মানবধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ
বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির দেশ ভারতবর্ষ। ভারতের ভৌগোলিক সীমা বুঝিয়ে দেয়, ভাষার বহুত্ব সংস্কৃতিরই বহুত্ব। ভৌগোলিক সীমাকে পরোয়া করে না সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ধর্ম।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
মে ৪, ২০২৫
সুখেন বিশ্বাস: বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির দেশ ভারতবর্ষ। ভারতের ভৌগোলিক সীমা বুঝিয়ে দেয়, ভাষার বহুত্ব সংস্কৃতিরই বহুত্ব। ভৌগোলিক সীমাকে পরোয়া করে না সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ধর্ম। তাই একই ভৌগোলিক সীমায় হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। যখন ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বা পাড়ায়-পাড়ায় গোলমাল বাধে বা রাজনৈতিক দলাদলি শুরু হয়, তখন কিন্তু ধর্মের কথা আসে না। ধর্মের কথা কখন আসে? যখন একটি ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের বিরোধ হয়, তখনই বড় হয়ে ওঠে ধর্মের পরিচয়। তাতে যদি আবার রাজনীতির রং লাগে, তখন আমরা ভুলে যাই কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান, কে বৌদ্ধ, কে-ই বা জৈন।
একথা ঠিক, ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য না বুঝতে পারার কারণেই যত হানাহানি। পৃথিবীতে আজ মানুষে মানুষে যে বিরোধ, সংঘর্ষ, রক্তপাত বা যুদ্ধ, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। প্রকৃত অর্থে না দেখে ধর্মকে দেখা হচ্ছে সংকীর্ণ অর্থে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কখনওই সংকীর্ণ অর্থে ধর্মকে দেখেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাখি উৎসবের কথা। রাখির সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে বহু আগে থেকে। সেখানে ধর্ম যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। রয়েছে আবেগও। মহাভারতে কথিত আছে, শিশুপাল বধ-পর্বে শ্রীকৃষ্ণের রক্তাক্ত হাতে ওড়না বেঁধে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী। ভাইকে রক্ষায় বোনের সেই বাঁধন দেশজুড়ে পালিত হয় রাখি বন্ধন উৎসবের মাধ্যমে। আবার বঙ্গভঙ্গ আইনে যখন ভাগ হচ্ছে দুই বাংলা, সেই অশান্ত মুহূর্তকে রাখির মাধ্যমে সম্প্রীতির বন্ধনে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আশ্বিনের সেই শুভক্ষণ (১৬ অক্টোবর ১৯০৫, বাংলায় ৩০ আশ্বিন), সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন উৎসবটি স্থান পেয়েছিল পঞ্জিকাতে।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যাচ্ছে, এই উৎসবের মন্ত্র বলে দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর। শুধু তাই নয়, এই উৎসবকে সেই সময় পঞ্জিকাতেও স্থান দিয়েছিলেন তিনিই। যদিও পরবর্তীকালে বিষয়টা পঞ্জিকাতে আর থাকেনি। তবুও শ্রাবণ পূর্ণিমার রাখি উৎসবেই বারবার ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। কারণ ভাই-বোনের সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে গোটা সমাজকে যে একসুতোয় বাঁধার উৎসবই যেন রাখিবন্ধন। এই উপলক্ষে তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত একটি গান, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—/ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’ কলকাতা সহ গোটা বাংলাজুড়ে এখনও প্রতি বছর সম্প্রীতির লক্ষ্যে ৩০ আশ্বিন রবীন্দ্রনাথের স্মরণে রাখি বন্ধন পালিত হয়। তবে এই রাখির সঙ্গে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার রাখির কোনও সম্পর্ক নেই। এই রাখির মূল উদ্দেশ্যই হল মানবিকতা, সম্প্রীতি ও একতা। ভাই-বোনের নয়, সেই সময় রাখি বন্ধন রূপান্তরিত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতি উৎসবে।
বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সংঘর্ষ বা রক্তপাতের অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের বিষয়টা চলে আসছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ধর্ম কী? উত্তরে বলা যায়—যা ধারণ করে, তাই ধর্ম। যে সমস্ত বিষয় মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে, তাকেই ধর্ম বলে। অনেকেই বলেছেন, বেদের অনুগমনই ধর্ম। তাই যদি হয়, তবে নিশ্চিতরূপেই ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা জৈন ইত্যাদি ধর্ম নয়। কিন্তু সবাই জানেন যে, এগুলি ধর্ম। এই সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অসংখ্য। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রিলিজিয়নকে একাকার করে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন নহে।’ তাঁর মতে, মনের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতার কোনও জায়গা নেই ধর্মের মধ্যে। রিলিজিয়নের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস, যা কি না বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করে। আর ধর্ম মনুষ্যত্বের সঙ্গে যুক্ত, আনন্দ বা কল্যাণ শব্দের সমার্থক। তাই তাঁর দৃষ্টিতে বেদ, উপনিষদ, কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক সবই এক।
