যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার করা এই বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফলগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সাহায্য করার চাইতে অনেক বেশি করে গুলিয়ে দেয় আমাদের অঙ্কের যোগ-বিয়োগ। যেমন ধরা যাক, এ বারেই প্রধান এক ডজন এক্সিট পোলের হিসেব মিলিয়ে দেখছি, এনডিএ-র আসন-সংখ্যা সেখানে ২৭৭ থেকে ৩৫২-র মধ্যে, ইউপিএ-এর ক্ষেত্রে তা ৮২ থেকে ১৩২-এর মধ্যে। এক এক সংস্থার হিসেব এক এক রকমের। এবং তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ২৭৭ আর ৩৫২-র মধ্যে পার্থক্যটা প্রায় ১৪ শতাংশ। আবার ধরা যাক, উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিসের হিসেবে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোটকে দেওয়া হয়েছে ৮০টির মধ্যে ৬২-৬৮টি আসন। ওদিকে এবিপি-নিয়েলসেনের হিসেবে এই জোটকে প্রথমে ২২টি আসন দিয়ে পরে করা হয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে কোন হিসেবটাকে জনগণ বেশি গুরুত্ব দেবে? পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যেমন কোনও এক্সিট পোল বিজেপিকে দিয়েছে ১১টি আসন, আবার কোনও সমীক্ষা দিয়েছে ২৩টি। পার্থক্যটা কিন্তু বিস্তর। প্রায় ২৯ শতাংশ। তাই জনসাধারণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খাবে এ ক’দিন। এবং সেই সঙ্গে এটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এমন হবে নাতো যে এদের কারও হিসেবই মিলল না শেষ পর্যন্ত? এক্সিট পোলের ভুল হবার ইতিহাস যে বড্ড দীর্ঘ এবং ক্লান্তিহীন। যেমন হয়েছিল ২০১৫-র দিল্লি বিধানসভার ক্ষেত্রে। কেউই পূর্বাভাস দিতে পারেনি আম আদমি পার্টির ৭০-এর মধ্যে ৬৭টি আসন পাবার মত বিপুল জয়ের। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সমীক্ষাগুলি যে কোনও দলের বিপুল জয়কে ঠিকঠাক ধরতে পারে না অনেক ক্ষেত্রেই। আবার ভুলটা উল্টো দিকেও হয়। অনেক সময় বিজয়ীকে আন্দাজ করতে পারে না। ২০১৫-তে বিহারে নীতীশ কুমারের জয়ের পূর্বাভাসে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ বুথ-ফেরত সমীক্ষা।
এক্সিট পোলের সূত্রপাত হয় বিখ্যাত মার্কিন পোলস্টার ওয়ারেন মিটোওস্কি-র হাত ধরে। ১৯৬৭ সালে। তাই এক্সিট পোলের ইতিহাস মোটামুটি আধ শতাব্দীর। প্রথম এক্সিট পোলটা হয়েছিল সিবিএস নিউজের হয়ে। আমেরিকার কেন্টাকি-র এক স্থানীয় নির্বাচনে। উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই ছিল নির্বাচন এবং ফল প্রকাশের অন্তর্বর্তী সময়ে খানিকটা উত্তেজনার জোগান দেওয়া। কিন্তু ডেটা বা তথ্য সংগ্রহ করে তা নিয়ে কোনও কিছুর পূর্বাভাস করতে গেলে বেশ খানিকটা রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্ব আর তার প্রয়োগ প্রয়োজন। আর সেখানেই ভুল হয় সাধারণ ভাবে।
যেমন দেশের মধ্য থেকে কিছু কেন্দ্র যদৃচ্ছ ভাবে (র্যান্ডমলি) বেছে নিয়ে তাদের মধ্য থেকে আবার বাছতে হয় কিছু ভোটকেন্দ্র। কিন্তু এই বাছাটাই কি ঠিক ভাবে করে উঠতে পারে অধিকাংশ সমীক্ষক সংস্থা? দেশের প্রায় আধাআধি বুথই তো সংবেদনশীল। সেগুলিতে কি সঠিক অনুপাতে পৌঁছায় সমীক্ষকরা? ভোটকেন্দ্রগুলিতে যারা ভোট দিয়ে বের হয় তাদের জিজ্ঞেস করার কথা, তারা কাকে ভোট দিয়ে এলেন। তাও আবার সবাইকে নয়। একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে, যেমন হয়তো প্রত্যেক পঞ্চম ভোটারকে, জিজ্ঞেস করতে হবে। সমস্যা হল অত্যুৎসাহী অন্য ভোটারটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে পারে সমীক্ষায় অংশ নিতে। তবু অগ্রাহ্য করতে হবে তাদের। এসব কি মানা হয় ঠিকঠাক?
