প্যালেস্তাইন, ইহুদি বিদ্বেষ ও আইনস্টাইন
আজীবন ‘ইহুদি বিদ্বেষে’র শিকার। তাই চেয়েছিলেন এক পৃথক ‘ইহুদি রাষ্ট্র’। ইজরায়েল গঠনের পরই ভুল ভাঙে তাঁর। বুঝতে পারেন, নির্মম বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে প্যালেস্তাইনে। শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানীর প্রয়াণবার্ষিকীতে ফিরে দেখা সেই কিসসা।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২২, ২০২৫
আজীবন ‘ইহুদি বিদ্বেষে’র শিকার। তাই চেয়েছিলেন এক পৃথক ‘ইহুদি রাষ্ট্র’। ইজরায়েল গঠনের পরই ভুল ভাঙে তাঁর। বুঝতে পারেন, নির্মম বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে প্যালেস্তাইনে। শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানীর প্রয়াণবার্ষিকীতে ফিরে দেখা সেই কিসসা।
অনিরুদ্ধ সরকার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। গোটা দুনিয়া শিউরে উঠেছে ইহুদি গণহত্যার আসল ছবি প্রত্যক্ষ করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্রই ময়দানে নেমে পড়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কায়মনবাক্যে চাইছেন একটি নিরাপদ আশ্রয়। নতুন দেশ। ইহুদিদের জন্য। ইজরায়েল! তবে সেদেশ তাদের একার হবে না। প্যালেস্তানীয়দের সঙ্গে মিলে মিশে থাকবে ইহুদিরা। সমর্থন আদায়ে চিঠি লিখছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের। আসলে সারাজীবন ধরে ‘ইহুদি বিদ্বেষ’ সহ্য করেছেন তিনি। সাক্ষী থেকেছেন হিটলারের নির্মম অত্যাচারের, গণহত্যার। তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল নাৎসিরা। লুট করা হয়েছিল সম্পত্তি। আজীবন অপমানিত হয়েছে নিজের ধর্মপরিচয়ের জন্য। চাকরি পাননি। খেতে পাননি। এমনকী তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে পর্যন্ত ‘কলঙ্কময়’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাই তো চেয়েছিলেন এমন এক দেশ, যেখানে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারবে ‘ইহুদি’রা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রস্তাবে ইজরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে সমর্থনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও।
১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইন দু’টুকরো করে প্রতিষ্ঠা হল ইজরায়েল। প্রথম প্রেসিডেন্ট ভাইৎজম্যান ছিলেন বিজ্ঞানী, আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইজরায়েলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমেরিকার সমর্থন আদায় করা। ভাইৎজম্যান ও আইনস্টাইনের জোরালো প্রচেষ্টায় তা বাস্তব হয়। আমেরিকা স্বীকৃতি দেয় ইজরায়েলকে। আইনস্টাইনকে ‘সর্বকালের সেরা ইহুদি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন ভাইৎজম্যান। ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার চার বছর পর, ১৯৫২ সালে তাঁর মৃত্যু সেদেশের তৎকালীন নেতৃত্বকে তীব্র সঙ্কটে ফেলে দেয়। ইজরায়েলের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন— তা নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয়। উঠে আসে আইনস্টাইনের নাম। যদিও সেই প্রস্তাব তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
