যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
১৯৭১-এ বিশ্বনাট্য দিবসের অষ্টম বছরে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত চিলির কবি পাবলো নেরুদা তাঁর অবিস্মরণীয় বাণীতে যে কথা বলেছিলেন তার মধ্যে তিনটিকে ৪৮ বছর পরও খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
‘আমাদের সময়টা দুলছে দুই প্রান্ত ছুঁয়ে। একদিকে রয়েছে (বহুচর্চিত) সত্য, যা আমাদের আর তৃপ্ত করতে পারছে না। অন্যদিকে রয়েছে আশা, যার পূর্ণ চেহারাটা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে আমরা ততটাই একঘেয়েমি-আক্রান্ত, যতটা আক্রান্ত আমরা আজ সাবেকি ঘরানার সিরিয়াল নিয়ে। বুড়ো হতে হতে মৃত্যু হয়েছে বাস্তববাদের। নাট্যকর্মীরা সাবধান, কবর থেকে ভূতকে আর তুলে আনবেন না। আজকের এই জটিল সময়ে এমন থিয়েটার চাই, যা হবে সরল কিন্তু নির্বোধ নয়, সমালোচনামূলক কিন্তু অমানবিকভাবে নির্মম নয়। নাটককে নদীর মতো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে পুরনো তটভূমিগুলি ছাড়িয়ে। স্ব-অর্জিত উপলব্যথিত ছন্দ ছাড়া যার সামনে অন্য কোনও বাধা থাকবে না।’ নেরুদার বাণীর এই চিরকালীন তাৎপর্য অনুধাবনের ১৫ বছর পর ২৫তম বিশ্বনাট্য দিবসের বাণীতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নাইজেরিয়ার নাট্যকার ওলে সোয়িংকা সমকালীন জাতিবিদ্বেষ বর্ণবিদ্বেষের আবহে থিয়েটারকে রাষ্ট্রীয় পীড়নের যন্ত্রগুলোকে ভাঙার পক্ষে আর মানবাধিকারকে অস্বীকার করার বিপক্ষে সক্রিয় হতে আহ্বান জানালেন। বললেন, আজকের থিয়েটারকে নান্দনিক চর্চার পাশাপাশি দুনিয়ার কোণে কোণে নিগৃহীত গরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে সহমর্মিতার সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। নেরুদা থেকে ওলে সোয়িংকার মতো এই সময়ে থিয়েটারে সমাজ, সমকালীনতা আর সম্পর্কের সংকটের সঙ্গে জরুরি সম্পৃক্তির কথা অনেকেই বলেছেন। ২০০২-এর বিশ্বনাট্য দিবসের বাণী দিতে গিয়ে ভারতীয় নাট্যকার গিরিশ কারনাডও এমন ঘটমান বর্তমানকে তুলে ধরলেন যা প্রায় দুই দশক পর আজও অভিন্ন, আজও ঘটমান বর্তমান। গিরিশ কারনাডের উপলব্ধি ছিল, আজকের মতো এত বেশি নাটক পৃথিবীতে আগে ছিল না। মঞ্চ ছাড়াও রেডিও, সিনেমা, টেলিভিশন ও ভিডিও আমাদের প্লাবিত করছে নাটক দিয়ে। যা দর্শকদের ব্যাকুল করতে পারে, ক্রুদ্ধ করতে পারে, তবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ঘটমানকে পাল্টাতে পারে না, একটা বিস্ফোরণের সম্ভাবনা জাগাতে পারে মাত্র। এর বেশি থিয়েটার এগতে পারছে না। গিরিশ কারনাড তাঁর বাণীর অন্তিমপর্বে একটি নির্জলা সত্যকে উচ্চারণ করেছেন, যা আজ যথার্থভাবে প্রাসঙ্গিক। ‘থিয়েটার যখন নিরাপদ থাকতে চায় তখন সে নিজেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানা স্বাক্ষর করে।’
থিয়েটারকে নিরাপদ নির্বিরোধ প্রশান্তির মধ্যে থাকার বিরোধিতা জাঁ ককতো থেকে পাবলো, নেরুদা হয়ে ওলে সোয়িংকা কিংবা চেক নাট্যকার ভাচলাভ হ্যাভেলের মতোই এবারের ফিদেল কাস্ত্রোর দেশের নাট্যকার নাট্যবিদ কার্লোস কেলদ্রোনের জীবন্ত কথাগুলোর মধ্যে আশ্চর্য ব্যঞ্জনায় ধরা পড়েছে। কেলদ্রোন ২০১৯-এর বিশ্বনাট্য দিবসের বাণীর মধ্যে কোনও বিপ্লবী কথা বলেননি, বরং একটি গভীর প্রাচীন সত্যকে উচ্চারণ করেছেন। আজকের নাটক নিরাপদে শুধু সামনের দিকে গতিময় থেকে গতকালের কষ্টের যন্ত্রণার, স্বীকৃতিহীন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে দিন বদলানোর নাট্যচর্চাকে আর পুরনো সেই নাট্যগুরুদের যেন ভুলে না যায়। বাজার নিয়ন্ত্রিত সময়ে দুনিয়া জুড়ে যারা নাট্যচর্চায় মগ্ন তাঁদের সামনে অতীতের আচার্যদের, তাঁদের লড়াই তাঁদের আর্থিকভাবে ডিভিডেন্ড শূন্য থিয়েটারের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ আর দিন বদলের স্বপ্নকে ঠাট্টায় আর উপহাসে, প্রযুক্তি আর বহিরঙ্গের চমকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার প্রবণতা। শুধু সামনে দিকে প্রবল গতিতে ছুটে চলার মনোভাব। কেলদ্রোনের লেখা আধুনিক কিউবান নাটক ‘টেন মিলিয়ন’ কিংবা ‘মিনিস্ট্রিজ অ্যান্ড স্মল পিসেস’ অথবা ‘এভরি সিটি হ্যাজ এসোল’— পড়লে বোঝা যায় ৫৬ বছরের আধুনিক নাট্যচর্চায় সমর্পিত প্রাণ কিউবান নাট্যকার উত্তরাধিকার উপেক্ষা না করে তারই আলোয় সামনের পথে চলতে চান।