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। যাদের জিজ্ঞেস করা হবে তারা সবাই যে অমনি গড়গড় করে বলে দেবে তাদের ভোটটা কাকে দিয়ে এসেছে, তেমনটা হবে না কিছুতেই। কারও মধ্যে দ্বিধা কাজ করবে, কারও বা অবিশ্বাস। অনেকে আবার এসব সমীক্ষায় অংশ নিতে লজ্জা বা অস্বস্তি পায়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা সমীক্ষায় অংশ নিতে বা তাদের মতামত প্রকাশে বেশি আগ্রহী। ওদিকে অপর কোনও দলের সমর্থকরা খুব বেশি তাদের মতামত দিতে চাইছে না। কিন্তু সমীক্ষকের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয় কিছুতেই। তাই সমীক্ষায় কোনও দলের সমর্থন হয়ে গেল বেশি, বাস্তবে হয়তো ততটা সমর্থন নেই সে দলের। ব্রিটেনে যেমন কনজার্ভেটিভ দলের সমর্থকরা কম অংশ নেয় এ ধরনের সমীক্ষায়। একে বলে ‘শাই টোরি ফ্যাক্টর’। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের সময়ও অনেক ট্রাম্প সমর্থক এক্সিট পোলে অংশ নেয়নি বলে সমাজ-বিজ্ঞানীদের ধারণা।
এ সবের মিলিত প্রভাবে এক্সিট পোলের যাত্রাপথ, বিশেষ করে গত দু’দশকের সাফল্যের ইতিহাসটা, বেশ নড়বড়ে। বিশ্ব জুড়েই। আমেরিকার ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডার মত নিয়ন্ত্রক রাজ্যে এক্সিট পোল এগিয়ে রেখেছিল আল গোরে-কে। জিতলেন জর্জ বুশ। ২০০৪ সালে আবার জন কেরি সাড়ে ছয় শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন বুশের থেকে। কিন্তু জিতলেন আবার বুশ। এই ফলের ব্যাখ্যা দিতে মার্কিন সমাজ-বিজ্ঞানীরা আজও হিমশম খেয়ে চলেছেন।
ভারতের ক্ষেত্রেও বুথ-ফেরত সমীক্ষার হতাশ করা পারফরম্যান্স দেখেছি আমরা সাম্প্রতিক অতীতে। ২০০৪ সালে এক্সিট পোলগুলি বাজপেয়ির জয়ের পূর্বাভাস করে। কিন্তু এনডিএ পায় মাত্র ১৮৭টি আসন। ২০০৯তে এক্সিট পোলগুলি মোটের উপর আবার অনুমান করে এনডিএ-র জয়। ফলাফল হয় উল্টো। ২০১৪তে এক্সিট পোলগুলিতে গণ্ডগোল হয় অন্য দিকে। অধিকাংশ পোলই এনডিএ-র জয়ের পূর্বাভাস করেছিল, এটা ঠিক। তবে তাদের বেশির ভাগই অনুমান করতে পারেনি যে এনডিএ ৩৩৬টি আসন পেয়ে ওরকম বিপুল জয় পেতে পারে। তাই, মোটের উপর আমাদের পক্ষে এক্সিট পোলগুলিকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা কঠিন। আর ভরসা করলেই বা কোন সংস্থার পোলে ভরসা করব, সেটাও পরিষ্কার নয়।
অথচ এক্সিট পোলের বিশ্বাসযোগ্যতা এরকম ছিল না একেবারে। ২০০৩ সালে জর্জিয়ার নির্বাচনের পরে নির্বাচনে প্রতারণার অভিযোগ জোরদার হয়। যার মূলে ছিল এক্সিট পোলের সঙ্গে মূল ফল একেবারে না মেলা। এর ফলশ্রুতিতে হয় ‘গোলাপ বিপ্লব’ (‘রোজ রেভোলিউশন’)। আর শেষে এডুয়ার্ড শেভোর্নাৎজে-র পদত্যাগ। দুঃখের বিষয় এই যে, এক্সিট পোলের সেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশ্ব জুড়েই। আর তার মূলে অবশ্যই বেশ কিছু পোলস্টারের অযোগ্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন বুথ-ফেরত সমীক্ষা।
আমরা জানি সবই। তবু, বুথ-ফেরত সমীক্ষাগুলি নিয়েই নাড়াচাড়া করব এ ক’দিন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে ঘুরপাক খাওয়া। আসলে এত সংস্থা এত রকমের পূর্বাভাস দিয়েছে, ২৩ তারিখ ভোটের ফল বেরলে তাদের কোনটা যে মিলবে, আর কোনটা নয়, এমনকী কোনওটাই আদপে মিলবে কিনা, বলা প্রায় অসম্ভব। আপনি যার জয় চাইছেন (রাজ্যে বা কেন্দ্রে), তার আসন-সংখ্যা বুথ-ফেরত সমীক্ষাগুলিতে পূর্বাভাস করা আসন-সংখ্যার চাইতে বেশিও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। আবার মিলেও যেতে পারে কোনওটার সঙ্গে। কিন্তু আমাদের মনেই পড়বে না যে, কার পূর্বাভাস কতটা মিলল, আর কারটা কতটা ভুল। তবু, আগামী ভোটগুলিতে— মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি কিংবা বিহারে—আমরা আবার এক্সিট পোলের হিসেব নিয়ে পড়ব। নির্বাচন এবং তার ফল—এর মধ্যবর্তী দম-বন্ধ-করা ‘স্যান্ডউইচ’ সময়সীমায় এটাই যে সবচেয়ে বড় বিনোদন।