ততদিনে নিজের ভুল আঁচ করতে শুরু করেছেন শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী। প্যালেস্তাইন ইস্যুতে গঠিত অ্যাংলো-আমেরিকান কমিটি অব এনকোয়ারির সামনে প্রকাশও করে ফেলেছেন নিজের সংশয়। ভাইৎজম্যানের সময় থেকে জায়নবাদীদের সন্ত্রাসবাদী আচরণ, হিংসার খবর আস্তে আস্তে দুনিয়ার সামনে আসতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে পশ্চিম জেরুজালেমে প্যালেস্তাইনের গ্রামে ঢুকে গণহত্যার খবর তাঁর কানেও পৌঁছয়। আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব দ্য ফাইটার্স ফর দ্য ফ্রিডম অব ইজরায়েলের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টরকে ৫০ শব্দের চিঠি লিখেছিলেন আইনস্টাইন, ‘যদি প্যালেস্তাইনে সত্যিই চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে, তবে তার জন্য প্রথম দায়ী হবে ব্রিটিশরা, আর তারপরেই থাকবে আমাদের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলি। এমন বিভ্রান্ত ও অপরাধীদের সঙ্গে কাউকে জড়িত দেখতে আমি রাজি নই।’ আজকের গাজা স্ট্রিপের পরিণতি কী তারই ইঙ্গিত করে না? অথচ এমন পরিণতি তিনি কখনও চাননি। বিদ্বেষের শিকার হয়েও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শান্তি-মানবতাকেই রেখেছেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
আইনস্টাইন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিতে গবেষণা করছেন। একদিন দেখা হল রবার্ট ওপেনহাইমারের সঙ্গে। একে অপরকে দীর্ঘদিন ধরে চিনতেন। আমেরিকার পরমাণু মিশন, ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্টে’ দু’জনেই কাজ করেছেন। ওপেনহাইমার ছিলেন সেই প্রোজেক্টের মাস্টারমাইন্ড ও আইনস্টাইন ছিলেন সমর্থক। জার্মানির নাগরিক হওয়ায় আইনস্টাইনের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি আমেরিকা। সেই কারণে তিনি ছিলেন এই প্রোজেক্টের বাইরে, যাঁর হাত ধরে আবিষ্কার হয় পরমাণু বোমা। ওপেনহাইমার খ্যাতি পান ‘দ্য ফাদার অব অ্যাটম বম্ব’ নামে। ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট দুই জাপানি শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে দু’টি পরমাণু বোমা ফেলে আমেরিকা। ধ্বংস হয়ে যায় জাপানের দু’টি শহর।
বোমা ফেলার পর হঠাৎ করে বদলে যান ওপেনহাইমার। বললেন, পরমাণু অস্ত্র তৈরি ‘শয়তানের কাজ’। তাঁর বাকি জীবন কাটে দোলাচলের মধ্যে। একদিকে নিজের কাজ নিয়ে যেমন গর্বিত ছিলেন, তেমনই এর পরিণতি নিয়েও ভুগেছেন অপরাধবোধে। এই অপরাধবোধ থেকে ওপেনহাইমার একদিন আইনস্টাইনকে বলেন, ‘বিজ্ঞানের নিজস্ব প্রভাবগুলি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য মানবিকতার প্রয়োজন।’ আইনস্টাইন মৃদু হেসে উত্তর দেন—‘তাহলে পরমাণু বোমা বানানোর প্রোজেক্টে যোগ দিয়েছিলেন কেন?’ ওপেনহাইমার জানান, জেদ বলতে পারেন বা নেশা। আর বলতে পারেন বিশ্বের এক নম্বর বিজ্ঞানী হওয়ার পাগলামো। আপনি তো মার্কিন সরকারকে চিঠি লিখে সচেতন করেছিলেন। তাতে কী লাভ হল!’ আইনস্টাইনের জবাব ছিল, ‘লিখেছিলাম। রুজভেল্টকে আগাম সতর্ক করেছিলাম। ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী পরমাণুকে নিউট্রনের আঘাতে দু’টুকরো করা সম্ভব হয়েছিল জার্মানির গবেষণাগারে। আমি চিন্তিত ছিলাম হিটলার এর প্রয়োগ করতে পারে ভেবে। চেয়েছিলাম জার্মানির আগে আমেরিকা পরমাণু বোমা আবিষ্কার করুক, যার ফল হবে মানবতার পক্ষে। কিন্তু তা হল না। এটাই দুঃখের।’
শোনা যায়, এর পরিপ্রেক্ষিতে ওপেনহাইমারের এক অমর উক্তি— ‘এক তরুণ ইহুদি ছাত্রের রচিত E=mc2 সূত্রের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল পরমাণু বোমা। আর সেটা আপনি মিস্টার আইনস্টাইন। আমি আর আপনি—দু’জনেই ইহুদি। পরমাণু বোমা দুই ইহুদির আবিষ্কার!’ একথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন। আসলে শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানীকে মানবিক করে করেছিল জাতি ও ধর্মীয় বিদ্বেষের পরিবেশ এবং দু’টি বিশ্বযুদ্ধ। ছোটবেলা থেকে ইহুদি-বিদ্বেষ দেখতে দেখতে বড় হওয়া। বিশ্বব্যাপী ইহুদি বিদ্বেষের বিষাক্ত ভাবনার কারণে পৃথিবীর যে দেশেই তিনি গিয়েছেন, সেখানে এই ঘৃণার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। জাতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। ধর্মীয় বিভেদ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