পৃথিবীতে একটাই জাতি, তা হল মানব জাতি। একটাই ভাষা, তা হল মানবতার ভাষা। একটাই ধর্ম, তা হল মানবধর্ম। প্রশ্ন এখানেই, তবে পৃথিবীতে কেন ভাষার জন্য, ক্ষমতার জন্য, ধর্মের জন্য এত হানাহানি? এত রক্তপাত? আধুনিক ভারতের প্রধানত দু’টি সমস্যা হল, ভাষাগত ও ধর্মগত। মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষাও যে মানুষেরই ভাষা, তা আজও আমরা ভেবে উঠতে পারিনি। নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য মানুষের ধর্ম (রিলিজিয়ন) যে আমাদেরই ধর্ম, সেটাও ভেবে উঠতে পারিনি। এর মূলে রয়েছে সমতার অভাব, সমস্যা-সমাধানের প্রতি অনীহা। প্রকৃত শিক্ষার অভাব, মানুষের মনের বিকৃতিই কাজ করছে রক্তপাত, হানাহানির ক্ষেত্রে। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরণে যে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটল তার মূলেও রয়েছে ধর্মগত সমস্যা। ধর্ম আর রিলিজিয়ানের তাৎপর্য বুঝতে না পারার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলেছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, আগুন, রক্তপাত, নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এমনকী ইজরায়েলি হামলায় গাজার ভয়ঙ্কর পরিণতির নেপথ্যেও রয়েছে মানবধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবান না হওয়া।
মানবধর্মে প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় ও কর্মে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির আলো জ্বেলেছেন। উভয় ধর্মের মানুষের হাতে রাখিও পরিয়েছেন। রানী চন্দ সম্পাদিত ‘ঘরোয়া’তে রবীন্দ্রনাথের সেই লড়াইকে তুলে ধরছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখেছেন, ‘ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চারদিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল—সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল একগাদা রাখি। সবাই এ ওঁর হাতে রাখি পরালুম। অন্যরা যারা কাছাকাছি ছিল তাদেরও রাখি পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখি পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিসকে হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন রবিকাকা। রাখি পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ব। হঠাৎই রবিকাকার খেয়াল গেল, চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখি পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব। রওনা হলুম সবাই। গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবীদের হাতে রাখি পরিয়ে দিলুম। ওরা একটু হাসলে মাত্র।’
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, মানবিকতাবোধ শুধুমাত্র ভৌগোলিক সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে তা প্রসারিত হওয়ার মধ্যেই রয়েছে বিশ্ব মানবিক ভাবনা। মানুষকে বড় করে দেখার মধ্যেই রয়েছে মানুষের সার্থকতা। তিনি ভাবের ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষকে বিচার করেছেন। চিত্তের ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষকে চিহ্নিত করেছেন। যেখানেই মনুষ্যত্বের দীনতা, সেখানেই তিনি বেদনা পেয়েছেন। আর দীনতা বলতে তিনি কখনও অর্থনৈতিক দীনতাকে বোঝাননি। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় মেরুকরণের যে চেষ্টা চলেছে, রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এই সমস্ত বিষয় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর অজস্র লেখায় তার প্রমাণ রয়েছে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। মুসলিম যুবক আকুল সরকার ও হিন্দু কন্যা লতার ভালবাসার বিবাহ নিয়ে ঘনিয়ে-ওঠা সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মোকাবিলাও করেছিলেন তিনি। মনে পড়ে যাচ্ছে একটি ঘটনার কথা। ১৯২২ সালে কালিদাস নাগ বিলেত থেকে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কী?’ চিঠির উত্তরে কবি লিখলেন—‘খিলাফত উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।... অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মত মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুতেই নেই।’ শেষে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখলেন, ‘আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসবো।’ উল্লেখ্য, মুসলমানের বৈশিষ্ট্য ও ভারতবর্ষে তাদের অধিকারের বিষয়টা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে। এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোন মতেই নিস্তার নাই।’
এ দেশে জন্মগ্রহণ করলেও কখনওই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বা শ্রীঅরবিন্দর মতো সাধক ছিলেন না। তাঁদের আনন্দ বা ধর্মবোধ কখনওই তাঁকে নাড়া দেয়নি। তাঁর ধর্মভাবনাজুড়ে ছিল হৃদয়-অনুভূতি, উপলব্ধি, মানবপ্রেম। মানব মনের ক্ষুদ্রতাকে এগুলির মাধ্যমে তিনি অতিক্রম করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন অখণ্ড চেতনা অনুসন্ধান করার এক অমোঘ শক্তি।
