া হবে না। মা যেন অমৃত ঢেলে দিয়ে বললেন—চেষ্টা করো। মা’ই বলে দিলেন দিল্লীর মাতৃভক্ত পঙ্কজদার ছেলে ডাঃ দুর্গাদাস সেনকে দেখাতে। দিল্লী ফিরে তাঁকে দেখালাম, বললেন—বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন, আমি সংযম করতে বলতে পারছি না। আমি মার কথা বলায় বললেন—মাকে জিজ্ঞাসা না করে সংযম করবেন না। আমার স্বামীও একই শর্তে আমাকে যাবার অনুমতি দিলেন।
১২ নভেম্বর কনখলে সুরত গিরি মহারাজের আশ্রমে দুর্বল শরীর নিয়ে বিকেলে মার কাছে পৌঁছলাম। ডাক্তারের নির্দেশ বলাতে মা বললেন—B class করো। ওষুধ খাও, তবে প্রথম দিন শুধু গঙ্গাজল, আচ্ছা B class ই করো।’ মনে দারুণ শক্তি ফিরে এলো। মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে পরদিন ১৩ই নভেম্বর থেকে সংযম সপ্তাহ শুরু করলাম। বিরাট আশ্রম। করুণারূপিণী শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ীর সান্নিধ্যে, সাধু মহাত্মাদের পুণ্য উপস্থিতিতে, চিরপূত আধ্যাত্মিকভাবের আবেশবিহ্বল কনখলের আকাশ বাতাস কেমন একটা আনন্দের হিল্লোল বহন করে আনছিল তা ভক্তদের আনন্দোজ্বল শান্তমুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিলেন। সাধুমহাত্মাগণ তাঁদের, ভাষণে যখন পূত কনখলের স্থান মাহাত্ম্য ব্যক্ত করছিলেন তখন নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে সত্যিই পুলকিত হচ্ছিলাম। মা দশভূজার মত সাধুমহাত্মা ও অতিথিদের থাকা, খাওয়া, আদর যত্নের পূর্ণাঙ্গীন ব্যবস্থা ইঙ্গিতে করে দিচ্ছেন। গীতার ‘সূত্রে মণি গণা ইব’ শ্লোকটি আমার মনে পড়ছিল। মণিগুলো সুন্দরভাবে গাঁথা আছে কেবল ‘মা’ রূপিনী সূত্রটি তাদের ধারণ করে আছেন বলেই তো। সাধু মহাত্মাদের সাথে মায়ের যে ব্যবহার তা দেখবার মত। প্রতিটি ভক্তের শিক্ষণীয় বিষয়। মা তাঁদের ছোট্ট মেয়ে সেজে বাবাদের উপযুক্ত সম্মান কিভাবে দেবেন তা যেন ভেবে পাচ্ছেন না। যাঁর সামান্য একটু হাসি, দৃষ্টিপাত দেখার জন্য মহাত্মারা ব্যাকুল তিনি তাঁদের কাছে নিজের মহিমা সম্পূর্ণভাবে প্রচ্ছন্ন রেখে ছোট্ট মেয়েটি সেজে বসে থাকেন। মায়ের সেই কিশোরী রূপ ভক্তমনকে আরো আকর্ষণ করে। বাড়ীতে বসে সংযম সপ্তাহের নিয়ম হিসাবে পাঁচ হাজার জপ করতে প্রাণ যেন বেরিয়ে যায়, হাত ব্যথা হয়ে যায়। করতে হয় করি। আর এবারকার সংযম সপ্তাহে মালা করতে হয়নি, মালাই আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। সৎসঙ্গে বসলে আপনা থেকে জপ হয়ে যেতো, চেষ্টা করে করতে হতো না। কোন কষ্ট বা ক্লান্তি বোধ হতো না। শান্ত গম্ভীর আধ্যাত্মিক ভাবে প্লাবিত আকাশ বাতাস কি জানি কোন অজানা রহস্য জড়িত থাকতো। আবিষ্টের মত একটার পর একটা দিন কেটে গেল। ক্ষুধাতৃষ্ণাও একেবারে বিব্রত করে নাই। পরশমণির ছোঁয়ায় লোহাও সোনা হয় শুনেছি। আমাদের মত জন্মজন্মান্তরের শিকড় গাড়া সংস্কারের জীবও সেই মাতৃরূপিণী পরশমণির ছোঁয়ায় জড়তাহীন হয়ে সৎসঙ্গ উপভোগ করতে লাগল। কাজেই কনখলের স্থান-মাহাত্ম্য যে কতোখানি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
সংযম সপ্তাহের ষষ্ঠদিন ১৮ই নভেম্বর মাতৃ সৎসঙ্গের সময় এক ভক্ত মাকে প্রশ্ন করে — মা কখনও মালা জপ করেছেন কিনা। শুনে মায়ের সে কি মধুর হাসি। যুক্ত করে মহাত্মাদের বলছেন — বাবা তবে কি সত্যি কথা বলে দেবো? দোষ হবে না তো? এই ছোট মেয়েটাকে তো তোমরা লেখাপড়া শেখাও নাই, উৎপটাং বলে এই মেয়েটা। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি।’ এই বলে স্থির গম্ভীর সুউচ্চ স্বরে মা বললেন—“তা যদি বল, তবে এই যেসব জায়গায় সব হাতে মালা জপছে, তা এই শরীরটাই জপছে।”
বাসন্তী মৈত্রের ‘মূর্ত্তিময়ী কৃপা মা আনন্দময়ী’ থেকে