আইনস্টাইন যখন স্কুলছাত্র, সেই সময় জার্মানিতে প্রাথমিক স্কুলগুলি ধর্মের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। মা-বাবার যা ধর্মবিশ্বাস, সেই অনুসারী স্কুলেই ছেলেমেয়েকে পড়তে যেতে হতো। আইনস্টাইনের পরিবার ধর্মবিশ্বাসে ছিল ইহুদি। কিন্তু অ্যালবার্টের বাবার ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তিনি ছিলেন উদারপন্থী। জার্মানির মিউনিখ শহর ছিল প্রধানত রোমান ক্যাথলিকদের শহর। সেখানে ইহুদিদের জন্য আলাদা কোনও স্কুল ছিল না। যে কারণে বাবা-মা একটি ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেন অ্যালবার্টকে। স্কুলে তাঁর দৈনন্দিন পাঠের একটি বিষয় ছিল রোমান ক্যাথলিক ধর্মশিক্ষা। ধর্মশিক্ষা ও সেনাবাহিনীর নিয়মতান্ত্রিক জীবন ছিল অ্যালবার্টের একেবারেই অপছন্দের তালিকায়। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও মনেপ্রাণে বোহেমিয়ান। ক্লাসের একজন শিক্ষক ভাবতেন, পৃথিবীর সমস্ত লোক ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী হওয়া উচিত। আর জার্মানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, অন্যেরা নিম্নবর্গীয়। মিউনিখের এই ধর্মীয় ঘেরাটোপের স্কুলে খুব বেশিদিন মন টেকেনি অ্যালবার্টের। একদিন সে পরিচিত ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ভগ্নস্বাস্থ্যের একটা মিথ্যা সার্টিফিকেট দাখিল করে পালিয়ে গেল বোর্ডিং স্কুল থেকে। হাজির হলেন মিলানে। সেখানে ছ’মাস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটে। একদিন সেখানেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—‘আমি জার্মান নই।’
এরপর সুইজারল্যান্ডে যান আইনস্টাইন। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। যুবক বয়সে চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা করতে। কিন্তু চাকরি জুটল না। কারণ তিনি ‘ইহুদি’। আর কে না জানে, ইহুদিরা বিশ্বাসযোগ্য নয়! অতএব চাকরির আশা ছাড়তে হল। কয়েকজন ছাত্র পড়িয়ে সামান্য টাকায় দিন গুজরান হতো। তাও একদিন বন্ধ হয়ে গেল। কপর্দকশূন্য অবস্থায় জুরিখের রাস্তায় ভিক্ষে করার মতো দশা। ছ’মাস প্রায় অনাহারে দিন কাটল। এই সময় মার্শেল গ্রসম্যান নামে এক কলেজ বন্ধুর সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা আইনস্টাইনের। বন্ধুর অবস্থা দেখে দয়া হল মার্শেলের। সুইজারল্যান্ডের বার্নে একটি সরকারি পেটেন্ট অফিসের অধিকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের এবং একটি চাকরি দেওয়ার জন্য অনুরোধও করলেন। দীর্ঘ ইন্টারভিউ শেষে পেটেন্ট অফিসের অধিকর্তা বললেন, ‘সরকারি পর্যায়ে কাজ করতে হলে তোমাকে সুইজারল্যান্ডের নাগরিক হতে হবে।’
‘আমি সুইজারল্যান্ডের নাগরিক।’ আইনস্টাইনের কথায় আধিকারিক অবাক। বললেন, ‘কীভাবে?’ বিজ্ঞানী ধীরভাবে বললেন, ‘স্যার, কলেজে ছাত্রাবস্থায় আমি অল্প পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। নাগরিকত্ব আবেদনের জন্য অনেক আগেই এদেশে ফি প্রদান করেছি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেকে জার্মান বলে মনে করি না। সুইজারল্যান্ড আমার খুব প্রিয়। সেই কারণেই আমি এখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ কাজটা শেষ অবধি জুটে গিয়েছিল। এই অফিসে থাকাকালীনই আবিষ্কৃত হয় আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের চমকে দিলেন আইনস্টাইন। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে লাগল বক্তৃতাদানের জন্য।