বেশিরভাগ ভারতীয়দেরই বিশ্বাস বা ধারণা, পুজো, বিধিনিষেধ, রীতি-নীতির মূলে রয়েছে ধর্ম। পুরোহিত, যাজক, মৌলবি প্রমুখ ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনেই সমাজ-সংস্কারে ধর্মীয় কাজ সারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ধর্মে বিশ্বাস করতেন, সেটা কোনওভাবেই পুজো-আচ্চা বা বিধি-নির্ভর নয়। ‘রক্তকরবী’ নাটকে তিনি রাজা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মানুষের দু’টি সত্তার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, একই দেহে রাম ও রাবণের উপস্থিতি। সেখানে অকল্যাণকে পিছনে ফেলে কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে ধর্মের অবস্থান। সেটি আসে প্রেমের পথে, প্রীতির পথে। ‘রক্তকরবী’ নাটকে প্রেম ও প্রীতির পথেই মকররাজকে অকল্যাণ থেকে কল্যাণের পথে ফিরিয়ে আনে নন্দিনী। তাঁর মতে, ধর্মীয় উত্তেজনা সমাজে উগ্রতা ছড়ায়। মানুষের মনকে সঙ্কুচিত করে। সচল সমাজকে রূপান্তরিত করে অচলায়তনে। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সম্রাট আকবরের কথা। কারণ আকবর সকল ধর্মের বিরোধ খণ্ডন করে মানুষের মধ্যে প্রেমের ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মনকে কখনওই ভৌগোলিক সীমার দ্বারা আটকানো যায় না। তাঁর মতে, কোনও ধর্মই মানুষের মনকে অন্যের থেকে আলাদা করতে পারে না। সকল মনের মধ্যেই একটি ঐক্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সবসময় মানব-ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মানবতার ধর্মে আলাদা করে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন বা খ্রিস্টানদের কথা নেই। রয়েছে মানুষের কথা। এখানেই খোঁজ মেলে তাঁর বিশ্বমানবতাবোধ, বিশ্বসৌভ্রাতৃত্ববোধের। মানবধর্মের ধারণায় তাঁর দৃষ্টিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক ইত্যাদি। ধর্মের নাম করে যেসব মানুষ পৃথিবীতে হিংসার আগুন ছড়িয়েছে, তাদেরকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। আনন্দ-জগতের সন্ধানের লক্ষ্যে তিনি বারবার ব্যক্তি-স্বার্থের জগতকে অতিক্রম করার কথা বলেছেন। ব্যক্তি মানুষের মধ্যেই যে মনের মানুষ রয়েছে, তা অনুভব না করে কিছু মানুষ বাইরে তা অনুসন্ধান করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে/দেখতে আমি পাইনি।/বাহিরপানে চোখ মেলেছি,/হৃদয় পানেই চাইনি।’ পাশাপাশি, নিজের অন্তরকে জাগানোর কথাও বলেছেন—‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে।/একেলা রয়েছে নীরব শয়ন-‘পরে/প্রিয়তম হে জাগো জাগো।’ একথা বলার অপেক্ষা থাকে না মানবধর্মে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই মনুষ্যত্বের জাগরণ চেয়েছেন, মানুষের জয়গান গেয়েছেন, ‘জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই /চিরজীবিতের!’ জীবনের শেষ সময়েও তিনি মহামানবের আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে /মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে।’
যারা পৃথিবীর বুকে অবহেলিত, যারা সভ্য মানুষদের কাছে নিপীড়িত, নিরাশ্রয়—তাদেরকে আপন করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশি বা বিদেশি নয়, সকলের দুঃখে তিনি দুঃখী হয়েছেন। সকলের সুখে হয়েছেন সুখী। একটি ঘটনা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য—‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কবি গেলেন শিলাইদহে। দেখলেন, তাঁর প্রজাদের বসার জন্য তিন রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের জন্যে রয়েছে উচ্চাসন। তার নীচে ভূমিসংলগ্ন স্থানে জাজিম পাতা হয়েছে অন্য সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের জন্যে। অন্যদিকে, জাজিমহীন খোলা জমি নির্দিষ্ট করা হয়েছে মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য। এ দেখে রবীন্দ্রনাথ তো চরম অসন্তুষ্ট। কিন্তু আমলারা কিছুতেই শিলাইদহের এই পুরনো রীতিকে পরিবর্তন করতে চাইলেন না। অগ্যতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন, প্রজাদের বসার ব্যবস্থা পরিবর্তন না করলে তিনি ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান বর্জন করবেন। তাঁর জেদের কাছে অবশেষে সকলকে হার মানতে হল। সব প্রজা বসলেন একই জাজিমপাতা আসনে। সকলের মাঝে বসলেন বছর তিরিশের সুদর্শন জমিদার—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাঁর এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র জমিদারি ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করেনি, বরং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বিভিন্ন লেখা ও কাজের মাধ্যমেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে জোর দিয়েছিলেন আজীবন। শুধু জমিদার হিসেবেই নয়, এই ধরনের কাজের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিল একজন আদর্শ সমাজ সংস্কারক। মানবতাবাদী। অসাম্প্রদায়িকতার কাণ্ডারি।
(লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক)
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস
অমৃত কথা
-
অবিদ্যা
- post_by বর্তমান
- জুলাই 17, 2025
এখনকার দর
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুলাই 16, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুলাই 16, 2025
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025