বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
তবুও নববর্ষ আসে...। নেই শুধু সেই সুখস্মৃতি। সবই এখন বন্দি স্মার্টফোনে। আক্ষেপ করছিলেন বিশিষ্টজনদের একটা বড় অংশ। যেমন, সর্বভারতীয় প্রাচ্য বিদ্যা অ্যাকাডেমির প্রবীণ অধ্যক্ষ ডঃ জয়ন্ত কুশারী। বলছিলেন, ‘ওইসব চিঠির একটা মূল্য ছিল। বাড়িতে চিঠি এলে সবাই হইহই করে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতো। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে চিঠি আর হাতেই পাইনা। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় স্মার্টফোনেই সেরে ফেলছে এখনকার প্রজন্ম। তাতে মানসিক একটা কষ্ট থাকলেও বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে তো মানতেই হবে।’ আলমবাজার মঠের সম্পাদক স্বামী সারদাত্মানন্দের কথায়, ‘কয়েকবছর আগেও ডাকঘর থেকে গোছা গোছা পোস্টকার্ড আনিয়ে ভক্তদের শুভেচ্ছা পাঠানো হত নববর্ষে। ভক্তরা সেই চিঠি পেয়ে বড্ড খুশি হতেন। আশ্রমে এলে কৃতজ্ঞতা জানাতেন। ওই শুভেচ্ছাপত্র আদান প্রদান বন্ধ কয়েক বছর। এখন ই-মেল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকেই আশ্রমের নানান অনুষ্ঠানের খবরাখবর পাঠানো হয়। এসবের মধ্যে প্রাণ নেই।’
‘প্রাণহীন’ শুভেচ্ছা কিংবা নেমন্তন্নে আর আনন্দ পান না সঙ্গীত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। তিনি বলছিলেন, ‘নববর্ষের সেই চিঠির গুরুত্বটাই ছিল আলাদা। পোস্ট কার্ডে আসত। লেটারবক্স থেকে বের করলেই দারুণ মজা। স্মার্টফোনে শুভেচ্ছা বার্তায় সেই আনন্দ পাই না। শেষ কবে যে ওই মধুমাখা চিঠি হাতে পেয়েছি, তা আজ আর মনে পড়ছে না। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথে আর হয়তো ওই চিঠি হাতে পাবো না। কারণ, রানারের থেকেও লক্ষ গুণ দ্রুতগতিতে খবর বইছে মুঠোফোন।’
সেকালের নববর্ষের স্মৃতিচারণ করছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ডঃ নীরদরঞ্জন ঘোষ। তিনি বলছিলেন, ‘চৈত্রের শেষ থেকেই শুভেচ্ছা-চিঠি আমাদের বাড়ির আসতে থাকতো। বয়োজৈষ্ঠরা তা তুলে ঘরের টেবিলে যত্ন করে চাপা দিয়ে রাখতেন। আমরা সবাই সেই চিঠি বারবার পড়তাম। আমাদের কোন আত্মীয় তা পাঠিয়েছেন, তা নিয়ে আমরা পরিবারে আলোচনা চলত। সে ছিল এক মস্ত আনন্দ। কিন্তু এখন শুভেচ্ছা জানানো সহ সবকিছুই হয়ে থাকে ফোনের মাধ্যমে। আমরা চিঠি লেখাটাই ভুলে গিয়েছি।’ অবসর জীবনেও বহু চিঠি অবশ্য পেয়েছেন নীরদরঞ্জনবাবু। তাঁর কথায়, ‘সেই সব চিঠি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক চিঠি পেয়েছি ক্যুরিয়ারে। কিন্তু কিন্তু আসেনি কোনও আত্মীয় স্বজনের চিঠি। যেখানে লেখা থাকবে নববর্ষের একরাশ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানানোর বার্তা। পাই না একটা পোস্টকার্ডও।’
বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জীবন মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘অধ্যাপনা করার সুবাদে একটা সময় কলেজে নববর্ষের চিঠিপত্র হাতে পেতাম। শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতেন অনেকেই। বড্ড ভালো লাগতো। আমিও তাঁদেরকে পোস্টকার্ডে উত্তর ফিরিয়ে দিতাম। এইসব চিঠি বিনিময়ের মধ্যে একটা আন্তরিকতা ছিল। কালের নিয়মে সে সব এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে। চিঠির আদান-প্রদান আর হয় না বললেই চলে। কারণ বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কেবল পুরানো স্মৃতিকে তো আর আঁকড়ে থাকলে চলবে না, বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে স্বাগত জানাতেই হবে। এবং এটাই যুগ-বিবর্তনের বাধ্যবাধকতা। তাই এই ধরনের শুভেচ্ছা পেতে এখন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।’ তবে ওই অধ্যাপকের আক্ষেপ—‘অতীতের ওই চিঠি আজ হাতে না পাওয়ায় কোথায় যেন একটা কষ্ট অনুভূত হয়।’
তবুও প্রতিবছর নববর্ষ আসে...। ভার্চুয়ালি হলেও বেঁচে থাক বাঙালির এই অহঙ্কার।