প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাইছিলেন পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক পদে। এই নিয়োগ সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটির মিটিংয়ে একটিমাত্র বিষয়েই প্রশ্ন উঠেছিল—‘আইনস্টাইন ইহুদি।’ সেই টানাপোড়েন শেষে তিনি যোগ দেন প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে প্রাগের রাস্তায় ভ্রমণের সময় আইনস্টাইন প্রায়শই জার্মান-চেক মন কষাকষির আভাস পেতেন। সেখানে থাকাকালীন ইউরোপের ইহুদিদের বিভিন্ন সমস্যার সংস্পর্শে এসেছিলেন শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইহুদি বিদ্বেষের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক নেতারা এই ধারণা প্রচার করতে থাকে, পৃথিবীতে যত কিছু অন্যায় হয়েছে, তার জন্য দায়ী ইহুদিরা।
বার্লিনে এই বিদ্বেষ তখন আরও উগ্র আকার ধারণ করেছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ‘আমাদের সব দুর্ভাগ্যের জন্য ইহুদিরাই দায়ী। ইহুদিদের জন্যই আমরা জার্মানিতে অনাহারে মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছি। যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য দায়ী ইহুদিরা...।’ এসব শুনে আর চারপাশের বিদ্বেষ দেখে ইহুদিদের জন্য লড়াই করা বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনে নাম লেখান আইনস্টাইন। এতে তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি আরও বৃদ্ধি পেল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক এক বছর পর ফের উগ্র সমর্থকদের নিয়ে প্রকাশ্যে এলেন হিটলার। লক্ষ্য—ক্ষমতা দখল। আইনস্টাইন তখন প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমিতে কাজ করছেন। সেখানে তাঁর অবস্থা ক্রমশ সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল। ইহুদি বিরোধী মনোভাব তখন জার্মানিজুড়ে বিরাট ‘জাতীয়তাবাদী’ আকার নিয়েছে। প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমিতে তাঁর বক্তৃতাকালে ছাত্ররা তাঁকে বাধা দিয়ে চিৎকার করত—‘ইহুদিরা নিপাত যাক... ইহুদিদের মেরে হটাও...।’
সেই সময়েরই ঘটনা। আইনস্টাইনকে অপদস্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লাগলেন এক খ্যাতনামা জার্মান বিজ্ঞানী এবং তাঁর অনুগামীরা। আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে অন্য এক বিজ্ঞানীর কাজ বলে প্রচার শুরু করলেন। রাতারাতি বিশুদ্ধ আর্যরক্তের এক বিজ্ঞানীকে ‘আইকন’ হিসেবে তৈরি করা হল বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে। আর ছাত্রদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ইহুদি আইনস্টাইন আসলে ভণ্ড! দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।
ব্রিটেনে থাকাকালীন একদিন লন্ডনের কিংস কলেজে বক্তৃতা দেবেন আইনস্টাইন। কিন্তু কোন ভাষায় বক্তৃতা দেবেন? জার্মান নাকি ইংরেজিতে? তা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে প্রবল গোলমাল বাধল। আইনস্টাইন ‘ইহুদি’ বলেও আওয়াজ ওঠে। মঞ্চে আসীন এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘আইনস্টাইন এযুগের নিউটন’। আর তারপরই বলতে ওঠেন আইনস্টাইন। নিউটনকে নিয়ে। হাততালির বন্যা বয়ে যায়।
হিটলারের নেতৃত্বে প্রচার অবশ্য থামেনি—‘আইনস্টাইন একজন বিপজ্জনক লোক।’ তাঁকে হত্যার ছক কষতে লাগল নাৎসি বাহিনী। এই সময় আইনস্টাইনের সহযোগী ইহুদি দার্শনিক থিয়োডার লেসিংকে গুলি করে হত্যা করে হিটলার-বাহিনী। জার্মানির বিদেশমন্ত্রী ওয়ালথার রাথেনাউ ছিলেন ইহুদি। নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাননি তিনিও। গাড়িতে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার ফলে আইনস্টাইনের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। বেলজিয়াম রাজপরিবারের আতিথেয়তা রক্ষা করতে গেলে যেমন তাঁকে পুলিসি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনই লন্ডনের গ্রামে অবকাশ যাপনেও তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হতো একদল ইংরেজ সৈনিক।
১৯৩২ সালে হিটলার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের এত কাছাকাছি আসেন যে পরবর্তী কয়েক মাসে জার্মানির প্রতিনিধি সভা ‘রাইখস্ট্যাগ’ সম্পূর্ণ ভেঙে দেন। তারপর স্বহস্তে সমস্ত শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। চ্যান্সেলর হন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। শুরু হয় ইহুদি নিধন যজ্ঞ। হিটলার ঘোষণা করলেন—ইহুদি আইনস্টাইনকে ‘সৎ জার্মান’ বলে ভাবা যায় না এবং সেই কারণেই তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব হল ‘কলঙ্কময় তত্ত্ব’।
আইনস্টাইনকে সাংবাদিকরা সেকথা জানায়। তাঁর জবাব ছিল, ‘বিজ্ঞানীর স্বরূপ আর রাজনীতির স্বরূপ আলাদা। আমি একজন বিজ্ঞানী। নাৎসিদের মনগড়া যুক্তি আর কাল্পনিক ইতিহাস বোঝার চেষ্টা আমি করি না। আমার যুক্তিগুলো বুদ্ধিমানদের জন্য। যারা বিচার-বিশ্লেষণ বোঝে, তাদের জন্য। অন্ধ ভক্ত এবং অনুগামীদের জন্য নয়।’
আইনস্টাইনের বয়স বাড়ছিল। ওই বয়সেও এদেশ-সেদেশ ঘুরছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন। ইহুদিদের সমস্যা নিয়ে লড়ছেন। বেলজিয়ামে যাওয়ার সময় জাহাজেই খবর পেলেন যে ক্যাপুথে তাঁর বাসভবন লুট হয়েছে। নাৎসিদের অভিযোগ, আইনস্টাইন বাসভবনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রেখেছেন। মারাত্মক অস্ত্রের সন্ধানে তারা ড্রয়ার নামিয়ে, নিভৃত কক্ষ খুলে গোটা বাড়ি তছনছ করে দেয়। গোটা তল্লাশিপর্বে একটি ‘মারাত্মক’ জিনিস উদ্ধার হয়েছিল— পাউরুটি কাটার ছুরি। সেই জিনিসটি তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায় প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে। আর অভিযোগপত্রে লেখে—‘ছুরি হল একটি মারাত্মক অস্ত্র, যা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বাড়িতে রেখেছেন। তিনি রাষ্ট্রের একজন শত্রু।’ শুনে বিজ্ঞানী মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘পূর্ববর্তী বছরগুলিতে আমার গ্রীষ্মাবাসে শুধুমাত্র ভদ্রলোকেরাই জোর করে ঢুকত। আর এখন...।’ প্রায় একই সময়ে খবর এল, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আইনস্টাইনের সমস্ত আমানত বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে নাৎসিরা। এই সামান্য অর্থই ছিল তাঁর সর্বশেষ সম্বল।
এসবের মধ্যেই ‘দ্য ব্রাউন বুক অব হিটলার টেরর’ নামে একটি বই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। কারণ, এই বইয়ের সম্পাদনা করেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। বইটিতে নাৎসিদের সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের একটি দীর্ঘ তালিকা ছিল। এই বই প্রকাশের পর নাৎসিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঘোষণা করে—আইনস্টাইনের মাথার জন্য দেওয়া হবে এক সহস্র পাউন্ড। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কেউ আইনস্টাইনকে হত্যা করলে সে-ই পাবে এই বিপুল অঙ্কের পুরস্কার। আইনস্টাইন একদিন একথা শুনে বললেন, ‘আমার মাথার যে এত দাম হতে পারে, তা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি।’ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হিটলারের নেতৃত্বে একটি বই পোড়ানো কর্মসূচিও নেওয়া হয়।
আইনস্টাইন তখন আমেরিকার সম্মাননীয় নাগরিক। প্রিন্সটনে থাকতে শুরু করেছেন। সেসময় একদিন খবর এল, নাৎসিরা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। নৌকা, বাসভবন সহ সবকিছু বেহাত হয়ে গিয়েছে। ততদিনে বার্ধক্যের ছাপ বিজ্ঞানীর মুখে। যদিও তিনি আগের মতোই ঢলঢলে ওভারকোট আর মাথায় টুপি পরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। টুপির তলায় লম্বা সাদা চুল হাওয়ায় উড়ত। মুখে লেগে থাকত হাসি। সঙ্গী বলতে ছিল মূল্যবান বেহালাটি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩৪ সালে উদ্বাস্তু ইহুদিদের সাহায্যার্থে ম্যানহাটানে ভায়োলিন রিসাইটালে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। প্রবেশমূল্য ছিল মাথাপিছু ২৫ ডলার। ২৬৪ জন শ্রোতা নাকি সেই রিসাইটাল শোনেন!
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের অনুরোধে বিশ্বশান্তির জন্য খসড়া লিখতে শুরু করেছিলেন শতাব্দীর সেরা এই বিজ্ঞানী। তা অবশ্য শেষ করতে পারেননি। মৃত্যুর এক বছর আগে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উন্মাদনা দেখে ইহুদি দার্শনিক এরিক গুটকিন্ডকে এক চিঠিতে একরাশ বিরক্তি সহকারে লিখেছিলেন, ‘ইহুদি ধর্ম আমার কাছে কিছু কুসংস্কারের প্রতিফলন মাত্র...।’
১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল অসুস্থতা নিয়ে প্রিন্সটন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আইনস্টাইন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা সার্জারির কথা বলেন। আইনস্টাইন স্পষ্ট জবাব, ‘আমার যখন ইচ্ছে হবে, চলে যাব। কৃত্রিমভাবে আয়ু বাড়িয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন।’ চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহ দাহ করে সেই অস্থি এবং ছাই যেন গোপনে কোনও নদীতে বিসর্জন করা হয়। কোনও অন্তিম শোভাযাত্রা বা সমাধির উপর কোনও স্মৃতিস্তম্ভ, পার্ক বা মিউজিয়াম গড়ে উঠুক, এমনটা চাননি। বন্ধু ওটো নাথন সবার অলক্ষ্যে ডেলাওয়ার নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আইনস্টাইনের চিতাভস্ম। বন্ধুর শেষ ইচ্ছার পূর্ণ মর্যাদা!
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
আজকের রাশিফল (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
এখনকার দর
-
নিফটি ব্যাঙ্ক (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
নিফটি ৫০ (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ইউরো (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
পাউন্ড (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ডলার (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
রূপোর দাম (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
সোনার দাম (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
সোনার দাম (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
রুপোর দাম (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ডলার (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
পাউন্ড (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
ইউরো (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025